আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে

Latest News:

বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সিলেটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবকাশ যাপনের জন্য আসামের তৎকালীন রাজধানী শৈলশহর শিলং এলেন। তার সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী। শিলং এর পার্শ্ববর্তী শহর সিলেটে এই খবর চাউর হয়ে গেলো দ্রুততম সময়ে। সিলেটের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে একটা চাপা উত্তেজনা বইতে শুরু করলো। কবিগুরু এতো কাছে এসেছেন। কোনভাবেই এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায়না। যেভাবে হোক রবি ঠাকুরকে সিলেটে আনতেই হবে।

সিলেট ব্রাক্ষসমাজের তৎকালীন সম্পাদক গোবিন্দ নারায়ন সিংহ কবিকে সিলেট পদার্পণের নিমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিগ্রাম করলেন। কিন্তু বাধ সাধলো তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভৌগলিক দিক দিয়ে সিলেট শিলং এর কাছাকাছি হলেও সিলেট পর্যন্ত সরাসরি রাস্তা ছিলোনা। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি পর্যন্ত সড়ক ছিল। চেরাপুঞ্জি থেকে খাসিয়ারা ব্যক্তিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার একটি পদ্ধতি প্রচলন ছিলো। কিন্তু এ ব্যবস্থা মানবাধিকারের লংঘন বলে কবি সরাসরি নাকচ করেন এবং সিলেট থেকে প্রেরিত নিমন্ত্রণ বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন।

কবির নেতিবাচক উত্তর পেয়ে গোবিন্দ নারায়ন সিংহ আনজুমানে ইসলাম, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংঘটনের সাথে যোগাযোগ করে কয়েকটি টেলিগ্রাম পাঠান। আবেগঘন টেলিগ্রামগুলো কবির হৃদয়কে প্রভাবিত করে। তিনি সিলেট আসার দীর্ঘ অথচ বিকল্প পথ গৌহাটী থেকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লামডিং-বদরপুর সেকশন হয়ে করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে সিলেট পৌছানোর পথে সিলেট আসতে রাজী হন।

৩১ অক্টোবর কবিগুরু শিলং থেকে গৌহাটী অভিমূখে যাত্রা করেন। সেখানে কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়। দিন তিনেক সেখানে অবস্থান করে কবি ৩ নভেম্বর গৌহাটী থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। গৌহাটী থেকে সিলেটের পথ প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই কবিকে এক পলক দেখার জন্য ভক্তদের ভিড় লেগে যায়। সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধিদল কবিগুরুকে এগিয়ে আনতে বদরপুর পর্যন্ত যায়। ট্রেন কুলাঊড়া জংশনে পৌছালে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। কবি ও তার সহযাত্রীরা কুলাঊড়াতে রাত্রিযাপন করেন।

কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য অভ্যর্থন পরিষদ গঠন করা হয়। সভাপতি নিযুক্ত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ। ৫ নভেম্বর সকালে ট্রেন সিলেট স্টেশনে পৌছালে কবিগুরুকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ, মৌলভী আব্দুল করিম, রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্ত, এহিয়া ভিলা, কাজী বাড়ি ও মজুমদার বাড়ী, দস্তিদার বাড়ির অভিজাত ব্যক্তিবর্গ। সিলেট মহিলা সমাজের পক্ষে অভ্যর্থনা জানান নলিনীবালা চৌধুরী।

সুরমা নদীর উপর ঐতিহ্যবাহী কীনব্রীজ তখনো হয়নি। কবিগুরু ও তার সহসঙ্গীরা বজরায় সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে মূল সিলেট শহরে প্রবেশ করেন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চাঁদনীঘাটকে পত্র-পুষ্প পতাকা, মঙ্গল ঘট আর লাল শালু দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি মৌলভী আব্দুল করিমকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি সুসজ্জিত ফিটন গাড়িতে করে শহরের উত্তর-পূর্বাংশে ছোট টিলার উপর পাদ্রী টমাস সাহেবের বাংলোর পাশে একটি বাড়িতে যান। এখানেই কবির থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেখানে পৌছালে কবিকে সঙ্গীত ও চন্দন তিলকের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় ব্রাহ্মসমাজের আমন্ত্রণে কবি তাদের উপাসনায় যোগ দেন। পরদিন ৬ নভেম্বর সকালে লোকনাথ টাউনহলে কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সৈয়দ আব্দুল মজিদ। অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন নগেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনন্দনের জবাবে বক্তৃতা প্রদান করেন যা পরে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ‘বাঙালির সাধনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। একইদিন দুপুরে মুরারীচাঁদ কলেজের (এম.সি কলেজ) বাংলা ও সংস্কৃতের অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রীর  আমন্ত্রণে কবি তার বাড়িতে যান। বেলা দুইটায় ব্রাহ্মসমাজগৃহে সিলেট মহিলা সমিতি আয়োজিত সংবর্ধনায় যোগ দেন।

এরপর কবি শহরের উপকন্ঠে মাছিমপুর এলাকায় মনিপুরী পল্লীতে যান। কবির সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী রমনী কর্তৃক পরিবেশিত রাসনৃত্য মুগ্ধ হন। এখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিগুরু পরবর্তীতে শান্তি নিকেতনে মনিপুরী নৃত্য চালু করেছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে ১৯২০ সালে কবিগুরু তৎকালীন সিলেট জেলার কমলগঞ্জ থানার বালিগাও গ্রামের মণিপুরী নৃত্যগুরু নীলেশ্বর মুখার্জী, ত্রিপুরা থেকে গুরু বুদ্ধিমন্ত সিংহ ও আসামের গুরু সেনারিক সিংহ রাজকুমারকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান প্রশিক্ষক হিসেবে।

পরদিন সাত নভেম্বর সকালে সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌহাট্টার বিখ্যাত সিংহ পরিবারের এক নবজাতকের নামকরণ অনুষ্ঠানে কবি যোগদান করেন। এদিন দুপুরে মুরারিচাঁদ ছাত্রাবাসে কলেজের ছাত্র-শিক্ষকমন্ডলী কবিগুরুকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। কলেজের ছাত্ররা একটি শোভাযাত্রা করে গীতবাদ্য সহকারে সভামন্ডপে নিয়ে আসেন। অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রী সরচিত কবিতা পাঠ করেন। কবিকে একাধিক মানপত্র প্রদান করা হয়। অভিনন্দনের উত্তরে কবি সুদীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করেন। পরবর্তীতে এই বক্তব্য শান্তিনিকেতন পত্রিকার ১৩২৬ সালের পৌষ সংখ্যায় ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে প্রকাশিত হয়। এমসি কলেজের সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে পরবর্তীকালের একজন বিখ্যাত বহুভাষী রমসাহিত্যিক তন্ময় হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য শুনছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার গুণমুগ্ধ সেই ভক্তকে শান্তিনিকেতনে আসার কথা বলেন। ১৯২১ সালে সেই ছাত্র শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন এবং রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেন। তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী।

সভাশেষে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ অপূর্বচন্দ্র দত্তের আতিথ্যগ্রহণ করে তার বাসায় পদার্পন করেন। পরে শহরের গণমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে রায়বাহাদুর নগেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাসায় এক প্রীতিসম্মেলনে যোগ দেন। পরদিন আট নভেম্বর  কবিগুরু সিলেট থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার উদ্দেশ্যে সিলেট ত্যাগ করেন। আর বিমুগ্ধ নয়নে পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকেন তার গুণমুগ্ধরা।

মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়'

ঊনবিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ। ব্রিটিশ শাসনের প্রায় একশত বছর হতে চললো। এরই মধ্যে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় তৈরী হয়েছে এক নব্য ধনীকশ্রেণি যারা কাঁচা পয়সার গরমে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। মদ আর নারীতে দিনরাত ডুবে থাকে। দিনে কোন কাজ থাকুক আর না থাকুক সন্ধ্যে নামলেই বাঈজী বাড়ি, বেশ্যালয় আর মদের ফোয়ারার উদ্দেশ্যে এরা বেরিয়ে পড়ে।
এই ধনিকশ্রেণির সমান্তরালেই গড়ে উঠলো ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত একটা সমাজ। যদিও এই শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে অনেকেই ধনীর দুলাল, তারপরও ঈশ্বরচন্দ্রের মতো অনেকেই উঠে এসেছেন একেবারে অজপাড়া গা থেকে।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের শিক্ষাব্যবস্থাটাই ছিলো কেরানী তৈরীর কারখানা। হাজার হোক তারা রাজার জাত! অফিস আদালতের কেরানীর কাজ কী তাদের সাজে! তাই ব্রিটিশদের ছত্রছায়াতেই চলল কেরানী তৈরির স্কুল কলেজ। কিন্তু যোগ্যতা থাকলে ঠেকায় কে! বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও নিজেদের যোগ্যতাবলে কিছু সংখ্যক স্থানীয় লোক ব্রিটিশ রাজের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে! ব্রিটিশ সাহেবদের সমকক্ষ পদে চাকরী করবে নেটিভরা! ব্রিটিশরা তা মানবে কেন! তাই যতোই যোগ্যতা থাকুক একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে তাদের পদোন্নতি দেয়া হতোনা। সিনিয়র নেটিভদের চোখের সামনেই জুনিয়র ইংরেজরা উচে পদে বসে যেতো। কিন্তু চেয়ে দেখা ছাড়া আর কীইবা করার আছে! রন্ধ্রে রন্ধ্রে এভাবে বঞ্চিত করলেও কেউ কেউ এই ধারার পরিবর্তন করতে চাইলেন! এই নব্য শিক্ষিতদের মধ্য থেকেই একে একে বেরিয়ে এলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কালিপ্রসন্ন সিংহ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হরিশচন্দ্র মূখার্জীর মতো এমন কিছু মানুষ যারা শুধু নিজেদের সুখ নিয়েই স্থির থাকতে পারলেন না। এদের হাত ধরেই বাংলা ও বাঙালির জীবনে একে একে নব জাগরণ আসতে শুরু করলো। এ চরিত্রগুলোর কেউই বিতর্কের উর্ধ্বে নয়, তারপরও এক কথায় নির্দ্বিধায় বলা যায় এদের হাত ধরেই বাঙালির জীবনে এক নব ফল্গু ধারা বয়েছিলো। এদের হাত ধরেই বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি জগতে এলো আমূল পরিবর্তন। অনেক সামাজিক কুসংস্কার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো কেউ কেউ কথা বলতে শুরু করলেন এবং সফলতাও পেতে শুরু করলেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘সেই সময়’ উপন্যাসে বাংলার সেই সময় অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ (১৮৪০-১৮৭০) সময়কালের বাংলাকে তুলে ধরা হয়েছে। নবীনকুমার নামের এক বালকের জন্মের বর্ণনা দিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনী শুরু। সুনীল গাঙ্গুলী এই নামটি ছদ্দনাম হিসেবে ব্যবহার করলেও কাহিনীর গভীরে প্রবেশ করতেই বুঝা যায় এই ‘নবীনকুমার’ চরিত্রটি বাংলার এক বিখ্যাত ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কালীপ্রসন্ন সিংহ। তিনি হুতোমপ্যাচা নামেই সমধিক পরিচিত। তিনিই প্রথম সুললিত, শুদ্ধ ও মার্জিত বাংলায় মহাভারত অনুবাদ করেন। তবে তার বিখ্যাত গ্রন্থ “হুতোমপ্যাঁচার নক্সা”। এই গ্রন্থে অনেকটা কথ্য ভাষায় তিনি তৎকালীন নব্য বাবু সমাজের বিভিন্ন মুখোশ উন্মোচন করেছেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ অর্থাৎ নবীনকুমার চরিত্রটি উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ অবধি ছিলো। মূলত তাকে আবর্তিত করেই সুনীল গাঙ্গুলী পুরো উপন্যাসটি বিন্যস্ত করেছেন।

এই উপন্যাসের আরেকটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্রের সমাজ সংস্কারমূলক কাজগুলোর বর্ণনা চিরকাল আমরা পরীক্ষা পাশের জন্য ইতিহাস বই থেকে গলধকরন করে এসেছি। কিন্তু এই মহৎ কাজগুলো করতে তাকে পদে পদে কতো লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে, কতো কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে তা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি। সেই সময়ে সুনীল গাঙ্গুলী সেই কাজগুলোকে ইতিহাসের রসকষহীন উপাদানের মতো নয়, একদম জীবন্ত তুলে এনেছেন। হিন্দু বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন, বহু বিবাহের বিরোধীতা, শিক্ষা বিস্তারে একের পর এক স্কুল প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অনবদ্য অবদানগুলো খুব নিখুঁত আকারে কাহিনী আকারে উঠে এসেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এই উপন্যাসের শেষাবধী ছিলেন।

সেই সময় উপন্যাসের আরেকটি ক্ষ্যাপা চরিত্র মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনিও দাপটের সাথে পুরো উপন্যাসে বিরাজিত ছিলেন। মধুসূদনের উশৃংখল জীবন, ইংরেজী ভাষার মহাকবি হওয়ার বাসনায় হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ, তারপর অনেক পুড় খেয়ে কলকাতা ছেড়ে মাদ্রাজে গমন, প্রায় মধ্য ত্রিশে আবার কলকাতায় প্রত্যাগমন, ভাগ্যের ফেরে বাংলা সাহিত্যের সাথে জড়িয়ে যাওয়া, অতঃপর শর্মিষ্ঠা’র মতো প্রথম সার্থক বাংলা নাটক, মেঘনাদবধ কাব্যের মতো কালজয়ী সব রচনা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটগুলো খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে উঠে এসেছে এই উপন্যাসের বিস্তৃত জমিনে। কথিত চাষাভূষোদের ভাষাই তাকে দিলো মহাকবির তকমা! একেই বলে অদৃষ্ট। বাংলা ভাষায় তার সাহিত্য চর্চা খুব বেশীদিনের নয়। এ যেন এলাম দেখলাম আর জয় করলাম।

এই উপন্যাসের তুলনামূলক কম আকর্ষনীয় চরিত্র হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম ধর্মকে তিনি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। মূলত তার হাত ধরেই ব্রাহ্ম ধর্ম ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এখানে দেখা যাবে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ব্রাহ্ম ধর্মও কুসংস্কার ও প্রচলিত রীতি থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে বেরিয়ে আসতে পারেনা। সময়ের পরিক্রমায় ব্রাহ্মধর্মেও ভাঙ্গন ধরে।

এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছেন ডিরোজিও শিষ্যরা। ডিরোজিও ছিলেন একজন পর্তুগীজ শিক্ষক। তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজের প্রথম দিককার শিক্ষক। এই তরুন শিক্ষকের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে তার একশ্রেণির অনুগামী তৈরি হয়। ডিরোজিওর সেই শিষ্যরা ইয়াং বেঙ্গল নামে পরিচিত ছিলেন। ইয়াং বেঙ্গলের সদস্যরাই প্রথম হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার ও অনিয়মগুলোর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেন। এদের পদাংক অনুসরন করেই পরবর্তীতে অন্যরা অগ্রসর হয়েছেন। ডিরোজিও শিষ্যদের মধ্যে রয়েছেন দক্ষিনারঞ্জন মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামগোপাল ঘোষ এর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা।

উপন্যাসটির কাহিনী পরিক্রমায় আমরা নিখুঁত বর্ণনা পাই সিপাহী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর। সিপাহী বিদ্রোহের ঢামাঢোলের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য দেখা যায় বাংলার মুসলিম নব জাগরণের দুই দিকপাল সৈয়দ আমীর আলী ও নওয়ার আব্দুল লতিফ কে।

ঐতিহাসিক চরিত্র না হলেও উপনাসটির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে গঙ্গানারায়ন, বিধুশেখর মুখার্জী, রাইমোহন, দুলালচন্দ্র, দিবাকর, কুসুমকুমারী, হীরা বুলবুল, চন্দ্রনাথ ওরফে চাদু, কমলাসুন্দরী।

উনবিংশ শতকের অন্যতম বিখ্যাত চরিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপস্থিতি আমরা এই উপন্যাসে পাইনা। কারন উপন্যাসের কাহিনী শেষ হয়েছে নবীনকুমারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তখন রবীন্দ্রনাথ মাত্র আট-নয় বছরের বালক। বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও আমরা এই উপন্যাসে তেমনভাবে পাইনা। এই দুজনকে ভালোভাবে জানতে হলে পড়তে হবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘প্রথম আলো’। প্রথম আলো নিয়ে আরেকদিন লিখবো।
যাদের খাটখোট্টা টাইপের নিরস ইতিহাস পড়তে খুব অরুচি তারা চোখ বন্ধ করে এই উপন্যাসখানা পড়ে নিতে পারেন। এতে করে সাহিত্যের স্বাদ তো পাবেনই সেই সাথে পাবেন উনবিংশ শতকের এক উল্লেখযোগ্য সময়ের বাস্তব আখ্যান।

শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫

ঘন্টু মামা (পর্ব-৬)

এন্ড্রয়েড মোবাইলে ঘন্টু মামা অনেকটা মানিয়ে নিয়েছেন। এখন তিনি অনায়াসে সব ধরনের এপস ব্যবহার করতে পারেন। ফেসবুক, হোয়াটসএপ আর ক্যান্ডি ক্রাশের তো রীতিমতো প্রেমে পড়ে গেছেন। অবশ্য ঘন্টু মামাকে এন্ড্রয়েডে অভ্যস্ত করাতে আমাকে কম ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়নি! জয়াদি তো হুকুম দিয়েই খালাস; কিন্তু আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি কতো ধানে কতো চাল। মাঝে মাঝে তো মনে হয়েছে ঘন্টু মামার মতো মানুষদের জন্য ইংলিশ লার্নিং কোর্সের মতো এন্ড্রয়েড লার্নিং কোর্স চালু করা যায় কিনা!

