ফার্মের মুরগীর মতো আর দশটা শহুরে শিশুর মতোই বদ্ধ পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা। তারপরও অল্প কিছুদিন দুরন্ত শৈশবের খানিক পরশ পেয়েছিলাম বন্ধু এমরানের সৌজন্যে।
আমার যখন পাঁচ বছর বয়স, বাবা সিলেটের শহরতলী আখালিয়ার হাওলাদার পাড়ায়
(বর্তমানে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্গত) মজুমদার ঠিলার পাদদেশে নতুন বাসা
বানিয়েছেন। গুটিকয়েক পরিবার মাত্রই এখানে বসত গড়তে শুরু করেছে। অল্প সংখ্যক বাড়ি
থাকায় এলাকাটা এক অর্থে খুবই নীরব ও শান্ত।
আমাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরেই থাকতো এমরান। ওর বাবা এখানকার একটা
নার্সারিতে কাজ করতেন। সেই সুবাদে ওরা ওই নার্সারিতেই ছোট্ট একটা বাঁশের বেড়া দেয়া
ঘরে থাকতো। সে আমার থেকে হয়তো দু-এক বছরের বড় হয়ে থাকতে পারে। অল্প কিছুদিনের
মধ্যেই তার সাথে আমার বেশ ভাব হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে
ওদের নার্সারিতে চলে যেতাম। ওদের নার্সারিতে বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা ছিল। তবে
নারকেল গাছের চারাই ছিল সংখ্যায় বেশী। এমরানের বাবাকে দেখতাম কোদাল দিয়ে জমির মাটি
আলগা করে দিতে, নিড়ানি দিয়ে গাছের আগাছা পরিস্কার করে দিতে।
এমরানদের নার্সারির
পেছনেই ছিল একটা অগভীর কিন্ত প্রশস্ত ছড়া (ছোট ঠিলার মাঝ দিয়ে চলা ছোট প্রাকৃতিক খালকে
ছড়া বলে।)। প্রায় প্রত্যেকদিন এমরান ও আমি ওর বড়শী নিয়ে ওই ছড়াতে চলে যেতাম। এমরান
মাটি খুঁড়ে জির (কেঁচো) খুঁজে বের করতো। তারপর সেটা বড়শীর মাথায় গেঁথে দিয়ে বড়শীর
সুতাটা পানিতে ফেলে দিতো। ছড়াতে যে খুব একটা মাছ ছিলো তা নয়, প্রত্যেকদিন যে মাছ
ধরা পড়তো তাও নয়। মাঝে মাঝে ট্যাংরা, পুঁটি আর ভাগ্য ভালো হলে
বড়জোড় কই মাছ ধরা পড়তো।
একদিন হয়েছে কি, প্রথমে কয়েকটা পুঁটি মাছ ধরে আমরা তা
রাখলাম বাঁশের ঝুড়িতে। তারপর মোটামুটি বড় দুইটা কই মাছ ধরা পড়লে তাও রাখলাম ওই
ঝুড়িতে। তারপর আরো কিছু পুঁটি মাছ ধরা পড়লে সেগুলোও রাখা হলো ঐ ঝুড়িতে। ঝুড়ির মুখটা কলসের মুখের মতো সরু ছিল, তাই বাইরে থেকে ভেতরটা ভালো করে দেখা যাচ্ছিলোনা। সেদিনের মতো মাছ ধরা
শেষ হলে এমরানদের নার্সারিতে ফিরে কয়েকটা নারকেলের চারার আড়ালে দাঁড়িয়ে মাছভর্তি ঝুড়িটা
মাটির দিকে উপোর করে ঢালতেই আমরা দুজনে তাজ্জব হয়ে গেলাম। মাটিতে শুধুমাত্র দুটো
কই মাছ লুটোপুটি খাচ্ছে, সব পুঁটি মাছ উধাও! আমরা হতভম্ব হয়ে একে-অপরের দিকে
আশ্চর্য্য চোখে তাকিয়েই ভয় পেয়ে দিলাম ভোঁ-দৌড়। আজ ভাবলে হাসি পায়, আমরা তখন কি আর জানতাম কই মাছ একটি রাক্ষুসে মাছ!
