আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে

Latest News:
জানা-অজানা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
জানা-অজানা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৫

চন্দ্রবিজয়ী তিন নভোচারীর ঢাকা ভ্রমণ

ষাট দশকের শেষার্ধ, তখন সময়টা এমন ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানীদের জীবনে খুব কম সময়ই উৎসবের উপলক্ষ্য আসতোসব সময় এক আতংকে সময় কাটতো সবার, এই বুঝি পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের অধিকার, আমাদের দাবী ছিনিয়ে নিয়ে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দিবে আমাদের মুখতারপরও এ সময় কিছু ব্যাপার এদেশবাসীর উৎসবের উপলক্ষ্য নিয়ে এসেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চন্দ্র বিজয়ী তিন নভোচারীর স্বস্ত্রীক ঢাকা ভ্রমণ

নভোচারীত্রয় বিশ্বভ্রমনের ১৭ টি দেশের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন
১৯৬৯ সালের ২৭শে অক্টোবর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা নগরী এক উৎসবমুখর বেশ ধারন করেসারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষের ঢল নামে ঢাকায়তৎকালীন কুর্মিটোলা বিমান বন্দর ও ঢাকায় প্রবেশের মুল রাস্তায় প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটেরাস্তার দু-পাশে নারী-পুরুষ, ছেলে, বুড়ো সমানে ভিড় করতে থাকে

দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের সময় মার্কিন বিশেষ বিমানটি এ্যাপোলো-১১ মিশনের নভোচারী ও চন্দ্রবিজয়ী বীর নেইল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স এবং তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে যখন বিমান বন্দরে অবতরণ করেন,তখন প্রতিরক্ষা বাহিনীর আবেষ্টনী ভেদ করে জনতা বিমানের দিকে দৌড়াতে শুরু করেতিন চন্দ্র বিজয়ী ও তাঁদের স্ত্রীরা বিমান থেকে বেরিয়ে আসলে জনতা তুমুল ও মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে তাঁদের অভিনন্দন জানায়নভোচারীরাও হাত তুলে এ অভিবাদনের জবাব দেনবিমান বন্দরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রঙীন পোষাক পরিধান করে তাঁদের ফুলের তোড়া দ্বারা বরণ করে নেয়বিমান বন্দরে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বহু সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেনপূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বহু মার্কিন নাগরিকও বিমান বন্দরে এসে উপস্থিত হন

বিমান বন্দরটিকে নভোচারীদের ছবি ও প্রতিকৃ্তি এবং পাকিস্তান ও মার্কিন পতাকায় সুসজ্জিত করা হয়একটি বিরাট ব্যানারে লেখা ছিল, “আপনাদের এ সাফল্যে সমগ্র মানবজাতি গৌরবান্বিতবিমান বন্দর হতে একখানা খোলা সেভ্রোলেট গাড়ীতে নভোচারীত্রয় এবং অপর একখানা গাড়ীতে মিসেস কলিন্স ও মিসেস অলড্রিনকে নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে শহরের প্রায় নমাইল রাস্তা পরিভ্রমণ করা হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছেলেরা ঢোল বাজিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানায়কেউ ফুলের তোড়া, কেউ ফুলের পাপড়ি, কেউবা অভিনন্দন লিখিত শব্দমালা চলন্ত গাড়ীর প্রতি নিক্ষেপ করে তাঁদের অভিনন্দন জানায়

দীর্ঘ শোভাযাত্রা শেষে অতিথীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন) পৌছেনসেখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা ভাষণ দেনগভীর আনন্দের সহিত তাঁরা সাংবাদিকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেনমহাশূন্যচারীদের আগমন উপলক্ষে তাঁদের চাঁদে অবতরণ এবং পরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়এ সময় নভোচারীদের স্ত্রীরাও স্থানীয় বিশিষ্ট মহিলা ও মহিলা সাংবাদিকদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন

ঢাকা টেলিভিশন (বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশন) সাধারনত সোমাবার বন্ধ থাকলেও এদিন মহাশূন্যচারীদের আগমনের দৃশ্য সরাসরি প্রচারের জন্য বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করেবিকেলে পূর্ব পাকিস্তান সরকার নভোচারীদের এক সম্বর্ধনা ও প্রীতিভোজের আয়োজন করেগভর্ণমেন্ট হাউসে ৬জন বিউগল বাদকের নিনাদের মধ্য দিয়ে মহাশূন্যচারীদের আগমনীবার্তা ঘোষনা করা হয়অনুষ্টানে উপ-মহাদেশের ঐতিহ্যবাহী জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীবৃন্দ ছাড়াও শ্রমিক ও ছাত্রনেতৃবৃন্দও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন

উক্ত অনুষ্ঠানে মহাশূণ্যচারীগণ তৎকালীন গভর্নর জনাব আহসানের সাথে উপহার ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেনজনাব আহসান এ অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানেরও প্রতিনিধিত্ব করেনঅনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথে অন্যতম আকর্ষন ছিল এ্যাপোলো-১১ রকেটের মডেল সন্নিবেশিত বিরাটকার একটি কেকচন্দ্রবিজয়ী নভোচারী ও তাঁদের স্ত্রীদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে গভর্ণর আহসান বলেন, “এ বিরাট সাফল্য বিজ্ঞান ও কারিগরী বিজ্ঞানের বিজয় এবং একটি মহান সমাজের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বিপুল আকারে মানবিক ও বৈষয়িক সম্পদের সমুন্নয় সাধনেরই ফলশ্রুতিগভর্ণর পূর্ব পাকিস্তান ভূগোল সমিতির পক্ষ হতে মহাশূণ্যচারীদের একটি স্বর্ণপদক প্রদান করেনপৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রদানদের বাণী সম্বলিত যে ফলকটি মহাশূণ্যচারীগণ চন্দ্রতরীতে করে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার একটি রেপ্লিকা তারা গভর্ণরের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে উপহার দেনপাকিস্তানের জনগণের জন্য ফেলে আসা ফলকের একটি প্রতিকৃতিও তারা আহসানের নিকট প্রদান করেন

মাত্র একুশ ঘন্টা ঢাকায় অবস্থানের পর চন্দ্রমানবরা পরদিন মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটায় তাঁদের বিশেষ বিমানযোগে ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগ করেনবিমান বন্দরে বহু লোকজন ও সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ তাঁদের বিদায় অভিবাদন জানান সময় অনেকের চোখের কোণে জলের চিলিক দেখা যায়স্বল্পসময়েই তারা এদেশের জনগণের হৃদয়ের মণি কোঠায় স্থান করে নেন

তথ্যসূত্র; এই পোষ্টটি তৈরী করতে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত গাজীউর রহমান লিখিত রকেট ও চন্দ্র বিজয়ের ইতিকথানামক তথ্যবহুল বইয়ের যথেষ্ট সাহায্য নেয়া হয়েছেউইকিপিডিয়ারও কিছু সাহায্য নেয়া হয়েছেআর গুগলে অনেক খুঁজাখুঁজি করেও নভোচারীদের ঢাকা ভ্রমনের ভালো কোন ছবি পাইনি!

শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলা সিনেমার তালিকা



মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলা সিনেমার তালিকা।

১৯৭০-এর দশকঃ

১.জীবন থেকে নেওয়া (১৯৭১) — জহির রায়হান পরিচালিত
২.ওরা ১১ জন (১৯৭২) — চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত
৩.বাঘা বাঙ্গালী (১৯৭২) — আনন্দ পরিচালিত
৪.জয় বাংলা (১৯৭২) — ফকরুল আলম পরিচালিত
৫.অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২) — সুভাষ দত্ত পরিচালিত
৬.ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩) — আলমগীর কবির পরিচালিত
৭.আমার জন্মভূমি (১৯৭৩) — আলমগীর কুমকুম পরিচালিত
৮.সংগ্রাম (১৯৭৩) — চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত
৯.আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩) — খান আতাউর রহমান
১০.আলোর মিছিল (১৯৭৪) — নারয়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত
১১.বাংলার ২৪ বছর (১৯৭৪) — মোহাম্মদ আলী পরিচালিত
১২.কার হাসি কে হাসে (১৯৭৪) — আনন্দ পরিচালিত
১৩.মেঘের অনেক রঙ (১৯৭৬) — হারুন-উর-রশিদ পরিচালিত


১৯৮০-এর দশকঃ

১৪.বাঁধন হারা (১৯৮১) — এ. জে. মিন্টু পরিচালিত
১৫.কলমীলতা (১৯৮১) — শহীদুল হক খান পরিচালিত
১৬.চিৎকার (১৯৮১) — মতিন রহমান পরিচালিত

১৯৯০-এর দশকঃ

১৭.একাত্তরের যীশু (১৯৯৩) — নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত
১৮.নদীর নাম মধুমতি (১৯৯৪) — তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত
১৯.আগুনের পরশমণি (১৯৯৫) — হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত
২০.মুক্তির গান (১৯৯৫) — তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত
২১.হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড (১৯৯৭) — চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত
২২.মুক্তির কথা (১৯৯৯) — তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত

২০০০-এর দশকঃ

২৩.মাটির ময়না (২০০২) — তারেক মাসুদ পরিচালিত
২৪.জয়যাত্রা (২০০৪) — তৌকির আহমেদ পরিচালিত
২৫.শ্যামল ছায়া (২০০৪) — হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত
২৬.খেলাঘর (২০০৬) — মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত

২০১০-এর দশকঃ

২৭.আমার বন্ধু রাশেদ - মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত
২৮ গেরিলা (চলচ্চিত্র) - নাসিরুদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত

আরো আছেঃ এখনো অনেক রাত, মেঘের পর মেঘ ,হৃদয়ে আমার দেশ, হৃদয়ে'৭১, সংগ্রাম, ৭১ এর গেরিলা ও আরো নাম না জানা অনেক।

এটি কোন চূড়ান্ত তালিকা নয়। আপনার জানা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোন চলচ্চিত্রের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে থাকলে দয়া করে মন্তব্যের ঘরে সেই সিনেমার নামটা উল্লেখ করে দিন। আমি পোস্টটা আপডেট করে নেব।

তথ্যসূত্রঃ বাংলা চলচ্চিত্র গ্রুপ

বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৪

কল্পনা নয় বাস্তবের শার্লক হোমস

জেমস বন্ডের মতো কালজয়ী আরেকটি গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস। শত বছর ধরে পাঠক হৃদয়ে যার সপ্রতিভ অবস্থান। মজার ব্যাপার হচ্ছে জেমস বন্ডের মতো এই শার্লক হোমস চরিত্রও বাস্তবের এক ব্যক্তিকে অবলম্বন করে রূপায়িত। তবে চলুন এখন জানি, কে সেই বাস্তবের শার্লক হোমস!

১৮৮৬ সালের মার্চ মাস। প্লাইমাউথের বুশ ভিলাতে ডাক্তারির পাশাপাশি গোয়েন্দা কাহিনী লিখায় হাত দেন আর্থার কোনান ডয়েল। ১৮৮৭ সালে A Tangled Skin উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি শার্লক হোমসের সৃষ্টি করেন। প্রথম দিকে শার্লকের নাম রাখা হয়েছিলো শেরিনফোর্ড হোমস। কিন্তু এই নাম পছন্দমতো না হওয়ায় বদলে রাখলেন শার্লক হোমস। সেই সাথে উপন্যাসের নাম বদলে রাখলেন ‘এ্যা স্টাডি ইন স্কারলেট’। একসময় ডাক্তারি পেশা ছেড়ে লেখালেখিতে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন।