জয়াদি প্রথম যেদিন ঘন্টু মামাকে এন্ড্রয়েড মোবাইল উপহার দিয়েছিলেন সেদিন ঘন্টু মামার চেহারা দেখার মতো হয়েছিল। মানুষ দামী উপহার পেলে খুশী হয় আর আমার ঘন্টু মামা হয়েছিলেন ভয়ার্ত আর বিরক্ত। ঘন্টু মামা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন তার ওপর নজরদারী করতেই জয়াদির এতো আয়োজন।

ঘন্টু মামার ফেসবুক প্রোফাইলে অবিবাহিত মেয়েদের প্রবেশাধীকার নিষিদ্ধ। বিশেষ পদাধীকার বলে জয়াদি এই নিষেধাজ্ঞা জারী করে রেখেছেন। জয়াদির ধারনা সুন্দরী মেয়েরা যখন-তখন এরকম বাউন্ডুলে মানুষের প্রেমে পড়ে যায়। ঘন্টু মামার প্রতি জয়াদির কঠোর হুশিয়ারি কোনভাবেই যেন ফ্রেন্ডলিস্ট হাইড করে রাখা না হয়। অর্থাৎ ঘন্টু মামার প্রোফাইল সবসময় গোয়েন্দা নজরদারীতে থাকে।

জয়াদির এসব কর্মকান্ড দেখে একদিন বললাম, এতো কষ্ট করার কী দরকার! ঘন্টু মামার ফেসবুক পাসওয়ার্ড তুমি জেনে নিলেই হয়। তখন ঘন্টু মামার সকল একটিভিটিজ তুমি ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতে পারবে।

আমার কথা শুনে জয়াদি আমার দিকে এমনভাবে তাঁকালেন যে, আমি আর কোন কথা বলতে সাহস পেলাম না। একটা ব্যাপার আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকেনা সুন্দরী মেয়েরা এতো রাগী হয় কেন! তবে জয়াদির কাঠিন্যের মধ্যেও যে জিনিসটা স্পষ্ট বুঝা যায় তা হলো ঘন্টু মামাকে তিনি অনেক ভালোবাসেন। ঘন্টু মামার অনিশ্চিত ভবিষত নিয়েই তার যতো দুঃশ্চিন্তা।

একটু আগে ঘন্টু মামা ভাইবারে কল দিয়েছেন। আজকাল মোবাইল ব্যালেন্স খরচ করতে ঘন্টু মামার বড্ড অনীহা। কল রিসিভ করতেই বললেন, তুই এক্ষুনি আমার বাসায় চলে আয়। জয়ার বাসায় আজ দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ।

খাওয়ার নিমন্ত্রণ শুনে আমি প্রমাদ গুনলাম। ঘন্টু মামার রাক্ষুসে খাই খাই স্বভাবের জন্য আমাকে বেশ কয়েকবারই অস্বস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আজ আবার কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এই ভেবে আমি বললাম, আমি এখনো স্নান করিনি। এছাড়া আমার একটু জ্বর জ্বর লাগছে। আমি যেতে পারবোনা।

ঘন্টু মামা বললেন, ওই ব্যাটা ফাজিল। আমাকে হাঁদারাম পেয়েছিস? এই বলছিস স্নান করবি আবার বলছিস জ্বর! জ্বর হলে কেউ স্নান করে নাকি!

আমি সামলে নিয়ে বললাম, জ্বর হলে স্নান করতে বাধা কোথায়! বরং জ্বরের মধ্যে ঠান্ডা জল দিয়ে স্নান করলে জ্বর আরো তাড়াতাড়ি পালায়।

ঘন্টু মামা বললেন, কানের নিচে একটা লাগাবোনা। আমাকে শেখাচ্ছিস! জ্বর হোক আর যাই হোক এক্ষুনি আয়! না আসলে বাসা থেকে টেনে আনবো।

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘন্টু মামা কল কেটে দিলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে বেরুতে হলো। তবে আসন্ন দুর্যোগের কথা চিন্তা করে ঢোক গিললাম।

ঘন্টু মামা সবসময়ই ফ্যাশন সচেতন। এদিক দিয়ে ঘন্টু মামা আমাদেরও আইকন। ঘন্টু মামা আজ চকোলেট রঙের পাঞ্জাবি পড়েছেন। ক্লীন সেইভ, চুল পরিপাটী করে আছড়ানো। গা থেকে সুগন্ধী পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে। আমি বললাম, যা লাগছে না তোমায়! জয়াদি আজ নতুন করে আবার তোমার প্রেমে পড়ে যাবে।

ঘন্টু মামা আর আমি কথা বলতে বলতে জয়াদির বাসায় হাজির হলাম। দরজা খোলাই ছিলো। কষ্ট করে বেল টিপতে হলোনা। ঘন্টু মামা মোটা পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাঁকিয়ে বললেন, আসতে পারি।

ড্রয়িং রুমে কেউ ছিলোনা। ঘন্টু মামার গলার আওয়াজ পেয়ে পাশের রুম থেকে জয়াদি প্রায় দৌড়ে এলো। জয়াদিকে দেখে আমার টাসকি খাওয়ার জোগাড়। জয়াদি লালের মধ্যে কালো ডোরা কাটা শাড়ি পড়ে আছে। মুখমন্ডলে হালকা প্রসাধনী আর সদ্য স্নান সেরে আসা ভেজা চুলে জয়াদিকে একদম অপ্সরার মতো দেখাচ্ছে। জয়াদির চেহারা থেকে একটা স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য ঠিকরে পড়ছে।

বেশ খানিকক্ষন স্থির দাঁড়িয়ে থেকে ঘন্টু মামা বললেন, জয়া তুমি তো দিনকে দিন অসামাজিক হয়ে যাচ্ছো!

ঘন্টু মামার কথা শুনে জয়াদি আর আমি দুজনেই মারাত্বকভাবে বিষ্মিত। নিমন্ত্রন খেতে এসে এটা আবার কেমন কথা! এ কথায় জয়াদি কী রি-একশন দেখায় আমি ভাবিত হলাম। জয়াদি নিজের চেহারায় যথেষ্ট বিষ্ময় ফুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমি আবার কী করলাম!

ঘন্টু মামা বললেন, কতোক্ষণ হলো বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও ভেতরে আসতে বলোনি!

জয়াদি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, আসো আসো।

ঘরে ঢুকে ঘন্টু মামা চারদিক তাঁকিয়ে বললেন, কাকীমা কোথায়?

জয়াদি উত্তর দিলেন, মা রান্নাঘরে।

ঘন্টু মামা জয়াদির দিকে একদৃষ্টে খানিকক্ষণ তাঁকিয়ে রইলেন। আমার সামনে ঘন্টু মামা এভাবে তাঁকিয়ে আছেন দেখে জয়াদি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছেন। ঘন্টু মামা বললেন, তোমাকে আজ বেশ ভালো লাগছে। কপালে একটা ছোট্ট টিপ থাকলে আরেকটু ভালো লাগতো।

জয়াদি লজ্জ্বা পেয়ে বলল, কী শুরু করেছো? তোমরা বসো। আমি আসছি।

জয়াদি চলে যেতেই আমি ঘন্টু মামাকে বললাম, আমাকে না নিয়ে এলেই ভালো করতে। জয়াদি একান্তে তোমাকে নিমন্ত্রণ করেছেন।

ঘন্টু মামা বললেন, ধুর ব্যাটা হাঁদারাম। যদিও তুই আস্ত একটা আমড়া কাঠের ঢেঁকি তারপরও তোকে ছাড়া আমার চলেই না।

ঘন্টু মামা প্রকাশ্যে আমাকে অপমান করছে দেখে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমি চললাম। আর তোমার সাথে কোথাও যাবোনা।

আমি উঠতে যাবো এমন সময় জয়াদি ফিরে এলেন। জয়াদিকে দেখে ঘন্টু মামা বললেন, দেখো জয়া, মুন্না নাকি চলে যাবে!