প্রায়দিনই কাদা-পানিতে নেয়ে যখন বাসায় ফিরতাম তখন সূর্য্য ঠিক মাথার উপরে
থাকতো। চুপিচুপি ঘরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম, আগ বাড়িয়ে মাকে ডাকতাম না। তারপর
মা দেখতে পেলে খানিকটা উত্তম-মধ্যম দিয়ে স্নান করাতেন। স্নান করার পর সবচেয়ে
বিরক্ত লাগতো গায়ে সরিষার তেল দেয়া। তখনও বডি লোশনের এতোটা প্রচলন হয়নি। সরিষার
তেল গায়ে-মুখে দিলে খুব জ্বলতো, যা আমার খুব অস্বস্তি লাগতো। তারপর খাইয়ে-দাইয়ে মা
আমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতেন। আমিও লক্ষী ছেলের মতো ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতাম, আর তক্কে তক্কে থাকতাম মা কখন ঘুমোবেন। যখন মোটামুটি নিশ্চিত হতাম মা
ঘুমিয়ে পড়েছেন তখন পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নেমে বেতের মোড়াটাকে দরজা পর্যন্ত
নিয়ে যেতাম, তারপর মাঝখানের ছিটকিনি খুলেই দিতাম দৌড়। বাইরে আগে থেকেই অপেক্ষা
করতো এমরান। তার হাতে থাকতো ঘুড়ি, নাটাই। এমরান আর আমি তরতর করে উঠে যেতাম
মজুমদারের ঠিলায়। ঠিলা দিয়ে উঠার সময় মাঝে মাঝে চোখে পড়তো বনমোরগ। বনমোরগের কথা
এখন চিন্তা করাই কল্পনা। ঠিলা বেয়ে উপরে উঠতে আমার খুব কষ্ট হতো। এমরান আমাকে হাত
ধরে ধরে উপরে নিয়ে যেতো। উপর উঠে আমরা একটা শিমুল তুলা গাছের নিচে দাঁড়াতাম। আমি
ঘুড়ি উড়াতে পারতাম না। এমরানের হাতে থাকতো নাটাই। আমার কাজ ছিল সুতাসহ ঘুড়িকে
খানিক দূর নিয়ে যাওয়া তারপর সেটাকে বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া। আর এমরান নাটাইকে নেড়ে
নেড়ে ঘুড়িকে বাতাসে ভাসিয়ে অনেক উচু পর্যন্ত উঠাতো। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত চলতো
আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো। যেদিন বেশী সন্ধ্যা হয়ে যেত, সেদিন ঠিলা থেকে নামার সময়
শেয়ালের মুখোমুখি হতে হতো। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যেতাম। এমরান আমাকে সাহস দিত, আর শেয়ালকে তাড়িয়ে দিত।
আমাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরে একটা চালতা গাছ ছিল। জায়গাটা খুব নীরব ছিল।
চালতা গাছের কাছাকাছি একটা বাড়ি থাকলেও সেই বাড়িতে কখনো মানুষজন দেখেছি বলে মনে
পড়ছেনা। তো মাঝে মাঝে আমি আর এমরান ঐ চালতা গাছের নিচে চলে যেতাম। প্রায়দিনই গাছের
নিচে চালতা পড়ে থাকতো। আমরা সেগুলো কুড়িয়ে নিতাম। চালতা গাছের পাশের পুকুরের লাল
শাপলা দেখে মুগ্ধ হতাম। এমরানকে দেখতাম শাপলার আঁটি পানি থেকে তুলে চিবুতে। আমার
ঘেন্না করতো তাই আমি চিবোতাম না।
এভাবেই আরো কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে আমার শৈশবের একটা মুহুর্ত্ব কেটেছিল।
তারপর একদিন এমরানরা নার্সারি ছেড়ে চলে গেল। আর সেই সাথে আমার দূরন্ত শৈশবের মৃত্যু ঘটলো। আমার বাবা-মা
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন আর আমি পরিণত হলাম সত্যিকারের ফার্মের মুরগীতে।
বন্ধু এমরান কোথায় আছে, কেমন আছে জানিনা। তবে এখনও ওকে অনেক মনে পড়ে। আমাকে
এক টুকরো দূরন্ত শৈশব উপহার দেয়ার জন্য তোকে অনেক ধন্যবাদ বন্ধু । যেখানেই থাকিস, ভালো
থাকিস বন্ধু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা আমার লেখনীকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। দয়া করে অশালীন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।