আমার মন যা চায় আমি তাই করবো। কে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসেনা! আমি
আমার মতো। আর দশটা মানুষের সাথে আমার যদি কোন পার্থক্যই না থাকে তাহলে আমার
নিজস্বতা থাকলো কোথায়! আমাকে আমার মতো থাকতে দাও প্লীজ। কথাগুলো বলেই
মৃদুলা কলটা কেটে দিল।
মৃদুলার ভীষণ রাগ হচ্ছে। সুযোগ পেলেই এই ছেলেটা তাকে নীতিশিক্ষা দিতে লেগে যায়। এটা ভালোনা, ওটা ভালোনা! এই করোনা, সেই করোনা, এটা করলে লোকে মন্দ বলবে, ওটা করলে ভালো বলবে। মৃদুলা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল এবার থেকে রাতুলের কাছ হতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলবে।
অনেকক্ষণ থেকেই বেশ কয়েকটি লাইন মৃদুলার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। গোল্ডলিফ সিগারেটের বাকি অংশটুকু একটানে ফুঁকে কড়া নিকোটিনের ধোঁয়া অন্ধকার বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে সে ল্যাপটপটা কোলে টেনে নিলো। কীবোর্ডে আঙ্গুল রাখতেই বুঝলো, এতোক্ষণ যে শব্দাবলী মাথায় কিলবিল করছিলো, তারা এখন উধাও হয়ে গেছে। আজকাল নিয়মিতই এই সমস্যাটা হচ্ছে। লিখতে বসলেই কিছু বেরুতে চায়না। নিকোটিনের প্রভাবে খানিকটা জট খুললেও নিমিষেই তা আবার তালগোল পাকিয়ে যায়। এই শিশির ভেজা হিমেল রাতে খানিকটা ভোদকা পেটে পড়লে শব্দেরা আবার হয়তো জেগে উঠতো! কিন্তু এতো রাতে ভোদকা! নো ওয়ে! ফ্রিজে কয়েকটা সফট ড্রিংকস আছে। এগুলো দিয়ে হালকা একটা ককটেল বানিয়ে খেলে মন্দ লাগতো না। কিন্তু এখানেও ছোট্ট একটা সমস্যা! ফ্রীজে একটাও আইস কিউব নেই। আইস কিউব না দিলে ফিলিংসটা ঠিক আসেনা।
মৃদুলা ভীষণ চিন্তিত, আজকাল শব্দেরা বারবার কেন অবরোধ ডাকছে! শব্দ-কবিতাহীন জীবন ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছে। নির্ঘুম রাতগুলো যেন ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে কবিতার বন্ধ্যাত্বতায়। ছবি আঁকতে গেলেও তুলি সামনের দিকে আগায় না। এ ক’দিন লিখতে বা আঁকতে না পারলেও বই পড়ে রাত কাটানো গেছে। কিন্তু আজ রাতে পড়ার মতো একটা কিছুও অবশিষ্ট নেই। এদিকে সকাল না হলে ঘুমও আসবেনা! ভোরের রক্তিম সূর্য্য প্রত্যক্ষ করে ঘুমাতে যাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। একদিন এর ব্যত্যয় ঘটলে অস্বাভাবিক লাগে!
একটি অলস নির্ঘুম রাত অপেক্ষা করছে ভাবতেই মৃদুলা দু চোখে অন্ধকার দেখলো। সে দু-চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো কি করলে এই অলস নির্ঘুম রাতের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে; ঠিক তখনই মোবাইলে রিং বেজে উঠলো। মৃদুলা মোবাইলের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে বিরক্ত হলো। সে বিরক্তি সহকারে কল রিসিভ করলো।
- হ্যালো!
- শুনছি বলো। তবে আগেই বলে নেই কোন উপদেশ-টোপদেশ শোনার মতো সময় আমার হাতে নেই।
- হা হা হা। আমি কি তোমাকে সব সময় উপদেশই দেই?
- তা নয়তো কি! সুযোগ পেলেই তো নীতিশিক্ষার বুলি আওড়াও।
- ও তাই বুঝি? আচ্ছা যাও এখন আর কোন নীতিশিক্ষা দেবোনা। খুশী তো?
- হু খুশী। একটু আগেই তো কথা বললাম। এখন আবার ফোন করেছো কেন?
- আগে রাগ করে কল কেটে দিলে তাই ভাবলাম দেখি রাগ পড়লো নাকি!
- আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। রাত অনেক হয়েছে। ঘুমোতে যাও।
- এতো রাত! তোমার জন্য তো সবে সন্ধ্যা হলো।
- সন্ধ্যা সে তো আমার জন্য। তুমি এখনও জেগে আছো কেন?
- তুমি রাগ করে মোবাইল রেখে দিলে, তাই আমার মন খারাপ হয়ে আছে। ঘুম আসছেনা।
- ঘুম না আসলে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাও।
- তোমার সাথে ভালো করে একটু কথা না বললে কোন ঔষধেই ঘুম আসবেনা।
- ও তাই বুঝি! দেখো কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো যথেষ্ট সময় আমার নেই। জানোই তো এই সময়টাতে আমি অন্য জগতে থাকি। এই সময়টা আমার ক্রিয়েটিভিটি প্রকাশের উপযুক্ত সময়। আমি অনেক এনালাইসিস করে দেখেছি এ সময়টাতে আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো একদম শার্প হয়ে ওঠে। আমার চিন্তার জগত অস্বাভাবিক রকমের বিস্তৃতি লাভ করে। আমি যা লিখতে চাই, তাই লিখতে পারি। যা আঁকতে চাই তা আঁকতে পারি।
- হু। আজ তাহলে কি লিখছো শুনি?
- জানো, আজ না কিছুই লিখতে পারছিনা। কিছু শব্দ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো, কিন্তু লিখতে বসেই সেগুলোকে হারিয়ে ফেলেছি। কি করি বলো তো?
- এটা স্বাভাবিক। প্রতিদিনই লিখতে পারবে এমন কোন কথা নেই। শব্দদেরও তো মাঝে মধ্যে বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।
- হু! তাহলে আজ রাত কাটবে কি করে বলো তো?
- আজ রাতে তুমি ছবি আঁকতে পারো।
- সে পারি। কিন্তু এতেও একটা সমস্যা। কি নিয়ে ছবি আঁকবো? আজ আমার মস্তিকের নিউরনগুলো আসলেই ধর্মঘট ডেকেছে। অনেকদিন নিজেকে এমন অসহায় লাগেনি।
- ভেবে দেখো। কিছু একটা পেয়ে যাবে।
- পেয়েছি
- কি?
- সাবজেক্ট!
- গুড। কি সাবজেক্ট ?
- আমার আজকের সাবজেক্ট তুমি।
- আমি!!!
- হ্যাঁ তুমি

- আমাকে নিয়ে কি ছবি আঁকবে?
- আমার অনেক দিনের শখ একটা ন্যুড পুরুষ দেহের ছবি আঁকবো।
- পাগল হয়েছো! একে তো আমার ছবি, তার ওপর ন্যুড। মাথা তোমার আসলেই গেছে!
- এই প্লীজ প্লীজ, না করোনা প্লীজ।
- আমাকে তোমার মতো পাগল পেয়েছো? লোকে কি বলবে?
- এই আগেই বলেছি লোকে কি বলবে তার দোহাই আমাকে দিও না।
- তাই বলে একটা মেয়ে আঁকবে নগ্ন পুরুষদেহ?
- তো কি হয়েছে? পুরুষ যদি নগ্ন নারীদেহের ছবি আঁকতে পারে আমি কেন নগ্ন পুরুষদেহ আঁকতে পারবোনা?
- ওকে আঁকো। তবে অন্য কাউকে মডেল হিসেবে বেছে নাও। আমি এসবের মধ্যে নেই।
- এমন নির্দয় হয়োনা প্লীজ। আমাকে একবার রাজা রবি ভার্মা হতে দাও প্লীজ।
- রাজা রবি ভার্মা! ইনি আবার কে?
