Latest News:
রবিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৪
বেনাট
এ মাসের মধ্যেই অফিসের চূড়ান্ত বাজেট পেশ করতে হবে। তাই ছুটির দিনেও একগাদা ফাইলপত্র বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে উপুড় হয়ে হিসাব কষছিলাম। পাশের ঘরে একমাত্র মেয়ে ঝিনি হাই ভলিঊমে টম এন্ড জেরী দেখছে। উচ্চ শব্দের জন্য প্রায়ই মনোযোগ বিঘ্নিত হচ্ছিলো। হিসেবে তালগোল পাকিয়ে ফেলছিলাম।
এ ঘর থেকে হাঁক দিলাম, এই ঝিনি টিভি বন্ধ করবি নাকি ও ঘরে এসে তোর ঘাড় মটকাবো। কথাটা শুনেই পাশের ঘরে কচি কন্ঠের হাসির গাড়ি ছুটলো। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ঝিনি বললো, বাবা তুমি ভুত নাকি! বলেই হাসতে হাসতে পালালো। সেইসাথে টিভির শব্দও বন্ধ হয়ে গেলো।
একটা করে হিসাব কষছি আর এক্সেলের ওয়ার্কশীটে এন্ট্রি করছি। যেই না ওয়ার্কশীটে গুটিকয়েক ডাটা এন্ট্রি করেছি ওমনি বেলকনিতে কিছু একটার শব্দ হতেই বাইরে চোখ দিলাম। বিরক্তিভরে বেলকনিতে চোখ রাখতেই অবাক হলাম। খোলা বেলকনির দেয়ালে একটা বানর বসে আছে। ইট-পাথর-কংক্রিট এর যাঁতাকলে পিষ্ট এ শহরে এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলাম।
বানরটির গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল। বিভিন্ন রঙ্গের লোমে সমস্ত দেহ আবৃত। মুখের দিকে তাঁকালে মনে হয় কে যেন সমস্ত মুখমন্ডল আগুনে জ্বলসে দিয়েছে। পোড়া মুখের আড়ালে উজ্জ্বল মারবেল পাথরের মতো চকচক করছে দুটি মায়াবী নিষ্পাপ চোখ। এতোক্ষণে ঠাওর করতে পারলাম এটা ঠিক বানর নয়, কালোমুখী হনুমান। স্থানীয়ভাবে মুখপোড়া হনুমান নামেই বেশী পরিচিত। ছেলেবেলায় কোন দুষ্টুমি করলে মা মুখপোড়া হনুমান বলে বকা দিতেন। আজ সেই মুখপোড়া হনুমান আমার সামনে বসে আছে!
ঝিনি কখন যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমি বুঝতেই পারিনি। ঝিনি অবাক বিস্ময়ে হনুমানের দিকে তাঁকিয়ে আছে। সদ্য আটে পা দেয়া ঝিনি তার ফোকলা দাঁত বের করে যেভাবে তাঁকিয়ে আছে বোঝাই যাচ্ছে এই প্রথম ও এতো কাছ থেকে বানর জাতীয় কোন প্রাণি দেখতে পেয়েছে। শুধু ঝিনির কথাই বা বলি কেন! আমি নিজেও তো এই প্রথম এতো কাছ থেকে হনুমান দেখছি!