জয়াদি আমার দিকে তাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কীরে কী হয়েছে? তুইও আজকাল ভাব দেখানো শুরু করেছিস নাকি!

আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। সত্যি কথা বললে জয়াদি ঘন্টু মামার ওপর চড়াও হবে। আমার সামনে ঘন্টু মামাকে নাস্তানুবাদ হতে দেখলে আমার খারাপ লাগবে তাই আমি মৃদু হাসি দিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম।

হঠাত ঘন্টু মামা জয়াদিকে বললেন, আজ কোন উপলক্ষ্য ছাড়াই হঠাত খাওয়ার নিমন্ত্রন যে?

জয়াদি বললেন, খাওয়ার জন্য কোন উপলক্ষ্যের দরকার আছে কী? আর তাছাড়া তোমার মতো খাদক মানুষের আবার উপলক্ষ্য কীসের!

ঘন্টু মামা হেসে বললেন, যদিও তুমি এইমাত্র আমাকে অপমান করলে তারপরও আমি গায়ে কিছু মাখলাম না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে হঠাত কেন খেতে বললে?

জয়াদি বললেন, আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই খেতে বলেছি। হেভ ইউ এনি প্রভলেম? ইফ ইউ হেভ এনি প্রবলেম প্লীজ এক্সপ্লেইন মী।

জয়াদির ইংরেজী শুনে ঘন্টু মামা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমাকে কতোদিন বলেছি ওসব ইংলিশ-ফিংলিশ সব আমার এন্টেনার ওপর দিয়ে যায়।

জয়াদি বললেন, ঠিক করেছি আজ তোমার সাথে ঝগড়া করবোনা। কাজেই আমার মেজাজটা বিগড়ে দিওনা প্লীজ।

ঘন্টু মামা বললেন, আবার ইংলিশ!

জয়াদি চরম বিরক্ত হয়ে বললেন, আরে বাবা প্লীজ, স্যরি এসব খুব সাধারন হয়ে গেছে।

এমন সময় জয়াদির বাবা ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ঘন্টু মামাকে দেখে তিনি বললেন, কীরে অকালকুষ্মান্ড তুই কখন এলি?

জয়াদির বাবা ঘন্টু মামাকে অকালকুষ্মান্ড বলায় আমার ভালো লাগলো। আমাকে অপদার্থ বলার মজা নিজে বুঝুক এবার! তবে সেই সাথে আরেকবার নিশ্চিত হলাম জয়াদি আর ঘন্টু মামার মিলনে যদি কেউ ভিলেন হয়ে দাঁড়ায় তবে একমাত্র তিনি জয়াদির বাবাই।

হবু শ্বশুর মশাইয়ের এমন সম্বোধন ঘন্টু মামা গায়ে খুব একটা মাখলেন বলে মনে হলোনা। তিনি দাঁত কেলিয়ে বললেন, কাকু কী কোথাও বেরোচ্ছেন?

জয়াদির বাবা অরুনোদয় বণিক পায়ে মুজো পড়তে পড়তে বললেন, পায়ে মুজো পড়ে কেউ নিশ্চয় বাড়িতে ঢেং ঢেং করে হেঁটে বেড়ায় না?

জয়াদির বাবা বেরিয়ে যেতেই ঘন্টু মামা বললেন, তোমার বাবা এতো খাটাশ কেন! উনার নাম অরুনোদয় না রেখে অরুনঅস্ত রাখা উচিত ছিলো।

আমি ভেবেছিলাম ঘন্টু মামার কথায় জয়াদি প্রবলভাবে আপত্তি জানাবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে জয়াদি একটা মিষ্টি হাসি দিলেন মাত্র।

ঘন্টু মামা আর জয়াদিকে একান্তে কথা বলার সুযোগ দিয়ে আমি পাশের ঘরে চলে গেলাম। অনেকক্ষণ পর জয়াদির মা আমাদের খেতে ডাকলেন। খেতে বসে ঘন্টু মামা বললেন, কাকিমা আপনারাও বসে পড়ুন।

ঝর্না কাকিমা থালা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, বাব্বা ঘন্টু তুই তো বেশ ভদ্রতা শিখে গেছিস!

“কাকিমা কথায় আছেনা, সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস।” বলেই ঘন্টু মামা জয়াদির দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হাসলো।
জয়াদি ভ্রু কুঁচকে ঘন্টু মামার মুচকি হাসিকে সোজা বাউন্ডারি সীমানা পার করে বললেন, বেশী বকোনা। খেতে শুরু করো।

ঘন্টু মামা ঘো ধরলেন, তোমরা না বসলে আমি খাবোনা। অগ্যতা জয়াদিকে আমাদের সাথে বসতে হলো।

টেবিল জুড়ে খাবার আর খাবার। হরেক রকম খাবারের গন্ধে পুরো ডাইনিং রুম মৌ মৌ করছে। খাবারের মাতাল করা গন্ধে আমি যতোটা উচ্ছ্বসিত, ঠিক ততোটাই উৎকণ্ঠিত ঘন্টু মামাকে নিয়ে। জয়াদি আমাদের প্রথমেই আমাদের পাতে নাজিরশাইল চালের ভাত তুলে দিলেন। সাদা ভাত অথচ কি সুন্দর গন্ধ। প্রথমেই বেগুন বড়া আর মুগডাল দিয়ে এক গ্রাস গলধঃকরন করলাম। জয়াদি একেক আইটেম তুলে দিচ্ছেন আর আমরা তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছি। এখন পর্যন্ত ঘন্টু মামা সংযত আচরণ করছেন। দাঁত দিয়ে মাংস ছিড়তে ছিড়তে তিনি বললেন, আহ! কি অমৃত! কাকিমার হাতের রান্না এতো ভালো জানা ছিলোনা! কাকিমা এখন থেকে নিয়মিত খেতে ডাকবেন কিন্তু।

ঝর্না কাকিমা হেসে বললেন, এ কী আর রাঁধলাম! আমার স্পেশাল রান্নাগুলো তোদের আরেকদিন রেঁধে খাওয়াবো।

ঘন্টু মামার উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। মহিলাদের রূপ আর রান্নার প্রশংসা করলে তারা একেবারে গলে গলে পড়ে। এবার ঘন্টু মামা যতো বেশীই খাননা কেন ঝর্না কাকিমা কিছু মনে তো করবেনই না উলটো গর্ব করে বলে বেড়াবেন, আমি এমন রান্না করেছিলাম যে ঘন্টু কবজি ডুবিয়ে খেয়েছে!

জয়াদি খাসির রেজালা ঘন্টু মামার পাতে তুলে দিতেই ঘন্টু মামা বলে উঠলেন, কী শুরু করেছো! এতো খেলে চলবে কীভাবে?

জয়াদি আমার দিকে তাঁকিয়ে বললেন, এ কীরে মুন্না! এ দেখি ভুতের মুখে রাম নাম!