- তুমি রাজা রবি ভার্মাকে চেনোনা! তাহলে এতো পড়াশোনা করলেটা কী!
- আমি পন্ডিত নই। আমার জানার সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে।
- হু। কিন্তু আমার কাছের একজন মানুষ হয়ে রবি ভার্মাকে না চেনা বিরাট একটা অপরাধ।
- আচ্ছা! জানিনা যখন বলেই দাও কে এই মহান ব্যক্তি যার নাম না জানা গুরুতর অপরাধ?
- রাজা রবি ভার্মা হচ্ছেন একজন বিখ্যাত ভারতীয় চিত্রকর। তাকে আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার আঁকা তেলচিত্রগুলো এখনও ভীষণ জনপ্রিয়। তিনি হিন্দু মাইথোলজি নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। রামায়ন, মহাভারত, পুরাণে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনাকে তিনি তার তুলির আঁচড়ে অতি বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করেছেন। শকুন্তলা, দ্রোপদী সহ অনেক পৌরাণিক চরিত্রকে অসাধারণ দক্ষতায় তিনি তার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার আরেকটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম হচ্ছে দেবী স্বরস্বতীর প্রতিকৃতি। হিন্দু পরিবারগুলোতে এখনও স্বরস্বতীর সবচেয়ে জনপ্রিয় যে ছবিটি দেখা যায় তা রাজা রবি ভার্মার আঁকা। ভাবতে পারো! একজন মানুষের সৃষ্ট চিত্রকর্মে প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ শ্রদ্ধাভরে প্রণাম জানাচ্ছে! এদিক বিবেচনা করলে তিনি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো, ভিনসেন্ট ভ্যান গগের মতো বিখ্যাত অনেক চিত্রকরদের পেছনে ফেলে দিয়েছেন! আর্থিক মূল্যায়নে এদের আঁকা ছবি মূল্যবান হলেও শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বিবেচনায় রাজা রবি ভার্মার আঁকা বেশ কয়েকটি ছবি তাদেরকে যোজন যোজন পেছনে ফেলে দিয়েছে।
- অসাধারণ! এরকম একজন ব্যক্তি সম্পর্কে না জানা আসলেই অন্যায়। তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি তিনি খুব ভালো ছবি আঁকতেন। তবে ওই যে বললে, রাজা রবি ভার্মার আঁকা স্বরস্বতী অবয়বের মতো আর কারো আঁকা ছবি ঘরে ঘরে দেখা যায়না, এতে একটু কথা আছে।
- কি কথা?
- এরকম আরো অনেক পেইন্টিং আছে যেগুলো মানুষের ঘরে ঘরে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন মোনালিসার কথাই ধরো। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এই চিত্রকর্মের অনেক অনেক কপি ছড়িয়ে আছে। বসার ঘরের বাহারী আসবাবের পাশে মোনালিসার একটি প্রতিকৃতি থাকেই। আমাদের এই বাংলাদেশেই শিক্ষিত শিল্পমনষ্ক মানুষের বসার ঘরের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ মোনালিসার অবয়ব।
- হুম শিক্ষিত শিল্পমনষ্ক! এখানেই আসল কথা, রাজা রবি ভার্মার কিছু চিত্রকর্ম শুধু একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষের কাছে আবদ্ধ নেই। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার কাছে এটা পৌছে গেছে।
- তা ঠিক। তবে দেবী চরিত্র বলেই এই ছবিটা বেশী পরিচিতি পেয়ে এসেছে। অন্যথায় এতোটা জনপ্রিয়তা পেতো বলে আমার মনে হয়না।
- হু তা ঠিক। ধর্মীয় পৌরাণিক চরিত্র বলেই এই চিত্রকর্মগুলো তুলনামূলক বেশী মর্যাদা পেয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে রাজা রবি ভার্মা প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। ছবি আঁকার সাবজেক্ট আর কনসেপ্ট সিলেকশন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রাজা রবি ভার্মা এ জায়গাতেই সবচেয়ে সফল। তিনি উপযুক্ত একটা বিষয় বেছে নিতে পেরেছিলেন। আর এ কারণেই তার চিত্রকর্মগুলো আরো অনেক অনেকদিন বেঁচে থাকবে। আরেকটা বিষয় জানো?
- না বললে জানবো কীভাবে?
- আমার জানায় ভুলও থাকতে পারে। কোন বিশ্বস্থ রেফারেন্সে এই তথ্য পাইনি।
- বলো দেখি।
- হিন্দু মাইথোলজীর বেশ কিছু চরিত্রে তিনি নাকি তার প্রিয়জনের মুখাবয়ব ও দেহসৌষ্ঠব ফুঁটিয়ে তুলেছেন।
- বাহ! বেশ তো!
- রবি ভার্মার সেই প্রিয়জনকে আমার খুব হিংসা হচ্ছে।
- হিংসা হচ্ছে কেন?
- ব্যাপারটা ভেবে দেখো, একজন মানুষ তার তুলির আঁচড়ে তার প্রিয়জনকে জগদ্বিখ্যাত করে গেছেন! যতোদিন তার চিত্রকর্ম বেঁচে থাকবে ততোদিন তার সেই প্রিয় মানুষটির মুখাবয়বও বেঁচে থাকবে।
- হুম। তোমার দূর্ভাগ্য আমি ছবি আঁকতে পারিনা! তা না হলে আমি একবার তোমার মুখাবয়ব আঁকার চেষ্টা করতাম।
- তুমি আঁকতে না পারো, আমি তো পারি। আমি তোমার এমন একটা প্রতিকৃতি আঁকতে চাই যা অনেকদিন পর্যন্ত লোকের কাছে সমাদৃত হবে। এতে করে তোমাকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি আমি আমার নিজেকেও স্মরণীয় করে যেতে পারবো।
- তাই বুঝি! সমাদৃত হওয়ার বদলে এই ছবি নিন্দা কুঁড়াবে।
- এমন করে বলছো কেন?
- তা নয়তো কি? নগ্ন পুরুষদেহকে কে প্রাতস্মরণীয় করে রাখবে?
- আজ হয়তো রাখবে না। কিন্তু আজ থেকে অনেক বছর পর মানুষ এর কদর বুঝলেও বুঝতে পারে। তবে তুমি যখন পুরো ন্যুড চাইছো না তাহলে হাফন্যুড একটা ছবি আঁকা যেতে পারে। এতে তোমার আপত্তি থাকার কথা নয়?
- তুমি থাকো তোমার উদ্ভট চিন্তাভাবনা নিয়ে। আমি এসবের মধ্যে নেই। বলির পাঁঠা বানাতে হয় অন্য কাউকে বানাও।
- আহা! এতো রাগ করেনা। তোমার মুখের আদল আমার খুব চেনা। আমি চাইলেই এঁকে ফেলতে পারি

- খবরদার ভুলেও এ কাজ করবেনা।
- আরে চিন্তা করোনা। তোমার অনুমতি ছাড়া আমি কিছু করবোনা

- পাগলামী রেখে শুয়ে পড়ো।
- এতো তাড়াতাড়ি! ইম্পসিবল!
- রাত প্রায় তিনটা বাজে!
- আমি ভুলেই গেছি শেষ কবে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছি! আমার মাথায় দারুন একটা আইডিয়া এসেছে।
- আবার কী উদ্ভট আইডিয়া এসেছে?
- ভোরের আলো ফুটতে এখনও অনেক বাকি আছে।
- তো কী হয়েছে?
