বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ়ের প্রথম হওয়ায় বৃষ্টির সাথে হালকা
ঝড়ো বাতাসও বইছে। টিনের চালে বৃষ্টির পানি বর্ষিত হওয়ার সময় এক মধুময় শব্দ
হচ্ছে। বৃষ্টির এই টাপুর-টুপুর শব্দ এমনই মাদকতায় আচ্ছ্বন্ন , যে ইচ্ছে করে
ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু মায়ের কড়া বারণ বৃষ্টিতে ভেজা যাবেনা। এমন
মনোহারা বৃষ্টিস্নাত দুপুরে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে পারলে অনেক ভালো লাগতো।
কিন্ত বিদ্যুৎ সেই যে গেছে আর আসার নামটি নেই। কাজেই একপ্রকার বাধ্য হয়ে
জানালার পাশে বিছানায় বসে রইলো প্রিয়ন্তি। সে একদৃষ্টে বাইরে চেয়ে রয়েছে।
সদ্য বেশ কয়েকটি কচুগাছ জানালের পাশের ঝোপমতো স্থানে গজিয়েছে। চাল থেকে
বৃষ্টির পানি কচুপাতার ওপর পড়েই নিমিষে চারদিকে গোলাকৃ্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
পাতাগুলো দেখলে বুঝাই যায়না এইমাত্র এগুলোতে পানি পড়েছিলো। দৃশ্যটা বেশ
মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো প্রিয়ন্তি। সে কিছুটা অবাকও হচ্ছিলো এইভেবে, অন্যগাছ
থেকেও পানি পড়ছে কিন্ত এতো তাড়াতাড়ি এভাবে গোল হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছেনা।
হঠাৎ প্রিয়ন্তির মনে পড়লো সে দিন ক্লাসে পরাগ স্যার পানির পৃষ্ঠটান নিয়ে
কি একটা লেকচার দিয়েছিলেন। সেখানে এরকম কি একটা ব্যাপার ছিলো। কিন্ত মনে
আসছিলো না। পেটে আসছে, মুখে আসছে না এইরকম অবস্থা। সে টেবিল থেকে পদার্থ
বিজ্ঞানের বই নিয়ে খুঁজে পেলো পৃষ্ঠটানের তত্ত্বটি।
তত্ত্বটি হচ্ছে“কোন কঠিন পৃষ্ঠের উপর তরল পদার্থ পড়লে দেখা যায় যে,তরলটি পৃষ্ঠের সর্বত্র ছড়িয়ে না পড়ে ফোঁটার আকার ধারণ করতে চায়। স্বল্প আয়তনের তরল পদার্থ সর্বদাই গোলকের আকৃ্তি গ্রহণ করে। এজন্যই শিশির বিন্দু, বৃষ্টির ফোঁটা, পারদ বিন্দু ইত্যাদির আকৃতি গোলাকার, কেননা নির্দিষ্ট আয়তনের তরলের মুক্ত তলের ক্ষেত্রফল গোলক আকৃ্তিতে সর্বনিম্ন হয়। সে কারণেই তরলবিন্দু আপনা থেকেই এমন জ্যামিতিক আকার গ্রহণ করে যেখানে ক্ষেত্রফল সর্বাপেক্ষা কম হয়।“
তত্ত্বটি হচ্ছে“কোন কঠিন পৃষ্ঠের উপর তরল পদার্থ পড়লে দেখা যায় যে,তরলটি পৃষ্ঠের সর্বত্র ছড়িয়ে না পড়ে ফোঁটার আকার ধারণ করতে চায়। স্বল্প আয়তনের তরল পদার্থ সর্বদাই গোলকের আকৃ্তি গ্রহণ করে। এজন্যই শিশির বিন্দু, বৃষ্টির ফোঁটা, পারদ বিন্দু ইত্যাদির আকৃতি গোলাকার, কেননা নির্দিষ্ট আয়তনের তরলের মুক্ত তলের ক্ষেত্রফল গোলক আকৃ্তিতে সর্বনিম্ন হয়। সে কারণেই তরলবিন্দু আপনা থেকেই এমন জ্যামিতিক আকার গ্রহণ করে যেখানে ক্ষেত্রফল সর্বাপেক্ষা কম হয়।“
ক্লাসে পড়ার সময় ব্যাপারটা একটুও মাথায় ঢুকেনি। অথচ বাস্তবে প্রমাণ
পেতেই পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেলো। এখন আর সহজে এই তত্ত্বটা মাথা থেকে
হারিয়ে যাবেনা। আসলে তত্ত্বীয় পড়াশোনার চেয়ে ব্যবহারিক পড়াশোনাটা অনেক বেশী
কার্যকর।