শিল্পীর চোখে শার্লক হোমস
 উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম ঠিক হলো, কিন্তু তারপরও ডয়েল তীব্র উৎকন্ঠায় ভুগছেন। তার মনে শংকা ছিলো তিনি কি কাহিনীটাকে এগিয়ে নিতে পারবেন! তিনি এমন এক গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করতে চান যা তখনকার জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র দুপ্যাঁকেও বুদ্ধিতে ছাড়িয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো ডক্টর বেলের কথা।

১৮৭০ সালে কোনান ডয়েল এডিনবরা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। সে সময় ডক্টর যোসেফ বেল এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এডিনবরা মেডিক্যাল জার্নালের সম্পাদক। এডিনবরা গোলন্দাজ বাহিনীর তিনিই তখন উপদেষ্টা চিকিৎসক। কোনান ডয়েল নিজেই বলেছেন, “শার্লক হোমস চরিত্র সৃষ্টি করতে গিয়ে আমি বারবার তার কথাই ভাবছিলাম। আমার পুরনো শিক্ষক যোসেফ বেল। তাঁর ঈগল পাখির মতো চোখ-মুখ, কৌতূহলোদ্দীপক চলাফেরা, যেকোন ব্যাপারে তাঁর গভীর চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধানের অদ্ভুত ক্ষমতা…এ সবই আমার বারবার মনে পড়ছিলো।”

এডিনবরা হাসপাতালের বহির্বিভাগে কোনান ডয়েল, ডক্টর বেলের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন, রোগীদের কেস হিস্ট্রি লিখতেন। তখন ডয়েল, বেলের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে থেকে তার বিভিন্ন কর্মকান্ড স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। একবার একজন রোগীকে দেখেই বেল বলে দিয়েছিলেন, “ভদ্রলোক হাইল্যান্ড রেজিমেন্টে একজন নন-কমিশনড অফিসার ছিলেন। বার্বাডোজে কিছুদিন কাটিয়ে এসেছেন।”

উপস্থিত হতভম্ব ছাত্রদের সামনে ডক্টর বেল ঘটনাটির ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন এভাবে, “ ভদ্রলোকের চেহারা, আচার-আচরণ বেশ সম্ভ্রান্ত কিন্তু উনি মাথা থেকে টুপি খোলেননি। সেনাবাহিনীর লোকেরা টুপি না খোলায় অভ্যস্ত। ভদ্রলোক নিশ্চয় কয়েকদিন আগে অবসর নিয়েছেন, তা না হলে তিনি এই সাধারণ ভব্যতায় অভ্যস্ত হতেন। ভদ্রলোক অন্যের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে ভালোবাসেন, স্কটল্যান্ডের লোকের এ রকম অভ্যাস থাকে। ভদ্রলোকের গোদ রোগ হয়েছে, ওটা ওয়েষ্ট ইন্ডিজের রোগ, ব্রিটেনের নয়। ভদ্রলোক যে বার্বাডোজে ছিলেন, এটাই তার সবচেয়ে বড়প্রমাণ।”

 উপরের ব্যাখ্যা থেকেই বুঝা যায় ডক্টর বেল কতোটা তীক্ষ বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। আর তার সেই বুদ্ধিমত্তায় বেশী আকৃষ্ট হয়েছিলেন কোনান ডয়েল। তাইতো শার্লক হোমস চরিত্র অলংকরণ করতে গিয়ে বারবার বেলের কথা মনে হয়েছে তার। ১৮৯২ সালের ৪মে কোনান ডয়েল এক চিঠিতে ডক্টর বেলকে লিখেছিলেন, “এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, আপনাকে দেখেই আমি শার্লক হোমস এর চরিত্র সৃষ্টি করেছি। শার্লক হোমসের বিশ্লেষণী ক্ষমতা কোনও বানানো অতিরঞ্জিত ব্যাপার নয়। এডিনবরা হাসপাতালের বহির্বিভাগে আমি নিজে আপনাকে ওই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেখেছি।”