- ঘরে বসে ভোরের আলো, প্রথম সূর্য্য অনেক দেখা হয়েছে। আজ শেষরাতের রাস্তার সৌন্দর্য্য দেখবো আর সুরমা পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখবো। তুমি এক্ষুনি রেডি হয়ে তোমার বাসার গেটের সামনে থাকো। আমি আসছি।
রাতুলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মৃদুলা ফোন রেখে দিলো। নাইটি পালটে
জিন্স আর একটা টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো। গেট থেকে বেরিয়েই বুঝতে
পারলো বাইরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। হাত শিরশির করছে। রাতুলের বাসা মৃদুলার বাসা
থেকে খুব একটা দূরে নয়। দুটো গলি পেরিয়ে রাতুলের বাসার সামনে পৌছে দেখলো
রাতুল তখনও বেরোয়নি। ভেতরের কলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে হালকা আলো উঁকি-ঝুকি
মারছে। মৃদুলা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে রাতুলকে ফোন দিতে যাবে ঠিক তখনই
বেলকনিতে রাতুলকে দেখতে পেল। মৃদুলা হাঁক দিল, ওই তুমি এখনো ঘরে কি করো?
রাতুল ভূত দেখার মতো চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো, সত্যি সত্যি তুমি চলে এসেছো!
মৃদুলা ধমক দিয়ে বললো, সত্যি না। আমি ভূত। এক্ষুনি বেরুবে না তোমার ঘাড় মটকাবো?
রাতুল দেখলো অবস্থা বেগতিক। সে ঈশারায় মৃদুলাকে অপেক্ষা করতে বলে ঘরে ঢুকে গেল। এর কিছুক্ষণ পর রাতুল দেয়াল টপকে বেরিয়ে এলো। রাতুলকে দেয়াল টপকাতে দেখে মৃদুলা হি হি হি করে হেসে উঠলো। রাতুল এমনিতেই রাগান্বিত ছিল। মৃদুলার হাসি দেখে তার রাগ আরো বেড়ে গেল। সে রাগতস্বরে মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি কোন কান্ড জ্ঞান নেই? এতো রাতে বেরিয়েছো! কোন ভয়-ডর নেই?
মৃদুলা বিদ্রুপের হাসি হাসলো, কান্ড-জ্ঞান, ভয়-ডর এই জিনিসগুলো আমার একটু কম আছে। জানোই তো আমার মন যা বলে আমি তা করতে ভালোবাসি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ রাত শহর ঘুরে বেড়াবো। তুমি যদি না যেতে চাও সমস্যা নেই। আমি একাই যেতে পারবো।
রাতুল বুঝলো এই মানবীকে বুঝানো তার তার কম্ম নয়। অগত্যা তাকে সামনে এগুতে হলো। সে মৃদুলার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। খানিকক্ষণ কেউ কোন কথা বললো না। গলি পেরিয়ে মূল রাস্তায় উঠতেই মৃদুলা নীরবতা ভাঙ্গলো, তোমার বাইকটা আনলেই পারতে?
রাতুল ঝাঁঝালো উত্তর দেয়, দেখলেই তো কীভাবে চোরের মতো বেরিয়ে এলাম। বাইক আনবো কি করে?
হু। তবে না এনে ভালোই করেছো। তোমাদের ছেলেদের আবার একটা সমস্যা আছে। বাইকের পেছনে
গার্লফ্রেন্ড বসা থাকলে যখন-তখন হার্ডব্রেক কষার খায়েশ জেগে ওঠে। মৃদুলা ব্যঙ্গ করে বলে।
রাতুল ততক্ষণাত প্রতিবাদ জানায়, মোটেও না।
মৃদুলা রাতুলের দিকে তাঁকিয়ে বলে, আমিও তো তোমার মোটর বাইকে সওয়ার হয়েছি না কি!
রাতুল চুপসে যায়। যেন ধরা খেয়ে গেছে এমন মুখ করে হাঁটতে থাকে। রাতুলকে সরাসরি বোল্ড করতে পেরে মৃদুলা বেশ মজা পেলো।
মূল রাস্তা ধরে ওরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। সেই সন্ধ্যা থেকে জ্বলতে জ্বলতে রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো যেন খানিকটা ক্লান্ত। ক্লান্ত সোনালী আলো আর অঘ্রানের হালকা কুয়াশা মিলিয়ে বেশ অদ্ভুত একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রাস্তার পাশের কোন এক বাড়ি থেকে হাসনাহেনা ফুল গন্ধ ছড়াচ্ছে। কয়েকটি বাদুর এদিক-সেদিক উড়াউড়ি করছে। দূরে কোথাও কয়েকটি কুকুরের ডাকও শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একটি প্রাইভেট কার শোঁ শোঁ করে ছুটে যাচ্ছে। মৃদুলা অবাক নয়নে শেষরাতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে। রাতের এই সৌন্দর্য্য তার কাছে একেবারে নতুন। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ হাঁটার পর মৃদুলা নীরবতা ভাঙ্গলো, তুমি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটছো নাকি?
রাতুল বলে, ঘুমিয়ে হাঁটবো কেন?
মৃদুলা বলল, তাহলে একেবারে চুপ মেরে গেলে যে!
রাতুল উত্তর দেয়, রাতের এই পরিবেশের সাথে আমিও অপরিচিত। তাই বোঝার চেষ্টা করছি।
মৃদুলা জিজ্ঞেস করে, তুমি এর আগে কখনো রাতে বেরোও নি?
রাতুল উত্তর দেয়, বেরিয়েছি, কিন্তু এভাবে প্রকৃতি দেখার উদ্দেশ্যে কখনও বেরোইনি।
মৃদুলা বলল, তার মানে আমার সাথে এসে তোমার খুব একটা খারাপ লাগছে না?
রাতুল মাথা নাড়ায়। কিন্তু না বোধক না হ্যাঁ বোধক ঠিক বুঝা গেলোনা।
মৃদুলা জিজ্ঞেস করে, তোমার ভয় করছেনা?
ভয় করবে কেন? রাতুল অবাক হলো।
মৃদুলা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, না ধরো, কোন ভূত-প্রেত যদি এখন পথ আগলে দাঁড়ায়, তাহলে কি করবে?
রাতুল ঝটপট উত্তর দেয়, ওসব ভূত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই। আর যদি থেকেও থাকে কোন প্রবলেম নেই। আমি সিংহ রাশির জাতক। শুনেছি সিংহ রাশির জাতককে ভূত-প্রেত ভয় পায়।
রাতুলের কথা শুনে মৃদুলার খুব হাসি পেল। সে জোরে হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, দয়া করে এতো রাতে হাসিও না প্লিজ।
রাতুল বলল, মানুষ নামক কিছু ভূত কল্পনার ভূতের চেয়ে বেশী বিপদজনক। আর এই নির্জন রাতে সেই ভূতগুলোকে নিয়েই আমার যতো চিন্তা। যেকোন সময়েই ওরা আক্রমন করবেনা এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।
মৃদুলা বলল, ভয় কিসের? তুমি আছো না?
রাতুল বলে, দেখো, আমি বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারিনা। আমি সিনেমার নায়ক নই যে একা ওদেরকে হারিয়ে দিতে পারবো।
অনেকক্ষণ ধরে একটা সিগারেটের জন্য মৃদুলার মন উশখুশ করছে। তাড়াহুড়োয় বেরুতে গিয়ে সিগারেটের প্যাকেট আনতে ভুলে গেছে। এতো রাতে একটা দোকানও খোলা নেই। রাতুলকে বলেও কোন লাভ নেই, ওর কাছে সিগারেট তো নেই ই, উলটো রাস্তায় সিগারেট খাওয়ার কথা শুনলে জ্ঞান দিতে লেগে যাবে।
বাসা থেকে ওরা অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। একটা ছোট পয়েন্টে পৌছে ওদের চোখে পড়লো, বেশ কয়েকজন নিশিকন্যা উগ্র সাজে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এই হালকা শীতের রাতে মেয়েগুলোকে এভাবে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদুলার খুব খারাপ লাগছে। এদের কেউই স্বেচ্ছায় এ পেশাতে আসেনি। ভাগ্যের ফেরে এ জীবনে জড়িয়ে যেতে হয়েছে। মৃদুলার ইচ্ছে করছিলো মেয়েগুলোর সাথে কথা বলতে। তবে মেয়েগুলো কি ভাববে মনে করে সে ইচ্ছাটাকে অবদমিত করলো।
পয়েন্ট পেরিয়ে একটু এগুতেই একটা চায়ের দোকান চোখে পড়লো। রাতুল ও মৃদুলা সে দোকানে ঢুকলো। মৃদুলা প্রথমেই সিগারেট আছে কিনা খোঁজ নিলো। কিন্তু তাকে আশাহত হতে হলো। মৃদুলার মুখে সিগারেটের কথা শুনে দোকানী ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে রইলো। দোকানীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে এমন আশ্চর্য্যের কথা সে আর কখনও শোনেনি। মৃদুলা তা আঁচ করতে পেরে দোকানীকে জিজ্ঞেস করলো, এতো আশ্চর্য্য হচ্ছেন কেন! মেয়েরা কি সিগারেট খেতে পারেনা?