ঘন্টু মামা গায়ে কিছু না মেখে বললেন, খেতে আমি ভালোবাসি ঠিক, তাই বলে আমাকে রাক্ষস ভেবোনা।

পাশ থেকে জয়াদির মা বললেন, এই জয়া তুই কী শুরু করেছিস! ছেলেটাকে ইচ্ছে মতো খেতে দে।

জয়াদি বললেন, খাও ঘন্টু সোনা খাও।

শনিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৫

চন্দ্রবিজয়ী তিন নভোচারীর ঢাকা ভ্রমণ

ষাট দশকের শেষার্ধ, তখন সময়টা এমন ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানীদের জীবনে খুব কম সময়ই উৎসবের উপলক্ষ্য আসতোসব সময় এক আতংকে সময় কাটতো সবার, এই বুঝি পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের অধিকার, আমাদের দাবী ছিনিয়ে নিয়ে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দিবে আমাদের মুখতারপরও এ সময় কিছু ব্যাপার এদেশবাসীর উৎসবের উপলক্ষ্য নিয়ে এসেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চন্দ্র বিজয়ী তিন নভোচারীর স্বস্ত্রীক ঢাকা ভ্রমণ

নভোচারীত্রয় বিশ্বভ্রমনের ১৭ টি দেশের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন
১৯৬৯ সালের ২৭শে অক্টোবর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা নগরী এক উৎসবমুখর বেশ ধারন করেসারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষের ঢল নামে ঢাকায়তৎকালীন কুর্মিটোলা বিমান বন্দর ও ঢাকায় প্রবেশের মুল রাস্তায় প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটেরাস্তার দু-পাশে নারী-পুরুষ, ছেলে, বুড়ো সমানে ভিড় করতে থাকে

দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের সময় মার্কিন বিশেষ বিমানটি এ্যাপোলো-১১ মিশনের নভোচারী ও চন্দ্রবিজয়ী বীর নেইল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স এবং তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে যখন বিমান বন্দরে অবতরণ করেন,তখন প্রতিরক্ষা বাহিনীর আবেষ্টনী ভেদ করে জনতা বিমানের দিকে দৌড়াতে শুরু করেতিন চন্দ্র বিজয়ী ও তাঁদের স্ত্রীরা বিমান থেকে বেরিয়ে আসলে জনতা তুমুল ও মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে তাঁদের অভিনন্দন জানায়নভোচারীরাও হাত তুলে এ অভিবাদনের জবাব দেনবিমান বন্দরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রঙীন পোষাক পরিধান করে তাঁদের ফুলের তোড়া দ্বারা বরণ করে নেয়বিমান বন্দরে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বহু সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেনপূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বহু মার্কিন নাগরিকও বিমান বন্দরে এসে উপস্থিত হন

বিমান বন্দরটিকে নভোচারীদের ছবি ও প্রতিকৃ্তি এবং পাকিস্তান ও মার্কিন পতাকায় সুসজ্জিত করা হয়একটি বিরাট ব্যানারে লেখা ছিল, “আপনাদের এ সাফল্যে সমগ্র মানবজাতি গৌরবান্বিতবিমান বন্দর হতে একখানা খোলা সেভ্রোলেট গাড়ীতে নভোচারীত্রয় এবং অপর একখানা গাড়ীতে মিসেস কলিন্স ও মিসেস অলড্রিনকে নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে শহরের প্রায় নমাইল রাস্তা পরিভ্রমণ করা হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছেলেরা ঢোল বাজিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানায়কেউ ফুলের তোড়া, কেউ ফুলের পাপড়ি, কেউবা অভিনন্দন লিখিত শব্দমালা চলন্ত গাড়ীর প্রতি নিক্ষেপ করে তাঁদের অভিনন্দন জানায়

দীর্ঘ শোভাযাত্রা শেষে অতিথীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন) পৌছেনসেখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা ভাষণ দেনগভীর আনন্দের সহিত তাঁরা সাংবাদিকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেনমহাশূন্যচারীদের আগমন উপলক্ষে তাঁদের চাঁদে অবতরণ এবং পরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়এ সময় নভোচারীদের স্ত্রীরাও স্থানীয় বিশিষ্ট মহিলা ও মহিলা সাংবাদিকদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন

ঢাকা টেলিভিশন (বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশন) সাধারনত সোমাবার বন্ধ থাকলেও এদিন মহাশূন্যচারীদের আগমনের দৃশ্য সরাসরি প্রচারের জন্য বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করেবিকেলে পূর্ব পাকিস্তান সরকার নভোচারীদের এক সম্বর্ধনা ও প্রীতিভোজের আয়োজন করেগভর্ণমেন্ট হাউসে ৬জন বিউগল বাদকের নিনাদের মধ্য দিয়ে মহাশূন্যচারীদের আগমনীবার্তা ঘোষনা করা হয়অনুষ্টানে উপ-মহাদেশের ঐতিহ্যবাহী জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীবৃন্দ ছাড়াও শ্রমিক ও ছাত্রনেতৃবৃন্দও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন

উক্ত অনুষ্ঠানে মহাশূণ্যচারীগণ তৎকালীন গভর্নর জনাব আহসানের সাথে উপহার ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেনজনাব আহসান এ অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানেরও প্রতিনিধিত্ব করেনঅনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথে অন্যতম আকর্ষন ছিল এ্যাপোলো-১১ রকেটের মডেল সন্নিবেশিত বিরাটকার একটি কেকচন্দ্রবিজয়ী নভোচারী ও তাঁদের স্ত্রীদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে গভর্ণর আহসান বলেন, “এ বিরাট সাফল্য বিজ্ঞান ও কারিগরী বিজ্ঞানের বিজয় এবং একটি মহান সমাজের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বিপুল আকারে মানবিক ও বৈষয়িক সম্পদের সমুন্নয় সাধনেরই ফলশ্রুতিগভর্ণর পূর্ব পাকিস্তান ভূগোল সমিতির পক্ষ হতে মহাশূণ্যচারীদের একটি স্বর্ণপদক প্রদান করেনপৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রদানদের বাণী সম্বলিত যে ফলকটি মহাশূণ্যচারীগণ চন্দ্রতরীতে করে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার একটি রেপ্লিকা তারা গভর্ণরের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে উপহার দেনপাকিস্তানের জনগণের জন্য ফেলে আসা ফলকের একটি প্রতিকৃতিও তারা আহসানের নিকট প্রদান করেন

মাত্র একুশ ঘন্টা ঢাকায় অবস্থানের পর চন্দ্রমানবরা পরদিন মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটায় তাঁদের বিশেষ বিমানযোগে ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগ করেনবিমান বন্দরে বহু লোকজন ও সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ তাঁদের বিদায় অভিবাদন জানান সময় অনেকের চোখের কোণে জলের চিলিক দেখা যায়স্বল্পসময়েই তারা এদেশের জনগণের হৃদয়ের মণি কোঠায় স্থান করে নেন

তথ্যসূত্র; এই পোষ্টটি তৈরী করতে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত গাজীউর রহমান লিখিত রকেট ও চন্দ্র বিজয়ের ইতিকথানামক তথ্যবহুল বইয়ের যথেষ্ট সাহায্য নেয়া হয়েছেউইকিপিডিয়ারও কিছু সাহায্য নেয়া হয়েছেআর গুগলে অনেক খুঁজাখুঁজি করেও নভোচারীদের ঢাকা ভ্রমনের ভালো কোন ছবি পাইনি!

সোমবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৫

ঘন্টু মামা (পর্ব-৫)

গড়ের মাঠ বলতে যা বুঝায় আমাদের পকেট এখন ঠিক তাই। বাসায় ফেরার ভাড়া পর্যন্ত পকেটে নেই। রাগে আমার গা রি রি করছে। ঘন্টু মামাকে পেছনে ফেলে আমি আগে আগে হাঁটছি। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ঘন্টু মামার সাথে এখনও একটা কথা বলিনি। চুপচাপ অনেকটা হাঁটার পর ঘন্টু মামা আমার প্রায় কাছাকাছি এসে বললেন, তুই কী মৌনব্রত পালন করছিস নাকি?

আমি কোনরকম উত্তর দিলাম না। ঘন্টু মামা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে বললেন, রাগ করিস না মুন্না। বললাম তো বাসায় ফিরে তোর টাকা দিয়ে দেব। আচ্ছা পাঁচশর সাথে আরো পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে দেব। এবার খুশী তো?

আমি চোখ বড় করে ঘন্টু মামার দিকে তাঁকালাম। ঘন্টু মামা দুষ্টুমির হাসি হেসে বললেন, মনে করিস না আবার তোকে ঘুষ দিচ্ছি

এবার আমি ঘন্টু মামার দিকে ফিরে বললাম, তোমার শরীর আসলে কীসের চামড়া দিয়ে তৈরী? এই অল্প সময়ের মধ্যে দুই-দুইবার অপমানিত হয়েও তোমার কোন ভাবান্তর নেই!