ছাত্রের এ গুরুদক্ষিণায় ডক্টর বেল অবশ্যই খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে শার্লক হোমসের উৎস সম্বন্ধে অন্য ধারণা পোষণ করতেন। এক চিঠিতে তিনি ডয়েলকে লিখেছিলেন, “আমারতো মনে হয় তুমিই শার্লক হোমস। আর তুমি সেটা ভালো করেই জানো।”

আর্থার কোনান ডয়েল, শার্লক হোমসকে নিয়ে চারটি উপন্যাস ও ছাপ্পান্নটি ছোটোগল্প লিখেছেন। ১ম কাহিনী ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হয়। ২য় কাহিনী ‘দ্য সাইন অব দা ফোর’ ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয়। ১৮৯১ সালে দ্য স্ট্যান্ড ম্যাগাজিন পত্রিকায় প্রথম ছোটগল্পের সিরিজটি প্রকাশিত হওয়ার পরই শার্লক হোমস চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত হোমসকে নিয়ে একগুচ্ছ ছোটগল্পের সিরিজ ও আরও দুটি ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়। হোমস কাহিনীর পটভূমির সময়কাল ১৮৮০ থেকে ১৯০৭ সাল। শেষ ঘটনাটির সময়কাল অবশ্য ১৯১৪।

আর্থার কোনান ডোয়েল
 শার্লক হোমস চরিত্র এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে দিনদিন এর নতুন কাহিনীর পাঠক চাহিদা বেড়েই চলেছিলো। এক চরিত্রকে নিয়ে বারবার লিখতে লিখতে কোনান ডয়েল বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাছাড়া গোয়েন্দা কাহিনী লিখতে গেলে প্রয়োজন গভীর চিন্তাভাবনার। তাই শেষদিকে তিনি শার্লক হোমসকে নিয়ে লেখা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাঠক চাহিদার কাছে তিনি হার মেনেছিলেন। কোনান ডয়েলের মৃত্যুর পরও শার্লক হোমসকে নিয়ে অনেক কাহিনী লিখা হয়েছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত হয়েছে অজস্র চলচিত্র।

আজও বিশ্বের রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের কাছে শার্লক হোমস সত্যিকারের এক জীবন্ত চরিত্র। শার্লক হোমস যে একটা কাল্পনিক চরিত্র, একথা আজও অনেকেই বিশ্বাস করতে চাননা। এখনও তার নামে ২২১/বি, বেকার স্ট্রিটের ঠিকানায় সপ্তাহে গড়ে ৫০-৬০ খানা চিঠি আসে । গল্পের চিঠিগুলোর উত্তর দিতেন তার সহকারী বন্ধু ওয়াটসন। কিন্তু এখন ওয়াটসন না থাকলেও উত্তর দেওয়া হয় ‘হোমস সোসাইটি’ এর পক্ষ থেকে । সবাইকে জানানো হয়, আমরা দুঃখিত! শার্লক হোমস এখন গোয়েন্দাগিরি করছেন না, তিনি তার পেশা ছেড়ে মৌমাছি পালনে ব্যস্ত। সত্যিই এ এক অদ্ভুত ব্যাপার।

কি পাঠাবেন নাকি আপনিও একটি চিঠি! বলা যায়না গল্পের শার্লক হোমস বাস্তবে উত্তর দিয়ে দিতে পারেন!!!