দোকানী আমতা আমতা করে বললো, না আফা বালা মাইয়ারা তো সিগারেট খায়না।
মৃদুলার খুব রাগ হচ্ছিলো। সে বলল, আমার মুখে কোথাও কি লেখা আছে আমি ভালো মেয়ে?
দোকানী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, আপনারে দেখলেই বুঝা যায় আপনে বালা ঘরের মাইয়া।
মৃদুলা দেখলো এর সাথে কথা বললে কথা শুধু বাড়বেই। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বেশী কথা না বলে ভালো করে দুটো চা বানান। আমাকে এক কাপ দুধ চা আর ওকে ঘন লিকারে একটু আদা লেবু দিয়ে ভালো করে চা দিন।
রাতুল রঙ চা খেতে আপত্তি জানাতে যাচ্ছিলো। মৃদুলা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, কখন থেকে দেখছি কাশছো। আদা-লেবু দিয়ে রঙ চা খাও ঠিক হয়ে যাও। রাতুল আর আপত্তি জানাতে পারেনা। আসলে কিছু মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের গুণটা খুব বেশী প্রবল। এরা নিজেদের এই গুণ দিয়ে যে কাউকে সামলে নিতে পারে।
রাতুল ভূত দেখার মতো চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো, সত্যি সত্যি তুমি চলে এসেছো!
মৃদুলা ধমক দিয়ে বললো, সত্যি না। আমি ভূত। এক্ষুনি বেরুবে না তোমার ঘাড় মটকাবো?
রাতুল দেখলো অবস্থা বেগতিক। সে ঈশারায় মৃদুলাকে অপেক্ষা করতে বলে ঘরে ঢুকে গেল। এর কিছুক্ষণ পর রাতুল দেয়াল টপকে বেরিয়ে এলো। রাতুলকে দেয়াল টপকাতে দেখে মৃদুলা হি হি হি করে হেসে উঠলো। রাতুল এমনিতেই রাগান্বিত ছিল। মৃদুলার হাসি দেখে তার রাগ আরো বেড়ে গেল। সে রাগতস্বরে মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি কোন কান্ড জ্ঞান নেই? এতো রাতে বেরিয়েছো! কোন ভয়-ডর নেই?
মৃদুলা বিদ্রুপের হাসি হাসলো, কান্ড-জ্ঞান, ভয়-ডর এই জিনিসগুলো আমার একটু কম আছে। জানোই তো আমার মন যা বলে আমি তা করতে ভালোবাসি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ রাত শহর ঘুরে বেড়াবো। তুমি যদি না যেতে চাও সমস্যা নেই। আমি একাই যেতে পারবো।
রাতুল বুঝলো এই মানবীকে বুঝানো তার তার কম্ম নয়। অগত্যা তাকে সামনে এগুতে হলো। সে মৃদুলার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। খানিকক্ষণ কেউ কোন কথা বললো না। গলি পেরিয়ে মূল রাস্তায় উঠতেই মৃদুলা নীরবতা ভাঙ্গলো, তোমার বাইকটা আনলেই পারতে?
রাতুল ঝাঁঝালো উত্তর দেয়, দেখলেই তো কীভাবে চোরের মতো বেরিয়ে এলাম। বাইক আনবো কি করে?
হু। তবে না এনে ভালোই করেছো। তোমাদের ছেলেদের আবার একটা সমস্যা আছে। বাইকের পেছনে
গার্লফ্রেন্ড বসা থাকলে যখন-তখন হার্ডব্রেক কষার খায়েশ জেগে ওঠে। মৃদুলা ব্যঙ্গ করে বলে।
রাতুল ততক্ষণাত প্রতিবাদ জানায়, মোটেও না।
মৃদুলা রাতুলের দিকে তাঁকিয়ে বলে, আমিও তো তোমার মোটর বাইকে সওয়ার হয়েছি না কি!
রাতুল চুপসে যায়। যেন ধরা খেয়ে গেছে এমন মুখ করে হাঁটতে থাকে। রাতুলকে সরাসরি বোল্ড করতে পেরে মৃদুলা বেশ মজা পেলো।
মূল রাস্তা ধরে ওরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। সেই সন্ধ্যা থেকে জ্বলতে জ্বলতে রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো যেন খানিকটা ক্লান্ত। ক্লান্ত সোনালী আলো আর অঘ্রানের হালকা কুয়াশা মিলিয়ে বেশ অদ্ভুত একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রাস্তার পাশের কোন এক বাড়ি থেকে হাসনাহেনা ফুল গন্ধ ছড়াচ্ছে। কয়েকটি বাদুর এদিক-সেদিক উড়াউড়ি করছে। দূরে কোথাও কয়েকটি কুকুরের ডাকও শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একটি প্রাইভেট কার শোঁ শোঁ করে ছুটে যাচ্ছে। মৃদুলা অবাক নয়নে শেষরাতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে। রাতের এই সৌন্দর্য্য তার কাছে একেবারে নতুন। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ হাঁটার পর মৃদুলা নীরবতা ভাঙ্গলো, তুমি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটছো নাকি?
রাতুল বলে, ঘুমিয়ে হাঁটবো কেন?
মৃদুলা বলল, তাহলে একেবারে চুপ মেরে গেলে যে!
রাতুল উত্তর দেয়, রাতের এই পরিবেশের সাথে আমিও অপরিচিত। তাই বোঝার চেষ্টা করছি।
মৃদুলা জিজ্ঞেস করে, তুমি এর আগে কখনো রাতে বেরোও নি?
রাতুল উত্তর দেয়, বেরিয়েছি, কিন্তু এভাবে প্রকৃতি দেখার উদ্দেশ্যে কখনও বেরোইনি।
মৃদুলা বলল, তার মানে আমার সাথে এসে তোমার খুব একটা খারাপ লাগছে না?
রাতুল মাথা নাড়ায়। কিন্তু না বোধক না হ্যাঁ বোধক ঠিক বুঝা গেলোনা।
মৃদুলা জিজ্ঞেস করে, তোমার ভয় করছেনা?
ভয় করবে কেন? রাতুল অবাক হলো।
মৃদুলা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, না ধরো, কোন ভূত-প্রেত যদি এখন পথ আগলে দাঁড়ায়, তাহলে কি করবে?
রাতুল ঝটপট উত্তর দেয়, ওসব ভূত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই। আর যদি থেকেও থাকে কোন প্রবলেম নেই। আমি সিংহ রাশির জাতক। শুনেছি সিংহ রাশির জাতককে ভূত-প্রেত ভয় পায়।
রাতুলের কথা শুনে মৃদুলার খুব হাসি পেল। সে জোরে হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, দয়া করে এতো রাতে হাসিও না প্লিজ।
রাতুল বলল, মানুষ নামক কিছু ভূত কল্পনার ভূতের চেয়ে বেশী বিপদজনক। আর এই নির্জন রাতে সেই ভূতগুলোকে নিয়েই আমার যতো চিন্তা। যেকোন সময়েই ওরা আক্রমন করবেনা এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।
মৃদুলা বলল, ভয় কিসের? তুমি আছো না?