বৃষ্টির বেগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এমন মাদকতাময় বৃষ্টিস্নাত দুপুরে
প্রাণখুলে গাওয়া উচিত বৃষ্টির জয়গান। জীবনে প্রথমবারের মতো গান গাইতে না
পারায় ওর আফসোস হলো। বিদ্যুৎ চলে আসতেই প্রিয়ন্তি ডিভিডি প্লেয়ারে ছেড়ে
দিলো রবীন্দ্র সংগীত।
আজি ঝর ঝর মুখর বাদরদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতেই কেন মন লাগে না ।।
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ঐ বলাকার পথখানি নিতে চিনে ।।
মেঘমল্লারে সারা দিনমান
বাজে ঝরনার গান ।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা- মন চায়
মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে ।।
জানি নে, জানি নে কিছুতেই কেন মন লাগে না ।।
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ঐ বলাকার পথখানি নিতে চিনে ।।
মেঘমল্লারে সারা দিনমান
বাজে ঝরনার গান ।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা- মন চায়
মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে ।।
কবিগুরুর এই গান শুনতে শুনতে প্রিয়ন্তি এক ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যায়। মনটা
যেন উদাস হয়ে যায়। আবারো ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজতে। ইচ্ছে করে বৃষ্টির
আহবানে বেরিয়ে পড়তে। এবার ভীষন রাগ হয় মায়ের উপর। শরীর খারাপ করলে ওর করবে
উনার কি! প্রিয়ন্তি মাকে মনে মনে কিছুক্ষণ বকাঝকাও করলো, “এই দুষ্টু মেয়ে
জ্বর আসলে আমার আসবে তোমার তাতে কি! আমি কি তোমাকে কিছুতে বারণ করি, তাহলে
তুমি কেন এমন করো! তারপর বকাঝকা বন্ধ করে লক্ষী মেয়ের মতো মনে মনে বলে, “মা
বৃষ্টিতে একটূ ভিজতে দাওনা”।
প্রিয়ন্তি মায়ের অনুমতির অপেক্ষা না করে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ে। তাদের এই
শহরটা অনেকটা গ্রাম্য আদলে তৈরি। ছোট ছোট টিলা আর গাছগাছালির সমাবেশ
চারপাশে। ওদের বাড়িটাও শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে। বাড়ির পেছন দিয়ে বেরুলে
শহরের অস্তিত্ব আর থাকেনা। একপাশে নিচু জমি আর আরেকপাশে ছোট টিলা।
প্রিয়ন্তি হলুদ ডোরাআঁকা লাল শাড়ি পড়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। প্রবল
বৃষ্টিতে ও পুরোপুরি ভিজে গেছে। ভেজা শাড়ি গায়ের সাথে লেপ্টে শরীরের
কারুকার্যময় গোপন ভাঁজগুলো দেহময় ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু সেদিকে প্রিয়ন্তির
কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে রাস্তার কাদামাটি মাড়িয়ে ছুটে চলেছে। কাদামাটি পায়ে
লেগে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। বৃষ্টির ছোঁয়া ওকে মাতাল করে দিয়েছে। পাশ দিয়ে
যাওয়া একটি লোক লোলুপ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাঁকাচ্ছে। লোকটির খারাপ চাহনী
প্রিয়ন্তির বুঝতে কষ্ট হলোনা। সে দ্বিগুন উৎসাহে আরো জোরে জোরে হাটতে
লাগলো। কাদা-পানি লোকটির শরীরে পড়তেই লোকটি বিরক্ত হয়ে পালালো।