ঝিনি সামনে এগুতে চাইছিল। আমি এগুতে দিলাম না। আমার ভয় হচ্ছিলো হনুমানটি যদি ঝিনিকে খামচে দেয়। হনুমানটি হাত নেড়ে কিছু ঈশারা করছে। আমরা বাপ-মেয়ে একে-অপরের দিকে তাঁকালাম। কিন্তু কেউই হনুমানটির ঈশারার পাঠোদ্ধার করতে পারলাম না। ঝিনি বললো, বাবা, বানরটি মনে হয় কিছু খেতে চায়।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ঝিনি দৌড়ে ঘরে চলে গেল। ফিরে এলো হাতে একটা কলা নিয়ে। ঝিনি কলাটি ছুড়ে দিতেই হনুমানটি মেঝে থেকে কলা কুঁড়িয়ে নিলো। তারপর নিজে নিজেই খোসা ছাড়িয়ে খেতে লাগলো। খোসা ছাড়ানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতে সে খুব অভ্যস্ত। ঝিনি আর আমি অবাক হয়ে ওর কলা খাওয়া দেখছি।
ঝিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা বানরটার মুখ এত্তো কালো কেন? আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, এটা ঠিক বানর নয়। বানর প্রজাতির একটি প্রাণী হনুমান। এই জাতের হনুমানের মুখ এরকম কালো হয় তাই এদের কালোমুখী হনুমান নামে ডাকা হয়।
হনুমানের মুখের দিকে তাঁকিয়ে বুঝতে পারলাম খাবার পেয়ে সে ভীষণ খুশী হয়েছে। শিশুরা যে প্রাণীদের কথা বুঝতে পারে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আজ পেলাম। কলার শেষ অংশ মুখে পুরে হনুমানটি আড়মোড়া ভাঙ্গার মতো রাজকীয় ভঙ্গিতে একটা মোচড় দিলো। তারপর আমাদের দিকে বিদায় জানানোর মতো হাত নেড়ে পাশের বেল গাছে ঝাঁপ দিলো। ঝিনি তো বটেই আমিও ছোট বাচ্চাদের মতো অবাক ভঙ্গিতে হনুমানের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম। এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফাতে লাফাতে হনুমানটি একসময় চোখের আড়ালে চলে গেলো।
এরপর থেকে প্রায়ই হনুমানটিকে দেখা যেতে লাগলো। বেলকনিতে এসে লক্ষীটির মতো চুপচাপ বসে থাকে। কাউকে কোন উৎপাত করেনা। এরই মধ্যে ঝিনির সাথে হনুমানটির বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ঝিনি হনুমানটির একটা নামও দিয়েছে। নামটা বেশ অদ্ভুত! বেনাট।
আমি অবাক হয়ে ঝিনিকে জিজ্ঞেস করলাম, এমন অদ্ভুত নাম দিয়েছিস কেন মামনি? উত্তর যেন ওর ঠোটের মধ্যেই ঝুলানো ছিলো। সাথে সাথে উত্তর দিলো, হনুমানটা কলা আর বাদাম ছাড়া কিছুই খেতে চায়না। তাই বেনানার বে আর নাটের নাট নিয়ে ওর নাম দিয়েছি বেনাট। সুন্দর হয়েছে না বাবা?
ঝিনির সাংঘাতিক বুদ্ধির প্রমাণ পেয়ে আমি মনে মনে খুশী হলাম। তারপর মৃদু হেসে বললাম, বেশ সুন্দর হয়েছে মা।
ঝিনি প্রতিদিনই বেনাটকে বিভিন্ন রকম খাবার দেয়। বেনাটের জন্য বাজার থেকে বাদাম-কলা আনতে আমাকে বাধ্য করে। মাত্র কয়েক সপ্তাহে হনুমানটি আমাদের অনেক আপন হয়ে গেছে। আমার অসম্ভব বদমেজাজী স্ত্রীও হনুমান ওরফে বেনাটকে বেশ আপন করে নিয়েছে। হনুমানটির পরিচ্ছন্নতা ও আচার ভঙ্গিতে মনে হয় এটা কারো গৃহপালিত ও প্রশিক্ষিত। বন জঙ্গলের প্রাণী এতোটা ভদ্র হওয়ার কথা নয়। ঝিনি আর বেনাট মিলে সারাদিন খেলা করে। ঝিনি বেনাটকে ওর ছোট্ট ছোট্ট টপস আর জিন্স পড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে বেনাটের মাথায় পড়িয়ে দেয় ছোট্ট ক্যাপ। ক্যাপে বেনাটকে ভীষণ মানায়। ওকে নিয়ে ঝিনির এতো আহ্লাদ দেখে বেনাট যেন খানিকটা লজ্জ্বা পায়। মুখ আড়াল করে পালানোর চেষ্টা করে।
ঘরের ভেতর পর্যন্ত বেনাটের প্রবেশাধীকার বিস্তৃত হয়েছে। ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে ঝিনি আর বেনাট আয়েশ করে পোগো আর কার্টুন নেটওয়ার্কে মজে থাকে। কার্টুন আর এনিমেশন মুভি দেখে ওরা দুজনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। আমাদের তিনজনের এই ছোট্ট সংসারে বেনাট এক নতুন অতিথি হয়ে এসেছে। একদিন সাইকেল চালাতে গিয়ে ঝিনির পায়ের খানিকটা কেটে গিয়েছিলো। বেশ রক্তও গড়িয়ে পড়ছিলো। তা দেখে বেনাটের সে কী দৌড়ঝাঁপ! একটা বন্য প্রাণী কখন যে আমাদের এতোটা আপন হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি!
দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার। সকালবেলা ঝিনিকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলাম। রিকশার খোঁজ করতে করতে গলির মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। রাস্তার বাঁ-দিকে তাকাতে মানুষের জটলা চোখে পড়লো। জটলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি? লোকটি কোন উত্তর না দিয়ে সামনে এগুনোর রাস্তা ছেড়ে দিলো। লোকটির ছেড়ে দেয়া রাস্তা ধরে সামনে এগুতে দেখলাম মাটিতে বেনাট পড়ে আছে। বেনাটকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত কাছে এগিয়ে গেলাম। আমার পিছু পিছু ঝিনিও এগিয়ে এলো। পাশ থেকে একজন বললো, রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা মাইক্রোবাস বানরটিকে ধাক্কা দিয়েছে।
বেনাটের ঘাড় থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। অবিরাম রক্তক্ষরণে সে নিস্তেজ হয়ে গেছে। বেনাটকে এ অবস্থায় দেখে ঝিনির দু-চোখ জলে ভরে উঠলো। ঝিনি বেনাটকে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ঝিনিকে দেখে বেনাট দু-বার ঠোট নাড়লো। ও যেন কিছু বলতে চাইছে।
ঝিনি আমাকে বারবার তাগিদ দিলো, বাবা, বেনাটকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। আমি বেনাটকে কাছের পশু হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বললেন বেশ সিরিয়াস ইনজুরি তবে চিন্তার কিছু নেই। ডাক্তারের কথায় আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ঝিনিকে বুঝানো যাচ্ছিলোনা। ওকে যতো বলি বেনাটের কিছু হবেনা সে ততো জোরে জোরে কান্না শুরু করে। ডাক্তার প্রথমে ইনজেকশন দিলেন। তারপর ঘাড়ের ক্ষতস্থানটি পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন।
বেশ কিছুটা সময় পর বেনাট চোখ খুললো। তার চেহারার নিস্তেজ ভাব কাটতে শুরু করেছে। বেনাটকে চাইতে দেখে ঝিনির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে এক হাতে চোখের পানি মুচছে আরেক হাতে বেনাটের শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঝিনির হাতের কোমল স্পর্শে বেনাট পাশ ফিরে ঝিনির দিকে তাঁকিয়ে যেন মৃদু হাসলো। ঝিনিও একটা মৃদু হাসি দিলো। দুই বন্ধুর মধ্যে কি যেন গোপন কানাকানি হয়ে গেলো সবার অন্তরালে!
ধরন
গল্প,
রিপন ঘোষের গল্প
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
Copyright © 2014 রিপন ঘোষের খেরোখাতা All Right Reserved
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা আমার লেখনীকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। দয়া করে অশালীন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।