রাতুল বলে, দেখো, আমি বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারিনা। আমি সিনেমার নায়ক নই যে একা ওদেরকে হারিয়ে দিতে পারবো।
অনেকক্ষণ ধরে একটা সিগারেটের জন্য মৃদুলার মন উশখুশ করছে। তাড়াহুড়োয় বেরুতে গিয়ে সিগারেটের প্যাকেট আনতে ভুলে গেছে। এতো রাতে একটা দোকানও খোলা নেই। রাতুলকে বলেও কোন লাভ নেই, ওর কাছে সিগারেট তো নেই ই, উলটো রাস্তায় সিগারেট খাওয়ার কথা শুনলে জ্ঞান দিতে লেগে যাবে।
বাসা থেকে ওরা অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। একটা ছোট পয়েন্টে পৌছে ওদের চোখে পড়লো, বেশ কয়েকজন নিশিকন্যা উগ্র সাজে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এই হালকা শীতের রাতে মেয়েগুলোকে এভাবে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদুলার খুব খারাপ লাগছে। এদের কেউই স্বেচ্ছায় এ পেশাতে আসেনি। ভাগ্যের ফেরে এ জীবনে জড়িয়ে যেতে হয়েছে। মৃদুলার ইচ্ছে করছিলো মেয়েগুলোর সাথে কথা বলতে। তবে মেয়েগুলো কি ভাববে মনে করে সে ইচ্ছাটাকে অবদমিত করলো।
পয়েন্ট পেরিয়ে একটু এগুতেই একটা চায়ের দোকান চোখে পড়লো। রাতুল ও মৃদুলা সে দোকানে ঢুকলো। মৃদুলা প্রথমেই সিগারেট আছে কিনা খোঁজ নিলো। কিন্তু তাকে আশাহত হতে হলো। মৃদুলার মুখে সিগারেটের কথা শুনে দোকানী ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে রইলো। দোকানীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে এমন আশ্চর্য্যের কথা সে আর কখনও শোনেনি। মৃদুলা তা আঁচ করতে পেরে দোকানীকে জিজ্ঞেস করলো, এতো আশ্চর্য্য হচ্ছেন কেন! মেয়েরা কি সিগারেট খেতে পারেনা?
দোকানী আমতা আমতা করে বললো, না আফা বালা মাইয়ারা তো সিগারেট খায়না।
মৃদুলার খুব রাগ হচ্ছিলো। সে বলল, আমার মুখে কোথাও কি লেখা আছে আমি ভালো মেয়ে?
দোকানী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, আপনারে দেখলেই বুঝা যায় আপনে বালা ঘরের মাইয়া।
মৃদুলা দেখলো এর সাথে কথা বললে কথা শুধু বাড়বেই। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বেশী কথা না বলে ভালো করে দুটো চা বানান। আমাকে এক কাপ দুধ চা আর ওকে ঘন লিকারে একটু আদা লেবু দিয়ে ভালো করে চা দিন।
রাতুল রঙ চা খেতে আপত্তি জানাতে যাচ্ছিলো। মৃদুলা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, কখন থেকে দেখছি কাশছো। আদা-লেবু দিয়ে রঙ চা খাও ঠিক হয়ে যাও। রাতুল আর আপত্তি জানাতে পারেনা। আসলে কিছু মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের গুণটা খুব বেশী প্রবল। এরা নিজেদের এই গুণ দিয়ে যে কাউকে সামলে নিতে পারে।
চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে ওরা আবার সামনের দিকে এগুতে লাগলো। পাবলিক
লাইব্রেরীর সামনে আসতেই তাদের পাশ ঘেসে পুলিশের একটা জিপ এসে থামলো। গাড়ি
থেকে একজন পুলিশ অফিসার নেমে এলেন। মৃদুলা অফিসারের নেমপ্লেটে চোখ বুলিয়ে
অফিসারের নাম জেনে নিলো।
পুলিশ অফিসার রাতুলকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা এতো রাতে কোথা থেকে ফিরছেন?
রাতুল উত্তর দিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তাকে থামিয়ে মৃদুলা বলল, আমরা রাতের রাস্তা দেখতে বেরিয়েছি।
অফিসারের মুখ দেখে মনে হলো, এমন আজব কথা তিনি এর আগে শুনেননি। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কি বললেন?
মৃদুলা বলল, আমার অনেকদিনের শখ ছিল শেষরাতের শহর দেখতে কেমন হয় তা দেখবো। তাই আজ রাতে শহর দেখতে বেরিয়েছি।
অফিসার ভ্রু কুঁচকে কথাটা শুনলেন। তারপর বললেন, দেখুন কিছু লুকাতে যাবেন না। সত্যি করে বলুন কি করছেন এতো রাতে?
মৃদুলা ভেতরে ভেতরে খানিকটা অস্বস্তিবোধ করলো। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দেখুন আমার নাম মৃদুলা কোহেলিকা আর এ হচ্ছে আমার বন্ধু রাতুল। মৃদুলা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। অফিসার তাকে থামিয়ে বললেন, কি নাম বললেন? মৃদুলা কোহেলিকা? নামটা চেনা চেনা লাগছে। আচ্ছা আপনি কি ছবি আঁকেন?
অতল জলে মৃদুলা যেন একটু ঠাই খুঁজে পেল। সে দ্রুত উত্তর দিল, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ছবি আঁকি।
অফিসার এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, গত মাসে শিল্পকলায় মৃদুলা কোহেলিকার আঁকা ছবির একটা এগজিবিশন হয়েছিলো। সেখানে একটা ছবি খুব প্রশংসিত হয়েছে। ছবিটার নাম বলুন তো?
মৃদুলা পুলিশ অফিসারের কথা শুনে খুব আশ্চর্য্য হলো। এই অফিসার তার আঁকা ছবির কথা জানে! সে উতফুল্ল হয়ে বলল, দ্য ড্যান্সিং মাউন্টেন।
মৃদুলা পেইন্টিং এর নাম বলার সাথে সাথে পুলিশ অফিসারের জাদরেল কঠিন মুখাবয়বে মূহুর্ত্বেই একটা বিনম্র, শান্ত ভাব ফুটে উঠলো। একটু আগেই যিনি হম্বিতম্বি করছিলেন সেই তিনিই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম। যদি জানতাম আপনি মৃদুলা কোহেলিকা তাহলে মোটেই পথ আগলে ডিস্টার্ব করতাম না। আই এম সো স্যরি। প্লীজ ফরগিভ মি। আপনার আঁকা ছবি আমার খুব ভালো লাগে। আপনার শেষ দুটো এগজিবিশনে আমি গিয়েছি। আপনি অসাধারণ ছবি আঁকেন। গত এগজিবিশনে আপনার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আপনার খোঁজ পাইনি।
রাতুল তো বটেই মৃদুলা নিজেও অবাক হয়ে গেছে। ছবি সে অনেকদিন থেকেই আঁকছে। তিনটা এগজিবিশনও হয়েছে। পরিচিত মহলে কিছু গুণগ্রাহী তৈরি হয়েছে বটে কিন্তু বাইরের মানুষ এখনও সেভাবে তাঁকে চেনেনা বলেই জানতো। একে তো অপরিচিত ব্যক্তি তার ওপর পুলিশ অফিসার তার আঁকা ছবির এতো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন সে নিজ কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে কোনরকমে বলল, আমার আঁকা ছবি আপনি দেখেছেন?
পুলিশ অফিসার মুখে হাসি রেখেই বললেন, শুধু ছবি কেন! আপনার লেখা কবিতাও আমি পড়েছি। পত্রিকায় আপনার কবিতা পড়েই আপনার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আপনার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল। দেখুন কি কাকতালীয় ব্যাপার! এভাবে আপনার সাথে দেখা হবে কল্পনাই করিনি। প্লীজ একদিন সময় করে আমার ওখানে আসবেন। আপনাদের দুজনেরই চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ রইলো।
মৃদুলা বলল, অফকোর্স। একদিন সময় করে আপনার ওখানে আমরা চা খেয়ে আসবো।
অফিসার বললেন, ধন্যবাদ। আর আপনাদের সময় নষ্ট করবোনা। কোথায় যাবেন বলুন? আমি নামিয়ে দিয়ে আসবো।
রাতুল এতোক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো। এবার সে বলল, ধন্যবাদ আপনাকে কষ্ট করতে হবেনা। আমরা হেঁটেই চলে যাব।
অফিসার বললেন, না না তা কি করে হয়! আমি থাকতে আপনারা কষ্ট করবেন!