রাস্তা পেরিয়ে একটি বাড়ির পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালো। সারি সারি সুপারি আর
নারকেল গাছ পুকুরটাকে পর্দা দিয়ে রেখেছে। পুকুরের পানিতে বৃষ্টি পড়ে
অদ্ভুতভাবে নেচে উঠছে। ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে। হাওয়ায় ভেসে এলো ইলিশ ভাজার
গন্ধ। কেউ হয়তো আয়েশ করে খিচুড়ি আর গরম গরম ইলিশ ভাজা খাচ্ছে। হঠাৎ
প্রিয়ন্তির চোখে পড়লো পুকুরের পাশে একটি গাছে অনেক জাম ঝুলে আছে। ইলিশের
গন্ধে জিভে পানি না আসলেও জাম দেখে পানি এসে গেলো। কিন্ত গাছের ধারে যেতে
সাহস পাচ্ছিলোনা। যদি কেউ এসে পড়ে তাহলে আর রক্ষে নেই। তারপরও সাহস করে
গুটিপায়ে জাম গাছের দিকে এগিয়ে যায় প্রিয়ন্তি।
পাকা কালো জামগুলো যেন ওকে ডাকছে, “এসো তুমি মোর কাছে হে প্রিয়া!”
কিন্ত হাত দিয়ে সে নাগাল পাচ্ছিলোনা। লাফিয়েও কাজ হচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত
একটি লাঠি দিয়ে একগুচ্ছ জামে আঘাত করতেই বেশ কয়েকটি ডাউস আকারের জাম নিচে
পড়লো। প্রিয়ন্তি খুশিতে আটখানা হয়ে জাম কুড়োচ্ছে। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই
দেখলো এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। মুখের দিকে তাঁকাতেই প্রিয়ন্তি বেশ অবাক হলো।
মানুষ এতো সুন্দর কি করে হয়! প্রিয়ন্তির মনে হয় এতো সুন্দর ছেলে সে জীবনে
একটিও দেখিনি।
এতোক্ষণে প্রিয়ন্তির খেয়াল হয় ও পুরোপুরি ভিজে গেছে। শাড়িটা শরীরের সাথে
সেটে আছে। সম্পূর্ণ দেহসৌষ্ঠব প্রায় উম্মুক্ত হয়ে আছে এক অচেনা যুবকের
সামনে। সে শাড়ির আচল টেনে শরীর ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
প্রিয়ন্তি লক্ষ্য করে ছেলেটি ওর মুখপানে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে মিটিমিটি
হাসছে। এ চাহনীর মধ্যে একটুও কদর্যতা নেই, বরং মিষ্টি হাসির মধ্যে নমনীয়
মাধুর্য্যতা আছে। প্রিয়ন্তি বলতে চাইছিলো, এই ছেলে তুমি এক্ষুনি চলে যাও
নাহলে তো আমি তোমার প্রেমে পড়ে যাবো!
প্রিয়ন্তি এক মুহূর্ত্ব দেরী না করে দৌড়ে রাস্তায় চলে আসে। সুপারি গাছের
আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখে ছেলেটি তখনো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুপারি গাছে থাকা
লতা বেয়ে বৃষ্টিকনা মুক্তোদানার মতো বিন্দু বিন্দু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে
প্রিয়ন্তির মুখাবয়বে। প্রিয়ন্তি বিড়বিড় করে বলে, “হে বৃষ্টি, হে বর্ষা, হে
কবিগুরু আমি এ যুবককে এক দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাদের কাছে প্রার্থনা
আমি যেন এ স্বপ্নকুমারকে একান্ত আমার করে পাই। হে স্বপ্নকুমার, আমি
বৃষ্টিকন্যা হয়ে তোমার হৃদয়ে থাকতে চাই চিরদিন”।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা আমার লেখনীকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। দয়া করে অশালীন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।