মধ্যরাত। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত পৃথিবী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এক
স্টেশন থেকে আরেক স্টেশন ধরে ছুটছে রাতের ট্রেন। কখনোবা মাঠ, কখনোবা বনের
ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে হুইসেল বাজাতে বাজাতে। আর ট্রেনের যাত্রীরা সবাই
বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। একজনের মাথা আরেকজনের ঘাড়ে পড়ছে তো অপরজন আবার ঘুমের
মধ্যেই তা ঠেলে দিচ্ছে। সবাই যেন নিজের বেডরুমে আরামসে ঘুমাচ্ছে। শুধু আমার
চোখেই ঘুম আসছেনা।
ট্রেন যখন সিলেট স্টেশনে এসে থামল তখন শেষরাত। শীতের চাদরে ঢাকা
নিস্তব্ধ স্টেশন ক্ষনিকের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটু আগেও যারা গভীর ঘুমে
নিমগ্ন ছিল তারা সবাই জেগে উঠেছে। সবাই যার যার গন্তব্যস্থলে চলে যাচ্ছে।
রাস্তাঘাট ভীষন ফাঁকা থাকায় আমার একা একা যেতে ভয় করছিল। অনেকক্ষন রিকশার
অপেক্ষা করলাম,কিন্ত কোন রিকশা পেলাম না। একবার চিন্তা করলাম বাকি রাতটা
স্টেশনেই কাটিয়ে দেই। কিন্ত পরমূহুর্তেই চিন্তা করলাম এখানে ভালো মানুষ
থেকে খারাপ মানুষের সংখ্যাই বেশী, কাজেই এখানে থাকা উচিত হবেনা।
রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো যেন নিভু নিভু করছে। সোডিয়ামের আলোতে রাতের
সিলেটকে একেবারে অন্যরকম লাগছে! সোডিয়ামের হলুদ-সোনালী মেশানো আলো আর শেষ
রাতের কূয়াশার খেলায় সবকিছু এক অন্যরকম রূপ নিয়েছে! যদি ভয়ে রাস্তায় না
নামতাম তবে এ রকম দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হতাম! কয়েকদিন থেকে শীতটাও বেশ পড়েছে।
আজকে বরং একটু বেশীই পড়েছে।
রাতের রাস্তায় আমার সবচাইতে ভয় করে কুকুর। কেননা আমি যখন ক্লাশ ফোরে পড়ি
তখন একটি পাগলা কুকুর আমাকে কামড়ে দিয়েছিল। সেই থেকে আমি কুকুর হতে ১০০
হাত দূরত্ব বজায় রাখি। কথায় আছেনা যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। হাটতে
হাটতে যেই না কীনব্রীজের কাছে পৌছেছি অমনি একপাল কুকুর আমায় ঘিরে ধরল।
জনমানবহীন রাস্তায় নিজেকে ভীষন বিপন্ন বোধ করলাম। ঘেউ ঘেউ করে আমাকে আরো
ভয়ার্ত করে ফেলছিল। তাড়াতে চাইলে আরো বেশী ভয় দেখায়। তাদের মনোভাবে মনে
হচ্ছিল আমাকে দিয়েই তারা শেষরাতের ভোজন সারতে চায়! এমন অবস্থায় নিজের করনীয়
কি বুঝতে পারছিলাম না। কুকুর তাড়া করলে দৌড় দেওয়াও উচিত নয়। এতে ওরা আরো
ক্ষেপে যায়।
হঠাত কুকুরগুলোর হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে দেবদূতের মতো হাজির হলেন এক
জীর্ণশী্র্ণ বৃ্দ্ধ! পরনে একটি প্রিন্টের লুঙ্গী আর পাতলা গেঞ্জী। লুঙ্গীটি
ভীষন ময়লা এবং গেঞ্জীর বেশীর ভাগ ছেঁড়া। প্রচন্ড শীতে তিনি কাঁপছেন।
আশ্চর্য্যের বিষয় হলো এই যে তিনি কুকুরগুলোকে তাড়াতেই ওরা আর কোন
ডাকাডাকি না করে একপাশে সরে গেল। আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললাম, কি আশ্চর্য্য!
আপনি তাড়াতেই কুকুরগুলো সরে গেল?