রক্ত মাংসের আসল জেমস বন্ড

একজন সাহিত্যিক তার কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য রচনা করে থাকেন। তারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে অনেক নতুন নতুন চরিত্রের সৃষ্টি করেন। সেইসব চরিত্রের মধ্যে কিছু চরিত্র সাহিত্য জগতে এক অনন্য স্থান অর্জন করে। সেই চরিত্রগুলোর সাথে লেখক-পাঠক উভয়েই এতোটা মিশে যান যে গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলো আমাদের বাস্তব জীবনের অংশ হিসেবেই মনে হয়। আসলেই এরকম কিছু বিখ্যাত চরিত্র আছে যা বাস্তব জীবনের লুকায়িত ভান্ডার থেকে তুলে নিয়ে সাহিত্যিক সাহিত্য ভুবনে আলোড়ন তুলেছেন। আজ সেইরকম একটি বিখ্যাত চরিত্রকে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

১৯৫২ সাল। ক্যারিবীয় উপকূলের জ্যামাইকা দ্বীপের গোল্ডনেয়ি শহরে নিজ বাড়িতে বসে বিখ্যাত সাহিত্যিক ইয়ান ফ্লেমিং তার প্রথম উপন্যাস ‘ক্যাসিনো রয়েল’ লিখতে শুরু করেছেন। তিনি তার প্রথম উপন্যাস থেকেই একটি দুর্ধর্ষ নায়ক চরিত্র সৃষ্টি করতে চান। লিখা শুরু হয়ে গেছে কিন্তু নায়কের নাম নিয়ে পড়লেন মহা সমস্যায়। মাথার মধ্যে অনেক নাম আসছে কিন্তু কোনটিই মনমতো হচ্ছেনা। জমকালো গম্ভীর কোন নাম নয়, নিতান্ত সহজ-সরল সাধারন একটি নাম তিনি খুঁজছিলেন। বিভিন্ন বইপত্র তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও যুতসই নাম পাচ্ছেননা!

বইপত্র ঘাটাঘাটি করার সময় হঠাৎ একটি বইয়ের ওপর তার চোখ আটকে গেলো। বইটি ওয়েষ্ট ইন্ডিজের পাখিদের নিয়ে লেখা। বইয়ের নাম ‘বার্ডস অব ওয়েষ্ট ইন্ডিজ’। লেখকের নাম খুব সাধারণ, আচমকা এই নামটি যেন ধাক্কা মারলো তার বুকে। বইটির লেখকের নাম জেমস বন্ড

জেমস বন্ডের স্রস্টা ইয়ান ফ্লেমিং
 আর পিছনে ফিরে তাকাননি ফ্লেমিং। জেমস বন্ড নামটিকে মুল চরিত্র বানিয়ে উপন্যাস এগিয়ে নিতে শুরু করলেন। তার পরের ঘটনা তো আর ইতিহাস। সর্বকালের প্রিয় চরিত্র হিসেবে স্থান করে নিলো পাঠকের হৃদয়ে। ফ্লেমিং পরে রসিকতা করে বলেছিলেন “আমার উপন্যাস লেখার পেছনে সেরকম কোন মহৎ কোনও কারণ নেই। ৪৩ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলাম, বুড়ো বয়সে বিয়ে করার সেই আঘাতটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্যই বোধহয় উপন্যাস লিখতে শুরু করি।”

বন্ডের অভিযান যেন শুরু হয়েছিলো ফ্লেমিংয়ের অবিবাহিত জীবনকে বিদায় জানাতে। নায়ক জেমস বন্ড তার অবিবাহিত জীবনকে বিদায় অভিবাদন জানিয়েছিলো, কিন্তু তার স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিংকে নয়। স্রষ্টা ফ্লেমিং এবং সৃষ্টি জেমস বন্ড, এই দুজনের মধ্যে অনেক মিল। যেন একজনকে ছাড়া অন্যজন পরিপূর্ণতা লাভ  করতে পারতোনা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্লেমিং নৌবাহিনীর গুপ্তচর বিভাগের প্রধান পরিচালকের সহকারী ছিলেন। চাকরী-সূত্রে বেশ কিছু গুপ্তচর এজেন্টকে তিনি অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছেন। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন দুস্কো পোপোভ। পোপোভ জন্মসূত্রে যুগোস্লাভিয়ার লোক, কাজ করতেন ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগে। ব্রিটিশ এজেন্ট হিসেবে তিনি গোপনে নাৎসি গুপ্তচরদের সঙ্গে মিশে যেতেন, সংগ্রহ করতেন জার্মানদের সব গোপন খবর। ব্রিটিশদের সম্বন্ধে ভুল খবর দিয়ে নাৎসি বাহিনীকে উলটোপথে পরিচালিত করতেন।