এবার মৃদুলা অফিসারকে থামিয়ে বলল, আমরা হেঁটেই চলে যাবো। ছবি আঁকার নতুন কোন সাবজেক্ট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই রাতের শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম, যদি ছবি আঁকার কোন বিষয় পাওয়া যায়। এখন ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। আমরা চলে যেতে পারবো।
ছবি আঁকার কথা শোনে অফিসার উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ও তাই বুঝি! তাহলে আপনাদের আর ডিস্টার্ব করছিনা। তবে ম্যাডাম একটা কথা বলার ছিল।
মৃদুলা বলল, হ্যাঁ বলুন।
অফিসার মাথার টুপিটা খুলতে খুলতে বললেন, আর যদি রাতের শহর দেখার ইচ্ছা হয় তবে দয়া করে থানায় একটু ইনফর্ম করে নেবেন। বুঝেনই তো রাতের রাস্তায় নানারকম উতপাত লুকিয়ে আছে। কখন কি ঘটে যায় বলা যায়না। প্রপার প্রটেকশন না নিয়ে এভাবে বেরুনো উচিত হবেনা।
মৃদুলা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। অফিসার জিপে উঠতে যাবেন ঠিক তখন মৃদুলা জিজ্ঞেস করলো, আপনার কাছে একটা সিগারেট হবে?
অফিসার আশ্চর্য্য হলেন। তবে মৃদুলাকে বুঝতে না দিয়ে বললেন, অফকোর্স অফকোর্স।
ইতোমধ্যে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখিরা ঘুম থেকে উঠে কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে। মুসল্লীরা ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছেন। রাতুল ও মৃদুলা দ্রুত পা বাড়ালো। দেরী হয়ে গেলে সুরমা পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখা হবেনা। অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে তারা কীনব্রীজ এলাকায় পৌছলো। আলী আমজাদের ঘড়িঘরের বারান্দায় বেশ কয়েকজন মানুষ কাঁথা মুড়ে ঘুমিয়ে আছে। বেশ কয়েকজন বয়স্ক লোক মর্নিং ওয়াক এ বেরিয়েছেন।
অগ্রহায়ন মাস। সুরমার পানিতে টান ধরেছে। চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ির একেবারে নিচ ধাপে পানি নেমে গিয়েছে। বর্ষার প্রাণোচ্ছ্বল সুরমা এ সময়ে এসে একেবারে শান্ত হয়ে যায়। কীনব্রীজের পিলারের নিচের দিকের অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাঝনদী দিয়ে ছোট ছোট ইঞ্জিন নৌকা আর বালু-পাথরবাহী ট্রলারগুলো গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। ঘাটের একপাশে দুজন লোক বড়শী দিয়ে মাছ ধরছে। ব্লক দিয়ে বাঁধানো পাড়ে কিছু ছিন্নমূল মানুষ আগুন পোহানোর বন্দোবস্ত করছে। কিন্তু নদীর শীতল হাওয়ার তোড়ে আগুন তো ধরছেই না উলটো শুকনো পাতা পোড়ানোর গন্ধ আর ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
মৃদুলা ও রাতুল চাঁদনি ঘাটের শেষধাপে গিয়ে বসলো। মৃদুলা জুতো খুলে খালি পা পানির মধ্যে ডুবিয়ে বসলো। ইঞ্জিন নৌকা যাওয়ার সময় যে ঢেউ তৈরি হচ্ছে তা কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর মৃদুলার পায়ে এসে আঘাত করছে। নদীর এই শীতল হাওয়া, পানির স্পর্শ মৃদুলা খুব উপভোগ করছে। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য্যে সে মুগ্ধ। তার এই মুগ্ধতা এক অনন্য রূপ নিলো যখন পুব আকাশে লাল সূর্যটা একটু একটু করে জেগে উঠতে লাগলো। দেখে মনে হচ্ছে নদীর দক্ষিন পাড় হতে কেউ নিজ হাতে লাল সূর্যটাকে আকাশের গায়ে বসিয়ে দিয়েছে। মৃদুলা অবাক হয়ে ভাবছিলো, আমাদের প্রতিটা দিনের জেগে উঠা কতো সুন্দর!
ভোরের প্রথম আলোয় মৃদুলাকে একেবারে অন্যরকম লাগছে। রক্তিম সূর্য্যের মৃদু আলো মৃদুলার কাচা হলুদ রঙের মুখে এক অন্য রকম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। মৃদুলার এই সৌন্দর্য্য রাতুলের কাছে একেবারে অপরিচিত। রূপ আর মেধার সংমিশ্রণ একসাথে ঘটলে মানুষের সৌন্দর্য্য যে এক অনন্য উচ্চতায় পৌছায় তার জ্বলন্ত উদাহরন মৃদুলা। রাতুল মুগ্ধ হয়ে মৃদুলাকে দেখছিল। মৃদুলার আলোকজ্জ্বল মুখ থেকে সে তার দৃষ্টি সরাতে পারছিলোনা। রাতুলকে একদৃষ্টে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে মৃদুলা জিজ্ঞেস করলো,
- কি হয়েছে?
-কিছুনা।
- তাহলে এভাবে তাঁকিয়ে আছো কেন?
- এমনি। আচ্ছা তুমি কি আমায় একটু বলবে?
- কি বলবো?
- আমি তোমাতে এতো মুগ্ধ হই কেন?
- যা! সব তোমার বাড়িয়ে বলা!
- একটুও বাড়িয়ে বলছিনা।
- মুগ্ধ করার মতো কোন গুণ আমার নেই।
- কেউ কি তার নিজের গুণ দেখতে পায়?
- দেখতে পায়না বৈকি, তবে অনুভব করতে পারে।
- তুমি ভালো ছবি আঁকো। তোমার কবিতা লেখার হাতও বেশ ভালো। এগুলো কি গুণ নয়?
- থামবে তুমি?
- থামবো কেন? এই যে হাসলে তাতেও কি রকম সৌন্দর্য্য তা তুমি নিজে বুঝতে পারবেনা। এটা কি গুণের পর্যায়ে পড়েনা?
- মোটেও একে গুণ বলা যায়না। হাসি আবার গুণ কি করে হয়!
- সুন্দর হাসি অবশ্যই একটা গুণ। আর কোন গুণ না থাকলেও এক টুকরো সুন্দর হাসি দিয়ে সমস্ত জগত জয় করা যায়।
- তাই নাকি!
- অবশ্যই। সুন্দর হাসির সাথে এরকম একটা মিষ্টি কন্ঠ থাকলে তো আর কথাই নেই।
- ধুর! কন্ঠ সুন্দর হলে অবশ্যই কবিতা আবৃত্তি করতাম।
- তুমি নিজেই তো কবিতা। তোমার গুণমুগ্ধরাই তোমাকে আবৃত্তি করবে।
- বাহ! আমি কবিতা! তা মশায় সেই কবিতার কবি কে?
- কবিতার শুরুটা অবশ্য স্রষ্টার পেন্সিলের আঁচড়ে। তবে কবিতাটা এখনও খানিক অসম্পূর্ণ।
- অসম্পূর্ণ কেন!
- আসলে তুমি তো চর্যাপদ! একা কোন কবি তোমাকে লিখে শেষ করতে পারবেনা। যুগে যুগে নবরাগে তোমার পংক্তিমালা গাঁথা হবে।
- একজন কবি কি একটি মহাকাব্য শেষ করতে পারেনা?