আমার কথা শুনে ঘন্টু মামা এমন হো হো করে হেসে উঠলেন যে পাশ দিয়ে যাওয়া কয়েকজন পথচারীও আমাদের দিকে তাঁকাতে বাধ্য হলো। এক গাল হেসে নিয়ে ঘন্টু মামা আমাকে বললেন, বুঝলি! জন্মের সময় আমার গায়ে মানুষের চামড়াই ছিল। তবে হলো কী, আমার মা মানে তোর দিদা একজন দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন মহিলা। আমার জন্মের পরপরই তিনি বুঝে নিয়েছিলেন তার এই ছেলের লজ্জা-শরম-অপমান
বোধ একটু কম হবে, তাই তিনি বুদ্ধি করে তখনই আমার গায়ে একটা গন্ডারের চামড়া সেলাই করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই সব লজ্জ্বা-শরম-অপমানবোধ আমার নেই বললেই চলে।

ঘন্টু মামার এহেন কথা শুনে আমার ভীষন হাসি পাচ্ছিলো। একটা লোক কী নির্দ্বিধায় বকে যাচ্ছে! আমি চেহারায় যথেষ্ট কাঠিন্য ফুটিয়ে বললাম, রাখো তোমার বাজে কথা। এখন বাসায় ফিরবো কী করে সেটা বলো?

ঘন্টু মামা বললেন, এ আর চিন্তা কী! পায়ে হেঁটেই ফিরে যাবো।

আমি বললাম, পাগল! এখান থেকে বাসা কতোদূর হিসেব আছে! আমি এতোদূর হেঁটে যেতে পারবোনা।

হঠাত করে ঘন্টু মামা পায়ে ভর দিয়ে রাস্তায় বসে পড়লেন। আমি আশ্চর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার! বসে পড়লে যে?

ঘন্টু মামা তার নিজের কাঁধের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, হাঁটতে যখন পারবিনা তখন কী আর করা! তুই আমার কাঁধে চড়ে বস। আমি তোকে কাঁধে নিয়ে বাসায় ফিরবো।

আমি যারপরনাই বিষ্মিত হয়ে বললাম, পাগল হয়েছো। আচ্ছা কাইন্ডলী বলবে তোমার মাথায় এতো উদ্ভট চিন্তা আসে কীভাবে?

ঘন্টু মামা হেসে বলল, বুঝলি আমার এই মাথাটা হচ্ছে চিন্তা তৈরির কারখানা। উপস্থিত বুদ্ধিতে আমার জুড়ি মেলা ভার! ঐ যে ব্যাকরণের ভাষায় বলে না প্রত্যুতপন্নমতিতা!

আমি ব্যঙ্গ করে বললাম, প্রত্যুতপন্নমতি না ছাই! তোমার পাল্লায় যে পড়েছে তার অবস্থা একেবারে কেরোসিন হয়ে যাবে। এতো চেষ্টা করেও যে কেন তোমার সঙ্গ ছাড়তে পারিনা!

ঘন্টু মামা হেসে বলল, এটাই ঘনাচরণ সরকারের কারিশমা! একবার আমার সাথে যে সেঁটে গেছে সে আর আলগা হতে পারেনা।

ঘন্টু মামা কথা শেষ করার আগেই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। মোবাইল স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে ঘন্টু মামার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উৎফুল্ল হয়ে আমাকে বললেন, বলেছিলাম না যোগাযোগ ওকে করতেই হবে। ফোন রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে ভেসে এলো, ঘনাচরণ বাবু এখন ঠিক কোথায় আছেন?

ঘন্টু মামা বললেন, আপনার অফিস থেকে বেরিয়ে ডানদিকে দুই-আড়াইশো গজ এগুতে থাকুন। আমাদের পেয়ে যাবেন।

ওপর পাশ থেকে উত্তর এলো, একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।

কল কেটে দিতেই আমি ঈশারায় ঘন্টু মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে?

ঘন্টু মামা ভুবন জয়ের হাসি হেসে বললেন, মিস্টার বাঁধন এস চৌধুরী।

আমি বললাম, এই বাঁধন এস চৌধুরীটা আবার কে?

ঘন্টু মামা বললেন, এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি! এই একটু আগে যার অফিস থেকে এলাম।

আমি বিষ্মিত হয়ে বললাম, এখন আবার কী জন্য! একটু আগেই না দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো!

ঘন্টু মামা বললেন, যতোই তাড়িয়ে দিক না কেন, উনি যে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন তা আমি জানতাম। সে জন্যেই তো সময় কাটানোর জন্যে ইচ্ছে না থাকাও সত্ত্বেও এতো প্লেট বিরিয়ানী খেলাম। এ সব ঘনাচরণ সরকারের কারিশমা!

আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, হয়েছে হয়েছে আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবেনা। তোমার ব্যাপার-স্যাপার আমার ভালো ঠেকছে না। তুমি এই লোকটাকে শুধু শুধু এমন ব্ল্যাকমেইলিং করছো কেন?
ঘন্টু মামা রহস্যের হাসি হেসে বললেন, ধুর ধুর আমি কোন ব্ল্যাকমেইলিং করছি না। কেউ যদি নিজে থেকে ভয় পায় আমার কী করার আছে! আমি শুধু দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একটু ফায়দা হাসিল করতে চাইছি মাত্র।

আমি বললাম, না না এটা মোটেও ঠিক না।

ঠিক তখন মার্সিডিজ বেঞ্জের একটি কালো গাড়ি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘন্টু মামা গাড়ির গ্লাসে নিজের চুলকে একটু ঠিক করে নিলেন। গাড়ি থেকে বাঁধন এস চৌধুরী বেরিয়ে এলেন। ঘন্টু মামা হেসে বললেন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

বাঁধন চৌধুরী প্রথমেই বললেন, এবার কীসে স্পন্সর দরকার? কতো দরকার ঝটপট বলে ফেলুন?

ঘন্টু মামা বিস্তারিত বলতেই বাঁধন চৌধুরী ঘন্টু মামাকে বললেন, আমার পি.এস আগামীকাল আপনার কাছে চেক পৌছে দেবে।

ঘন্টু মামা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক আছে।

বাঁধন এস চৌধুরী গাড়িতে উঠতে যাবেন তখন ঘন্টু মামা বললেন, আপনার কাছে খুচরো দুশো টাকা হবে। আমার কাছে একটা এক হাজার টাকার নোট; কোথাও ভাংতি পাচ্ছিনা।

বাঁধন চৌধুরী ভ্রু কুঁচকে নিজের ওয়ালেট চেক করে বললেন, স্যরি আমার কাছেও খুচরো টাকা নেই।

গাড়িটি চলে যেতেই ঘন্টু মামা বাঁধন এস চৌধুরীর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগলেন। তারপর কী ভেবে আমাকে বললেন, আজকাল কী সব মোবাইল ব্যাংকিং-ট্যাংকিং বেরিয়েছে না? আমরা তো আমাদের মোবাইলে টাকা আনাতে পারি।

আমি বললাম, তা পারি। কিন্তু মোবাইলে আগে একাউন্ট খুলতে হয়। আমার কোন একাউন্ট নেই। তোমার থাকলে আনাতে পারো।

ঘন্টু মামা নিজের চুল টানতে টানতে বলল, আমার একাউন্ট আসবে কোত্থেকে! তুইও কি করিস! একটা একাউন্ট খুলে রাখতে পারিস না? তোর একাউন্ট থাকলে তো জয়াকে বলে কিছু টাকা আনতে পারতাম।

আমি বললাম, জয়াদি দেবে টাকা! জয়াদি সাফ বলে দিয়েছে তোমাকে আর কোন টাকা দেবেনা। তুমি আজ পর্যন্ত কতো টাকা ধার এনেছো মনে আছে? একটা টাকা ফেরত দিয়েছো?

ঘন্টু মামা বললেন, ধার করলেই ফেরত দিতে হবে এমন কোন কথা আছে নাকি? তাছাড়া জয়ার টাকা মানে তো আমার টাকা তাইনা?

আমি বললাম, এমনভাবে বলছো যেন তুমি নিজে রুজি করে ওর কাছে টাকা জমা রেখেছো!

ঘন্টু মামা চিন্তিত মুখে বললেন, “বাদ দে ও কথা। এখন কী করি বল তো। দুপুরে খেলে আমার শরীরে এমনিতেই আলসেমী চলে আসে। আর ভরদুপুরে এই রোদে এতো রাস্তা হেঁটে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।” কথা শেষ করেই ঘন্টু মামা একটা অটোকে ঈশারায় থামতে বললেন। আমরা দুজন অটোতে উঠে বসলাম কিন্তু এখনও জানিনা অটো ভাড়া কোত্থেকে আসবে!

রবিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৫

ঘন্টু মামা (পর্ব-৪)

রেস্টুরেন্টের ওয়েটার হা করে ঘন্টু মামার খাওয়া দেখছে। তার অবাক চাহনীতে এটা স্পষ্ট যে এরকম খাদক মানুষ সে আগে কখনো দেখেনি। অবশ্য আমার কাছে ব্যাপারটা একদম স্বাভাবিক কেননা নিয়মিত ঘন্টু মামার এমন ভুড়িভোজ দেখে আমি অভ্যস্ত।

ঘন্টু মামার শরীর এমন দশাসই কিছু না যে তার এতো খাবার খেতে হবে! এছাড়া তিনি এমন কোন পরিশ্রমী কাজও করেন না যাতে শরীর থেকে প্রচুর ক্যালরি ক্ষয় হয়! তাহলে এতো খাদ্যের চাহিদা তার আসে কোথা থেকে!

পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চির ঘন্টু মামা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। মাত্র আধা ইঞ্চির জন্য পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি না হতে পারায় ঘন্টু মামাকে প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতে শুনি, ভগবানটা বড় কিপটে! আধা ইঞ্চির জন্য কেউ কাউকে এভাবে আটকে রাখে!

ঘন্টু মামা শরীরের প্রতি কোনকালেই সচেতন ছিলেন না। জয়াদির সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর কয়েকদিন জিম করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু জিমের পরিশ্রম তার সহ্য হয়নি। একদিন একটা ভারী ডাম্বেল তুলতে গিয়ে কোমড়ের হাড়ে মোচড় খেয়ে সাতদিন বেড রেস্টে থাকতে হয়েছিল। সেই থেকে ঘন্টু মামা আর জিমের দিকে পা বাড়াননি।

ঘন্টু মামার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। চুলগুলো কোকড়ানো। ইদানীং মাথার মাঝখানে চুল একটু হালকা হয়ে এসেছে। চুল হালকা হওয়ার লক্ষন দেখে আমরা তাঁকে প্রায়ই খেপাই। কিন্তু ঘন্টু মামা থুড়ি মেরে আমাদের উড়িয়ে দিয়ে বলেন, আমার চৌদ্দগোষ্ঠীতে কারো টাক নেই। কাজেই তোরা যতোই নাচানাচি করিস না কেন আমার মাথায় টাক পড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।

পাঁচ নম্বর প্লেট শেষ করে ঘন্টু মামা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ওয়েটারকে কাছে ডাকলেন। তারপর তাঁকে বললেন, কেউ খাওয়ার সময় তার দিকে এভাবে তাঁকিয়ে থাকতে নেই। শোন, আজ যদি আমার পেট ব্যাথা করে তাহলে কাল এসে কড়ায়-গন্ডায় শোধ তুলবো।

ওয়েটারকে খানিকটা অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। ঘন্টু মামা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুই দেখি এক প্লেটই শেষ করতে পারলিনা!

ঘন্টু মামা পাশ ফিরে দেখলেন ওয়েটার তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি বললেন, কি হে এখনও স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো! যাও একটা কোক নিয়ে এসো। আর মনে করে বত্রিশ জর্দা দিয়ে একটা কড়া পান আনবে।

ওয়েটার কোকের বোতল আর পান ঘন্টু মামার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আর কিছু লাগবে স্যার?

ঘন্টু মামা হাঁফ ছেড়ে বললেন, যাক বাবা! তুমি তাহলে কথাও বলতে পারো। আমি তো ভেবেছিলাম বোবা। এবার দয়া করে বিলটা নিয়ে এসো।

ওয়েটার বিল হাতে দিতেই ঘন্টু মামার চোখ কপালে উঠলো। তিনি আঁতকে উঠে বললেন, এ যে দেখি দিনে-দুপুরে ডাকাতি! এতো টাকা বিল কীভাবে হয়?

ওয়েটার বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো, স্যার ছয়টা কাচ্চি বিরিয়ানী, দুই বোতল মিনারেল ওয়াটার, একটা হাফ লিটার কোক, একটা পান আর পনের শতাংশ ভ্যাট মিলিয়ে মোট সতেরশো সাত টাকা পঞ্চান্ন পয়সা।

ঘন্টু মামা রেগে গিয়ে বললেন, বললেই হলো! অন্য জায়গায় এর চেয়ে অনেক কম দামে খেতে পারতাম।

ওয়েটার মৃদু হেসে বললো, বেশী দূর যাওয়ার দরকার নেই স্যার। রাস্তার ওপাশে গেলেই এর চেয়ে অনেক কম দামে খাবার পাবেন।

ঘন্টু মামা বললেন, ইয়ার্কি মারছো? ডাক দাও তোমার মালিককে।

ওয়েটার মাথা চুলকে বলল, আমাদের মালিকের কী এই একটা বিজনেস! উনি অন্য জায়গায় ব্যস্ত আছেন। আপনি ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে পারেন।

ঘন্টু মামা উচ্চ স্বরেই বললেন, ডাক দাও তোমাদের ম্যানেজারকে।
ঘন্টু মামার উচ্চস্বরে কথা শুনে অন্যান্য টেবিলের মানুষগুলোও আমাদের দিকে বারবার তাঁকাচ্ছে। ঘন্টু মামার এহেন আচরণে আমার অস্বস্তি লাগছে। ওয়েটার চলে যেতে আমি ঘন্টু মামাকে বললাম, এখানে খাবারের এরকমই দাম। দেখছো না পুরো রেস্টুরেন্টে এসি লাগানো।

ঘন্টু মামা এবার আমার ওপর ক্ষেপে গেলেন। “এসি লাগানো তো কী হয়েছে? আমি কি ঠান্ডা হাওয়া খেতে এসেছি!”

খানিক পর ম্যানেজার এসে ঘন্টু মামাকে বললেন, আপনার সমস্যাটা কী জানতে পারি?

ঘন্টু মামা বললেন, সমস্যার শেষ আছে নাকি! আপনারা এখানে ব্যবসা করতে বসেছেন নাকি ডাকাতি করতে বসেছেন?

ম্যানেজার যথেষ্ট বিনয় করেই বললেন, দেখুন এখানে যারা খেতে আসে তারা খাবারের বেশী দাম জেনেই আসে। আমরা কাউকে জোর করে আসতে বলিনা। আপনার যতো বিল হয়েছে তা সব পরিশোধ করতে হবে। বিল পরিশোধ না করে যেতে দেওয়া হবেনা।

ঘন্টু মামার গলা একটু মিইয়ে আসলো। তার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছায়া দেখতে পেলাম। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে ম্যানেজারকে বললেন, আপনি যান। আমি আসছি।

আমি এতোক্ষণ চুপচাপ ঘন্টু মামার কান্ড-কারখানা দেখছিলাম। ম্যানেজার চলে যেতেই ঘন্টু মামা আমাকে বললেন, সব টাকা না দিলে শালারা ছাড়বে বলে মনে হয়না! কিন্তু এখন কি করি?

আমি বললাম, কী আর করবে? বিল পরিশোধ করবে।

ঘন্টু মামা বললেন, আমার কাছে বারোশো টাকার মতো। বাকি টাকা পাবো কোথায়! তোর কাছে কিছু টাকা ধার হবে?

আমি বললাম, আমার কাছে পাঁচশো টাকা আছে। বাবা পুরো সপ্তাহের মধ্যে আর একটি টাকাও দেবেনা। আমি এই টাকা দিতে পারবোনা।

ঘন্টু মামা মিনতির সুরে বললেন, এমন করিস না মুন্না। এই বিপদে এমন করতে নেই। আমি বাসায় গিয়ে তোর টাকা ফেরত দিয়ে দেবো। তাছাড়া খাবার তো আমি একা খাইনি। তুই ও তো খেয়েছিস তাইনা?

আমি পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে বললাম, আমি খেয়েছি বটে। তবে রাক্ষসের মতো পাঁচ প্লেট খাইনি। এই নাও টাকা। বাসায় গিয়ে আমার টাকা যেন ঠিকঠাক ফেরত পাই।

শেষপর্যন্ত সাত টাকা পঞ্চান্ন পয়সা কম বিল দিয়ে আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। এসির ঠান্ডা বাতাস থেকে গরমে বের হয়েও বড্ড আরাম লাগছিল। বাব্বা! খেতে ঢুকেছিলাম না যুদ্ধ করতে ঢুকেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ঘন্টু মামার শুভ বুদ্ধির উদয় না ঘটলে আজ নিশ্চিত গনধোলাই খেয়ে ফিরতে হতো। না ঘন্টু মামার সঙ্গ আমাকে ছাড়তেই হবে। তা না হলে কবে কোথায় কোন বিপদে যে পড়বো!