তখন বৃ্দ্ধ লোকটি বললেন, সব প্রাণীই তার স্বজাতি্র মূল্যায়ন করে শুধুমাত্র মানুষই তার ব্যতিক্রম।
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম, কুকুর আপনার স্বজাতি!
বৃ্দ্ধ লোকটি প্রচন্ড শীতে কাঁপছেন যেন গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছেনা।
তারপরও গলায় যতটা সম্ভব দৃঢ়তা এনে বললেন, স্বজাতি নয়তো কি? ওরা রাস্তায়
থাকে, আমিও রাস্তায় থাকি। ওরা ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খায়, আমাকেও সময়
বিশেষে তাই করতে হয়। তাহলে আমার আর কুকুরের মধ্যে তফাতটা কি? বৃ্দ্ধের চোখ
জলে ভরে ওঠে।
আমি যেন আমার সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমার মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছেনা। কীইবা জবাব আছে এ ছিন্নমূল বৃ্দ্ধের প্রশ্নের?
প্রচন্ড শীতে বৃদ্ধের চামড়া যেন জীর্নশীর্ন দেহের সাথে আরো সেঠে গেছে।
আমার কাছে মনে হচ্ছিল এ রকম ঠান্ডায় গরম কাপড় না পরলে আজ রাতই হয়তো এ
বৃ্দ্ধের শেষ রাত হবে। আমি আমার জিন্সের জ্যাকেটটি তার দিকে এগিয়ে দিলাম।
তিনি যেন খানিকটা অবাক হলেন। আমি বললাম, আপনি শীতে কাঁপছেন,দয়া করে এটা
গায়ে দিন।
তিনি এটা নিতে নারাজ। বললেন, বাবা, আমি এটা নিতে পারব না। আমার ঘরবাড়ি
না থাকতে পারে, কাউকে দয়া করার সামর্থ্য আমার না থাকতে পারে, কিন্ত আমি
কারো প্রতি নির্দয় হতে পারব না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি নির্দয় হচ্ছেন কীভাবে?
তিনি বললেন, বাবা এগুলো আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। এ ঠান্ডা আমার কিছু করতে
পারবে না। কিন্ত আমি এ জ্যাকেটটা নিলে তোমার ঠান্ডা লাগবে, অসুখ হবে,
তোমার কষ্ট হবে। বৃ্দ্ধের চোখ ছলছল করে উঠে।
তিনি চোখ মুছতে মুছতে আবার বলেন, বাবা, আমি বৃদ্ধ মানুষ, আজ আছি তো কাল
নেই। এ সমাজ আমার কাছ থেকে আর কিছু চায় না। কিন্ত এ সমাজে তোমাদের মতো
যুবকদের অনেক প্রয়োজন।
এবার আমি আমার চোখের জল আটকে রাখতে পারিনা। শেষরাতে রাস্তায় কারো কাছ
থেকে এমন স্নেহ আমি কল্পনাই করতে পারিনি। বৃ্দ্ধ লোকটি নিজে মরতে রাজী আছেন
কিন্ত অন্যকে চোখের সামনে মরতে দিতে রাজী নন। কতটা নিস্বার্থ হলে পরে একজন
মানুষ এমন হতে পারে।অনেক কাকুতি মিনতি করে আমি তাকে জ্যাকেটটি পরিয়ে
দিলাম। বৃদ্ধের চোখে এই মাঘ মাসেও যেন শ্রাবনের অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে।
বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ব্রীজের ওপর দিয়ে নদী পার হচ্ছি, আর মন
বলছে এখন যদি এই ব্রীজটা ভেঙ্গে যেত তবে সোজা গিয়ে পড়তাম ওই সুরমার বুকে।
তাহলে আর দেখতে হতোনা এমন হৃদয় চুরমার করে দেওয়া দৃশ্য। হাটছি আর মনে পড়ছে
একটি প্রবাদ, গাছ সবাইকে ছায়া দেয়, এমনকি কাঠুরেকেও। আর বৃদ্ধরাই হচ্ছে
আমাদের এ গাছ। অথচ এ গাছে আমরা না দিচ্ছি পানি, না নিচ্ছি কোন যত্ন!!!!!!!!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা আমার লেখনীকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। দয়া করে অশালীন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।