অন্যদিকে ব্রিটেনের ‘ডাবল এক্স’ কমিটির প্রাণ ছিলেন এই দুস্কো পোপোভ। ডাবল এক্স কমিটি নামের মধ্যেই তার কাজ-কারবারের রহস্য লুকিয়ে আছে। ইংরেজী ‘ডাবল ক্রসিং’ কে বাংলা করলে দাঁড়ায় দ্বৈত ভুমিকা। নাৎসি গুপ্তচর বাহিনীর সঙ্গে মিশে যাবে কিছু ব্রিটিশ এজেন্ট, ভুল খবর দিয়ে তারা নাৎসি বাহিনীকে ঠেলে দেবে বিপর্যয়ের মুখে। উপন্যাসের বন্ডের মতো বাস্তবের এই বন্ড দুস্কো পোপোভ খুব বিপজ্জনকভাবে বাঁচতেন। রাজকীয় জীবন যাপন করতেন। আর কর্মদক্ষতা ছিলো অসাধারণেরও অসাধারণ। আশ্চর্য্যরকম দক্ষতায় তিনি সব বাধা দূর করতেন।

বাস্তবের জেমস বন্ডঃ দুস্কো পোপোভ

একসময় ফ্লেমিং পোপোভকে ক্যাসিনোতে দেখেছিলেন। তীক্ষ বুদ্ধিমত্তার সাথে জুয়ার চাল দিতেন পোপোভ। রুলেত টেবিলেই তিনি প্রমাণ করে দেন, জীবন নিয়ে জুয়া খেলতেও তিনি বিন্দুমাত্র পেছপা নন। আর আমাদের গল্পের জেমস বন্ডের অভিযানও শুরু হয়েছিলো ক্যাসিনো থেকে।

১৯৭৪ সালে দুস্কো পোপোভ একটি বই প্রকাশ করেন। বইটির নাম ছিলো ‘স্পাই-কাউন্টারস্পাই’। ঘটনার ঘনঘটা, মৃত্যু মুখে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতাসহ পোপোভের জীবনের অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা এই বইয়ে স্থান পেয়েছে। বন্ডের মতো পোপোভও বিপদের মুখে স্থির, অবিচল থাকতেন। পোপোভ লিখেছেন, “আমি শুনেছি আমার অভিজ্ঞতা ও জীবনের ওপর কিছু-কিছু ক্ষেত্রে ভিত্তি করে ইয়ান ফ্লেমিং জেমস বন্ড চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। জেমস বন্ড রক্তমাংসের মানুষ হলে গুপ্তচরবৃত্তির দুনিয়ায় ৪৮ঘন্টাও বেঁচে থাকতেন কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। এই পৃথিবীতে পদে-পদে মৃত্যু আর বিপদের হাতছানি।”

 এই রোমাঞ্চকর জনপ্রিয় চরিত্রে স্যঁ কোনারি, রজার মুর, পিয়ার্স ব্রোসনান, ডেনিয়েল ক্রেইগ সহ প্রমুখ অভিনেতা এই চরিত্রে অভিনয় করে মানুষের মন জয় করেছেন। আজও বিশ্বের রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের কাছে জেমস বন্ড অন্যতম প্রিয় একটি চরিত্র।
Copyright © 2014 রিপন ঘোষের খেরোখাতা All Right Reserved
^
Blogger দ্বারা পরিচালিত.