- পারবেনা কেন! অবশ্যই পারে। তবে তাতে প্রকৃত প্রেম থাকতে হবে। ভালোবাসার পরশ না থাকলে একজন কবির পক্ষে একটি মহাকাব্য রচনা সম্ভব নয়।
- তাহলে কি আর করা! আমার মহাকাব্য অসম্পূর্ণই থাক।
- অসম্পূর্ণ থাকবে কেন! তুমি চাইলে আমি তোমাকে পরিপূর্ণ করতে পারি। শেষ পংক্তিগুলো না হয় আমিই লিখে দেবো।
- না বাবা! নবীণ কবিতে আমার বিশ্বাস নেই। শেষে আবার ছন্দে তালগোল পাঁকিয়ে ফেলবে।
- দেখ, আমি স্বভাব কবি। ছন্দ আমার ধমনীতে। স্বরবৃত্ত-অক্ষরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত সব আমার নখদর্পণে। তুমি চাইলে অমিত্রাক্ষর ছন্দেও লিখে দিতে পারি।
- তবুও বিশ্বাস নেই।
- চোখটা বন্ধ করবে?
- চোখ বন্ধ করবো কেন?
- বিশ্বাস রাখতে পারো, কবিতায় কোন কালিমা লাগবেনা।
- আচ্ছা বন্ধ করলাম।
- এবার তাঁকাও। নদীর জলে মুখটা দেখো। কোন পরিবর্তন ধরা পড়ে কি?
- হুম। কপালের ছোট কালো টিপটা ডান থুতনিতে বসিয়ে দিয়েছো। দেখে মনে হচ্ছে একটি ছোট্ট তিল। দেখতে তো ভালোই লাগছে!
- দেখলে তো কতো সহজেই এক পংক্তি লিখে দিলাম। চাইলে আরো লিখে দিতে পারি।
- হুম। আজ এটুকুই থাক। বাকিটা না হয় অন্য দিন লিখো।
পুলিশ অফিসার রাতুলকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা এতো রাতে কোথা থেকে ফিরছেন?
রাতুল উত্তর দিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তাকে থামিয়ে মৃদুলা বলল, আমরা রাতের রাস্তা দেখতে বেরিয়েছি।
অফিসারের মুখ দেখে মনে হলো, এমন আজব কথা তিনি এর আগে শুনেননি। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কি বললেন?
মৃদুলা বলল, আমার অনেকদিনের শখ ছিল শেষরাতের শহর দেখতে কেমন হয় তা দেখবো। তাই আজ রাতে শহর দেখতে বেরিয়েছি।
অফিসার ভ্রু কুঁচকে কথাটা শুনলেন। তারপর বললেন, দেখুন কিছু লুকাতে যাবেন না। সত্যি করে বলুন কি করছেন এতো রাতে?
মৃদুলা ভেতরে ভেতরে খানিকটা অস্বস্তিবোধ করলো। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দেখুন আমার নাম মৃদুলা কোহেলিকা আর এ হচ্ছে আমার বন্ধু রাতুল। মৃদুলা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। অফিসার তাকে থামিয়ে বললেন, কি নাম বললেন? মৃদুলা কোহেলিকা? নামটা চেনা চেনা লাগছে। আচ্ছা আপনি কি ছবি আঁকেন?
অতল জলে মৃদুলা যেন একটু ঠাই খুঁজে পেল। সে দ্রুত উত্তর দিল, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ছবি আঁকি।
অফিসার এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, গত মাসে শিল্পকলায় মৃদুলা কোহেলিকার আঁকা ছবির একটা এগজিবিশন হয়েছিলো। সেখানে একটা ছবি খুব প্রশংসিত হয়েছে। ছবিটার নাম বলুন তো?
মৃদুলা পুলিশ অফিসারের কথা শুনে খুব আশ্চর্য্য হলো। এই অফিসার তার আঁকা ছবির কথা জানে! সে উতফুল্ল হয়ে বলল, দ্য ড্যান্সিং মাউন্টেন।
মৃদুলা পেইন্টিং এর নাম বলার সাথে সাথে পুলিশ অফিসারের জাদরেল কঠিন মুখাবয়বে মূহুর্ত্বেই একটা বিনম্র, শান্ত ভাব ফুটে উঠলো। একটু আগেই যিনি হম্বিতম্বি করছিলেন সেই তিনিই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম। যদি জানতাম আপনি মৃদুলা কোহেলিকা তাহলে মোটেই পথ আগলে ডিস্টার্ব করতাম না। আই এম সো স্যরি। প্লীজ ফরগিভ মি। আপনার আঁকা ছবি আমার খুব ভালো লাগে। আপনার শেষ দুটো এগজিবিশনে আমি গিয়েছি। আপনি অসাধারণ ছবি আঁকেন। গত এগজিবিশনে আপনার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আপনার খোঁজ পাইনি।
রাতুল তো বটেই মৃদুলা নিজেও অবাক হয়ে গেছে। ছবি সে অনেকদিন থেকেই আঁকছে। তিনটা এগজিবিশনও হয়েছে। পরিচিত মহলে কিছু গুণগ্রাহী তৈরি হয়েছে বটে কিন্তু বাইরের মানুষ এখনও সেভাবে তাঁকে চেনেনা বলেই জানতো। একে তো অপরিচিত ব্যক্তি তার ওপর পুলিশ অফিসার তার আঁকা ছবির এতো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন সে নিজ কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে কোনরকমে বলল, আমার আঁকা ছবি আপনি দেখেছেন?
পুলিশ অফিসার মুখে হাসি রেখেই বললেন, শুধু ছবি কেন! আপনার লেখা কবিতাও আমি পড়েছি। পত্রিকায় আপনার কবিতা পড়েই আপনার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আপনার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল। দেখুন কি কাকতালীয় ব্যাপার! এভাবে আপনার সাথে দেখা হবে কল্পনাই করিনি। প্লীজ একদিন সময় করে আমার ওখানে আসবেন। আপনাদের দুজনেরই চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ রইলো।
মৃদুলা বলল, অফকোর্স। একদিন সময় করে আপনার ওখানে আমরা চা খেয়ে আসবো।
অফিসার বললেন, ধন্যবাদ। আর আপনাদের সময় নষ্ট করবোনা। কোথায় যাবেন বলুন? আমি নামিয়ে দিয়ে আসবো।
রাতুল এতোক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো। এবার সে বলল, ধন্যবাদ আপনাকে কষ্ট করতে হবেনা। আমরা হেঁটেই চলে যাব।
অফিসার বললেন, না না তা কি করে হয়! আমি থাকতে আপনারা কষ্ট করবেন!
এবার মৃদুলা অফিসারকে থামিয়ে বলল, আমরা হেঁটেই চলে যাবো। ছবি আঁকার নতুন কোন সাবজেক্ট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই রাতের শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম, যদি ছবি আঁকার কোন বিষয় পাওয়া যায়। এখন ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। আমরা চলে যেতে পারবো।
ছবি আঁকার কথা শোনে অফিসার উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ও তাই বুঝি! তাহলে আপনাদের আর ডিস্টার্ব করছিনা। তবে ম্যাডাম একটা কথা বলার ছিল।
মৃদুলা বলল, হ্যাঁ বলুন।
অফিসার মাথার টুপিটা খুলতে খুলতে বললেন, আর যদি রাতের শহর দেখার ইচ্ছা হয় তবে দয়া করে থানায় একটু ইনফর্ম করে নেবেন। বুঝেনই তো রাতের রাস্তায় নানারকম উতপাত লুকিয়ে আছে। কখন কি ঘটে যায় বলা যায়না। প্রপার প্রটেকশন না নিয়ে এভাবে বেরুনো উচিত হবেনা।
মৃদুলা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। অফিসার জিপে উঠতে যাবেন ঠিক তখন মৃদুলা জিজ্ঞেস করলো, আপনার কাছে একটা সিগারেট হবে?
