প্রিয়তমেষু,
আজ সকাল থেকেই ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষার এই সময়টাতে অবিরাম বৃষ্টি
হওয়ার কথা থাকলেও কোন এক অদৃশ্য কারনে গত সপ্তাহখানেক একফোঁটাও বৃষ্টি
হয়নি। এটা কি শুধুই প্রকৃতির বে-খেয়াল নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বুঝা
মুশকিল! সে যে কারনই হোক আজ কিন্তু মনের মতো করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরঝির
বৃষ্টির তালে তালে প্রায়ই নেচে উঠছে মানকচুগুলো। হলুদ কৃষ্ণচূড়ার গাছটিও
অদ্ভুত ছন্দে দুলছে।
আজ বৃষ্টি সকালে বৃষ্টি দেখে ভেবেছিলাম ক্যাম্পাসে
যাবো কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ইচ্ছে করলোনা। মনে আছে ক্যাম্পাসের বৃষ্টিভেজা
দূর্বাঘাস তুমি কত্তো পছন্দ করতে? জুতোজোড়া দূরে ফেলে আলতা রঙে রাঙ্গানো পা
মেলে ছুটে চলতে দূর্বা মাড়িয়ে। তোমার নিশ্চয় মনে আছে ক্যম্পাসের সেই কদম
গাছটির কথা। সৌন্দর্য্যহানির দোহাই দিয়ে কর্তৃপক্ষ সেই গাছটি কেটে ফেললো এই
ক’দিন আগে। সত্যি বলতে কি গাছটা এমন এক অবস্থানে ছিলো যে আমারও দেখতে ভালো
লাগতোনা। কিন্তু এই কদম গাছটিকে তুমি এতোটাই ভালোবাসতে যে আমি সাহস করে এই
অপছন্দের কথা কখনো বলতে পারিনি। ছোট্ট হলুদ বলের মতো দেখতে ওই ফুলে তুমি
কি যে খুঁজে পেতে তা আমার কাছে আজও রহস্য! আমার প্রায়ই মনে হতো তুমি আমার
চেয়ে ওই কদম গাছকেই বেশী ভালোবাসতে। ঝুম বৃষ্টিতে তুমি যখন ওই গাছ পানে
মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে তখন আমার দারুন হিংসে হতো। মনে হতো একটা সাধারণ
উদ্ভিদ আমার ভালোবাসায় ভাগ বসাচ্ছে! তখন ইচ্ছে হতো গাছটি কেটে ফেলি। তোমাকে
এ ভাবনাগুলো ঘুণাক্ষরেও জানতে দেইনি। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, সেই
প্রতিদ্বন্ধী কদম গাছটি যেদিন সত্যি সত্যি আমার চোখের সামনে কেটে ফেলা হলো
সেদিন আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। গণিত বিভাগের সামনে জন্মানো তোমার
প্রিয় দূর্বাঘাসগুলোও আজ আর নেই। আসলে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। তুমি
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে তোমার প্রিয় দুটো জিনিসও আমাকে ত্যাগ করে চলে
গেলো।
তুমি যেদিন আমার কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে গেলে সেদিনটিও ছিলো
এমন বৃষ্টিস্নাত। তুমি বলেছিলে, তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। শুধু এতোটুকুই,
আর কিছু নয়। সেশনজটের করালগ্রাসে আবদ্ধ আমার পক্ষে তোমাকে জীবনসাথীরূপে
গ্রহণ করার সাহস ছিলোনা। আমি শুধু তোমার অশ্রুসিক্ত নয়নপানে চেয়ে ছিলাম।
তুমিও শুধু অবাক বিষ্ময়ে নিষ্পলক চেয়ে ছিলে। আজ এতোবছর পর মনে হয় আমি সেদিন
তোমার চোখের ভাষা সঠিকভাবে পড়তে পারিনি। তোমার সেই না বলা গভীর চাহনীর
মধ্যে ছিলো একটি সুন্দর ও পবিত্র আকুতি। তোমাকে হারানোর আসন্ন যন্ত্রনায়
আমি এতোটাই কাতর হয়ে গিয়েছিলাম যে তোমার সেই আকুতি আমি বুঝতে পারিনি।
চিরকালের নির্বোধ আমি হয়তো তোমার চাহনীর মানে বুঝিনি কিন্তু তুমি তো পারতে
মুখ ফুটে কথাটি বলতে। আমি জানি তুমি বড্ড অভিমানী। হয়তো সেই অভিমান থেকেই
তুমি কিছু বলোনি।
আজ আমার বেকারত্ব ঘুচেছে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এসেছে। বউকে দামী কাপড়,
দামী গহনা কিনে দিচ্ছি, ছেলে-মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াচ্ছি কিন্তু এতোসব
পাওয়ার মধ্যেও তোমাকে না পাওয়ার বেদনা আমাকে সবসময় কুঁকড়ে খায়। একটা কথা
জানো আমার মেয়েটা না ঠিক তোমার মুখের আদল পেয়েছে। হয়তো সঙ্গমের কোন এক
চূড়ান্তলগ্নে অবচেতন মনে তোমাকেই স্ত্রীরূপে কল্পনা করেছিলাম। স্ত্রী আমার
সুন্দরী, সুশিক্ষিত। তবে প্রায়ই মনে হয় ব্যক্তিত্ত্বের দিক দিয়ে ও কোনভাবেই
তোমার ধারেকাছেও যাবেনা। তোমার সেই অবাক অভিব্যক্তিমাখা সুন্দর চাহনী আমি
ওর মধ্যে প্রায়ই খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু না কোনভাবেই সেই তোমাকে ওর মধ্যে
খুঁজে পাইনা।
ছোট ছেলেটা পাশের ঘরে ভীষণ কাঁদছে। ছেলেটা আবার বাপের ভীষন ন্যাওটা।
এবার কলম ছেড়ে তাই আমাকে পিতৃদায়িত্ব পালন করতে যেতে হবে। কাজেই তোমাকে
লেখা এ চিঠি এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। আগামী বর্ষার প্রথম বাদল দিনে
ক্যাম্পাসে আসার নিমন্ত্রণ দিয়ে আজকের মতো কলম রাখছি।
ইতি
তোমারই প্রেমাংশু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা আমার লেখনীকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। দয়া করে অশালীন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।