ঘন্টু মামা (পর্ব-৩)

রিসিপশনের মেয়েটি খটমট করে আমাদের দিকে তাঁকাচ্ছে। মেয়েটির চাহনীতে স্পষ্টত বিরক্তি। কিন্তু ঘন্টু মামার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি পা নাড়ানো ও পান চিবুনো দুটোই সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি ঈশারা করেও তাঁকে থামাতে পারিনি। অনেকক্ষণ পান চিবোনোর পর এদিক-ওদিক তাঁকিয়ে বললেন, ধুস! এতো বড় অফিস, সব আছে অথচ পানের পিক ফেলার কিছু নেই! মানুষগুলোর কমনসেন্স নেই বললেই চলে!

আমি ফিসফিস করে বললাম, কমনসেন্স তো নেই তোমার। এতো বড় অফিসে এসে কেউ এভাবে জাবর কাটে! তোমাকে নিয়ে আর পারা গেলোনা। ওপাশে বোধহয় ওয়াশরুম আছে। যাও পিক ফেলে মুখ ধুয়ে এসো।

ঘন্টু মামা উৎসাহ নিয়ে বললেন, কী যে বলিস! পিক ফেললে পানের মজা আছে?

আমি রেগে বললাম, “তাহলে আর কী করবে! গিলেই ফেলো।”

রিসিপশনের মেয়েটি ঠোঁটে কাঠহাসি ফুটিয়ে ভেতরে যাওয়ার ইঙ্গিত করতেই আমরা উঠে দাঁড়ালাম। ঠিক তখনই ঘটলো বিপত্তি। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে ঘন্টু মামার পা লেগে একটা বড় ফ্লাওয়ার ভাস মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে গেলো। ভাঙ্গার শব্দে পাশের রুম থেকে দু-জন ছুটে এলো। আমি আর ঘন্টু মামা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘন্টু মামা আমতা আমতা করে বললেন, স্যরি। আমি দেখতে পাইনি।

একজন মোটামতো লোক ঘন্টু মামার দিকে বিকটভাবে তাঁকিয়ে বলল, ইটস ওকে। কোথায় যাচ্ছিলেন, যান।

বিশাল রুম। চারদিকে দামী দামী আসবাব ছড়িয়ে আছে। সবগুলো জিনিসই চকচক করছে। একপাশের দেয়ালে বড় একটা পেইন্টিং। মেঝে এতোটাই স্বচ্ছ যে একটা ছোট্ট সুঁচ পড়লেও অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যাবে। একটা বড় চেয়ারে একজন সুদর্শন লোক বসে আছেন। লোকটির বয়স বড়জোর পঁয়ত্রিশের কোটায়। কিন্তু এর মধ্যেই যে তিনি নিজেকে ঘুচিয়ে নিয়ে ভালো একটা অবস্থানে আছেন তা উনাকে দেখেই অনুমান করা যায়। তিনি ঘন্টু মামার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, কী ব্যাপার ঘনাচরন বাবু? অনেকদিন পর দেখছি। হঠাত কী মনে করে বলুন তো?
ঘন্টু মামা একগাল হেসে বললেন, আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। তাই চলে এলাম।

লোকটি বললেন, আপনি মশাই নিজের স্বার্থ ছাড়া কোনদিকে এক পা বাড়ান না। এবার কীসে স্পন্সর করতে হবে! বলে ফেলুন চট করে।

ঘন্টু মামা হেসে বললেন, এজন্যই আপনাকে আমার এতো পছন্দ।

লোকটি বললেন, পছন্দ করে কী করবেন! আমার বারোটা বাজানোই তো আপনার কাজ। এইতো এসেই এতো দামী একটা ফ্লাওয়ার ভাস ভেঙ্গে ফেললেন! আচ্ছা বলুন তো আপনি এতো দুর্ঘটনা প্রবন কেন?

ঘন্টু মামা লজ্জ্বিত হয়ে বললেন, কী করবো বলুন। ইচ্ছে করে তো দুর্ঘটনা ঘটাতে চাইনা। তো যে কাজে এসেছিলাম....

লোকটি ঘন্টু মামাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এসব কাজ-টাজ পরে হবে। আগের বারের কথা আমি ভুলিনি। আমি এখন খুব ব্যস্ত। চা দিতে বলছি, খেয়ে বিদেয় হোন।

লোকটির কথায় আমি অপমানিতবোধ করছি। ঘন্টু মামার মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছেনা। তিনি মুখে হাসি ঝুলিয়েই বললেন, কী যে বলেন! এক কাপ চা খাওয়ার জন্য এতো টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে এখানে এসেছি নাকি! মান্নানের পাঁচ টাকা দামের চায়ের চেয়ে ভালো চা কী আপনার এখানে বানায়?

লোকটি বললেন, বাজে কথা রাখুন। আপনার কোন কাজে আসতে পারলাম না বলে দুঃখিত। প্লীজ আসুন।

ঘন্টু মামা রহস্যের হাসি হেসে বললেন, যেতে বললে আর কী যাওয়া যায়! আমার হাতে আপনাকে বধ করার একটা গোপন অস্ত্র আছে নিশ্চয় ভুলে যাননি?

লোকটিকে খানিকটা অপ্রস্তুত দেখালো তবে যথাসমভব গাম্ভীর্য্য বজায় রেখে বললেন, এই একটা ইস্যু নিয়ে আর কতোকাল ব্ল্যাকমেইল করবেন। এবার নতুন কিছু ভাবুন। এসব আমার কোন মাথাব্যাথা নেই।

ঘন্টু মামা মাথা চুলকে বললেন, ঠিক বলছেন তো?

লোকটি বললেন, সবকিছুর লিমিট আছে। আপনি নিজের সীমা অতিক্রম করছেন। আমি আপনার কোন বিষয়ে স্পন্সর করতে পারবোনা। গতবার আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। টাকা গাছে ধরেনা। অনেক কষ্ট করে রোজগার করতে হয়।

ঘন্টু মামা বললেন, কী করবো বলুন! গতবার কমিটির মধ্যেই একটা গন্ডগোল ছিল। এবার কোন সমস্যা হবেনা। আপনার প্রচারনা ঠিকমতো হবে।

লোকটি বললেন, আমার কোন প্রচারনা চাইনা। দয়া করে আপনি আসুন।

ঘন্টু মামা উঠে দাঁড়ালেন। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার পেছন ফিরলেন। লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সত্যি যাচ্ছি।

লোকটি ঘন্টু মামার কথাকে কোন পাত্তা না দিয়ে ফাইলে মনোযোগ দিলেন। ঘন্টু মামা আর আমি বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে আসার সময় রিসিপশনের মেয়েটি এমনভাবে আমাদের দিকে তাঁকাচ্ছিল যেন পারলে গিলে খায় আর কি!

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমি ঘন্টু মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, এ কী গো! তুমি যে লোকটাকে রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল করছিলে? কী ব্যাপার বলো তো?

ঘন্টু মামা হেসে বললেন, সে অনেক কাহিনী। তোর জেনে কাজ নেই।

আমি বললাম, কিন্তু লোকটি তো কোন স্পন্সর করবেনা। এখন কী করবে? হাতে খুব একটা সময় নেই। শীঘ্রই টিম এন্ট্রি করতে হবে।

ঘন্টু মামা আবার রহস্যের হাসি হেসে বললেন, চিন্তা করিস না। কালকের মধ্যে দেখিস ঠিকই যোগাযোগ করবে। শোন, এদিকে কোন একটা দোকানে খুব ভালো বিরিয়ানী বিক্রি করেনা? এদিকে যখন এসেছি বিরিয়ানীটা খেয়েই যাই।

এই একটা ব্যাপারে ঘন্টু মামার কোন ক্লান্তি নেই। একটু আগেই যে পরিমাণ অপমানিত হয়ে এসেছেন তারপরও একজন মানুষ এতো নির্দ্বিধায় খাওয়ার কথা বলে কীভাবে! অপমান গিলে আমার পেট এমনিতেই ভরে গেছে তবুও ঘন্টু মামার পেছনে আমাকেও ছুটতে হলো।
Copyright © 2014 রিপন ঘোষের খেরোখাতা All Right Reserved
^
Blogger দ্বারা পরিচালিত.