অফিসার আশ্চর্য্য হলেন। তবে মৃদুলাকে বুঝতে না দিয়ে বললেন, অফকোর্স অফকোর্স।
ইতোমধ্যে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখিরা ঘুম থেকে উঠে কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে। মুসল্লীরা ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছেন। রাতুল ও মৃদুলা দ্রুত পা বাড়ালো। দেরী হয়ে গেলে সুরমা পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখা হবেনা। অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে তারা কীনব্রীজ এলাকায় পৌছলো। আলী আমজাদের ঘড়িঘরের বারান্দায় বেশ কয়েকজন মানুষ কাঁথা মুড়ে ঘুমিয়ে আছে। বেশ কয়েকজন বয়স্ক লোক মর্নিং ওয়াক এ বেরিয়েছেন।
অগ্রহায়ন মাস। সুরমার পানিতে টান ধরেছে। চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ির একেবারে নিচ ধাপে পানি নেমে গিয়েছে। বর্ষার প্রাণোচ্ছ্বল সুরমা এ সময়ে এসে একেবারে শান্ত হয়ে যায়। কীনব্রীজের পিলারের নিচের দিকের অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাঝনদী দিয়ে ছোট ছোট ইঞ্জিন নৌকা আর বালু-পাথরবাহী ট্রলারগুলো গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। ঘাটের একপাশে দুজন লোক বড়শী দিয়ে মাছ ধরছে। ব্লক দিয়ে বাঁধানো পাড়ে কিছু ছিন্নমূল মানুষ আগুন পোহানোর বন্দোবস্ত করছে। কিন্তু নদীর শীতল হাওয়ার তোড়ে আগুন তো ধরছেই না উলটো শুকনো পাতা পোড়ানোর গন্ধ আর ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
মৃদুলা ও রাতুল চাঁদনি ঘাটের শেষধাপে গিয়ে বসলো। মৃদুলা জুতো খুলে খালি পা পানির মধ্যে ডুবিয়ে বসলো। ইঞ্জিন নৌকা যাওয়ার সময় যে ঢেউ তৈরি হচ্ছে তা কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর মৃদুলার পায়ে এসে আঘাত করছে। নদীর এই শীতল হাওয়া, পানির স্পর্শ মৃদুলা খুব উপভোগ করছে। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য্যে সে মুগ্ধ। তার এই মুগ্ধতা এক অনন্য রূপ নিলো যখন পুব আকাশে লাল সূর্যটা একটু একটু করে জেগে উঠতে লাগলো। দেখে মনে হচ্ছে নদীর দক্ষিন পাড় হতে কেউ নিজ হাতে লাল সূর্যটাকে আকাশের গায়ে বসিয়ে দিয়েছে। মৃদুলা অবাক হয়ে ভাবছিলো, আমাদের প্রতিটা দিনের জেগে উঠা কতো সুন্দর!
ভোরের প্রথম আলোয় মৃদুলাকে একেবারে অন্যরকম লাগছে। রক্তিম সূর্য্যের মৃদু আলো মৃদুলার কাচা হলুদ রঙের মুখে এক অন্য রকম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। মৃদুলার এই সৌন্দর্য্য রাতুলের কাছে একেবারে অপরিচিত। রূপ আর মেধার সংমিশ্রণ একসাথে ঘটলে মানুষের সৌন্দর্য্য যে এক অনন্য উচ্চতায় পৌছায় তার জ্বলন্ত উদাহরন মৃদুলা। রাতুল মুগ্ধ হয়ে মৃদুলাকে দেখছিল। মৃদুলার আলোকজ্জ্বল মুখ থেকে সে তার দৃষ্টি সরাতে পারছিলোনা। রাতুলকে একদৃষ্টে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে মৃদুলা জিজ্ঞেস করলো,
- কি হয়েছে?
-কিছুনা।
- তাহলে এভাবে তাঁকিয়ে আছো কেন?
- এমনি। আচ্ছা তুমি কি আমায় একটু বলবে?
- কি বলবো?
- আমি তোমাতে এতো মুগ্ধ হই কেন?
- যা! সব তোমার বাড়িয়ে বলা!
- একটুও বাড়িয়ে বলছিনা।
- মুগ্ধ করার মতো কোন গুণ আমার নেই।
- কেউ কি তার নিজের গুণ দেখতে পায়?
- দেখতে পায়না বৈকি, তবে অনুভব করতে পারে।
- তুমি ভালো ছবি আঁকো। তোমার কবিতা লেখার হাতও বেশ ভালো। এগুলো কি গুণ নয়?
- থামবে তুমি?
- থামবো কেন? এই যে হাসলে তাতেও কি রকম সৌন্দর্য্য তা তুমি নিজে বুঝতে পারবেনা। এটা কি গুণের পর্যায়ে পড়েনা?
- মোটেও একে গুণ বলা যায়না। হাসি আবার গুণ কি করে হয়!
- সুন্দর হাসি অবশ্যই একটা গুণ। আর কোন গুণ না থাকলেও এক টুকরো সুন্দর হাসি দিয়ে সমস্ত জগত জয় করা যায়।
- তাই নাকি!
- অবশ্যই। সুন্দর হাসির সাথে এরকম একটা মিষ্টি কন্ঠ থাকলে তো আর কথাই নেই।
- ধুর! কন্ঠ সুন্দর হলে অবশ্যই কবিতা আবৃত্তি করতাম।
- তুমি নিজেই তো কবিতা। তোমার গুণমুগ্ধরাই তোমাকে আবৃত্তি করবে।
- বাহ! আমি কবিতা! তা মশায় সেই কবিতার কবি কে?
- কবিতার শুরুটা অবশ্য স্রষ্টার পেন্সিলের আঁচড়ে। তবে কবিতাটা এখনও খানিক অসম্পূর্ণ।
- অসম্পূর্ণ কেন!
- আসলে তুমি তো চর্যাপদ! একা কোন কবি তোমাকে লিখে শেষ করতে পারবেনা। যুগে যুগে নবরাগে তোমার পংক্তিমালা গাঁথা হবে।
- একজন কবি কি একটি মহাকাব্য শেষ করতে পারেনা?
- পারবেনা কেন! অবশ্যই পারে। তবে তাতে প্রকৃত প্রেম থাকতে হবে। ভালোবাসার পরশ না থাকলে একজন কবির পক্ষে একটি মহাকাব্য রচনা সম্ভব নয়।
- তাহলে কি আর করা! আমার মহাকাব্য অসম্পূর্ণই থাক।
- অসম্পূর্ণ থাকবে কেন! তুমি চাইলে আমি তোমাকে পরিপূর্ণ করতে পারি। শেষ পংক্তিগুলো না হয় আমিই লিখে দেবো।
- না বাবা! নবীণ কবিতে আমার বিশ্বাস নেই। শেষে আবার ছন্দে তালগোল পাঁকিয়ে ফেলবে।
- দেখ, আমি স্বভাব কবি। ছন্দ আমার ধমনীতে। স্বরবৃত্ত-অক্ষরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত সব আমার নখদর্পণে। তুমি চাইলে অমিত্রাক্ষর ছন্দেও লিখে দিতে পারি।
- তবুও বিশ্বাস নেই।
- চোখটা বন্ধ করবে?
- চোখ বন্ধ করবো কেন?
- বিশ্বাস রাখতে পারো, কবিতায় কোন কালিমা লাগবেনা।
- আচ্ছা বন্ধ করলাম।
- এবার তাঁকাও। নদীর জলে মুখটা দেখো। কোন পরিবর্তন ধরা পড়ে কি?
- হুম। কপালের ছোট কালো টিপটা ডান থুতনিতে বসিয়ে দিয়েছো। দেখে মনে হচ্ছে একটি ছোট্ট তিল। দেখতে তো ভালোই লাগছে!
- দেখলে তো কতো সহজেই এক পংক্তি লিখে দিলাম। চাইলে আরো লিখে দিতে পারি।
- হুম। আজ এটুকুই থাক। বাকিটা না হয় অন্য দিন লিখো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা আমার লেখনীকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। দয়া করে অশালীন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।