আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে

Latest News:

বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সিলেটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবকাশ যাপনের জন্য আসামের তৎকালীন রাজধানী শৈলশহর শিলং এলেন। তার সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী। শিলং এর পার্শ্ববর্তী শহর সিলেটে এই খবর চাউর হয়ে গেলো দ্রুততম সময়ে। সিলেটের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে একটা চাপা উত্তেজনা বইতে শুরু করলো। কবিগুরু এতো কাছে এসেছেন। কোনভাবেই এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায়না। যেভাবে হোক রবি ঠাকুরকে সিলেটে আনতেই হবে।

সিলেট ব্রাক্ষসমাজের তৎকালীন সম্পাদক গোবিন্দ নারায়ন সিংহ কবিকে সিলেট পদার্পণের নিমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিগ্রাম করলেন। কিন্তু বাধ সাধলো তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভৌগলিক দিক দিয়ে সিলেট শিলং এর কাছাকাছি হলেও সিলেট পর্যন্ত সরাসরি রাস্তা ছিলোনা। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি পর্যন্ত সড়ক ছিল। চেরাপুঞ্জি থেকে খাসিয়ারা ব্যক্তিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার একটি পদ্ধতি প্রচলন ছিলো। কিন্তু এ ব্যবস্থা মানবাধিকারের লংঘন বলে কবি সরাসরি নাকচ করেন এবং সিলেট থেকে প্রেরিত নিমন্ত্রণ বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন।

কবির নেতিবাচক উত্তর পেয়ে গোবিন্দ নারায়ন সিংহ আনজুমানে ইসলাম, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংঘটনের সাথে যোগাযোগ করে কয়েকটি টেলিগ্রাম পাঠান। আবেগঘন টেলিগ্রামগুলো কবির হৃদয়কে প্রভাবিত করে। তিনি সিলেট আসার দীর্ঘ অথচ বিকল্প পথ গৌহাটী থেকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লামডিং-বদরপুর সেকশন হয়ে করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে সিলেট পৌছানোর পথে সিলেট আসতে রাজী হন।

৩১ অক্টোবর কবিগুরু শিলং থেকে গৌহাটী অভিমূখে যাত্রা করেন। সেখানে কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়। দিন তিনেক সেখানে অবস্থান করে কবি ৩ নভেম্বর গৌহাটী থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। গৌহাটী থেকে সিলেটের পথ প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই কবিকে এক পলক দেখার জন্য ভক্তদের ভিড় লেগে যায়। সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধিদল কবিগুরুকে এগিয়ে আনতে বদরপুর পর্যন্ত যায়। ট্রেন কুলাঊড়া জংশনে পৌছালে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। কবি ও তার সহযাত্রীরা কুলাঊড়াতে রাত্রিযাপন করেন।

কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য অভ্যর্থন পরিষদ গঠন করা হয়। সভাপতি নিযুক্ত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ। ৫ নভেম্বর সকালে ট্রেন সিলেট স্টেশনে পৌছালে কবিগুরুকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ, মৌলভী আব্দুল করিম, রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্ত, এহিয়া ভিলা, কাজী বাড়ি ও মজুমদার বাড়ী, দস্তিদার বাড়ির অভিজাত ব্যক্তিবর্গ। সিলেট মহিলা সমাজের পক্ষে অভ্যর্থনা জানান নলিনীবালা চৌধুরী।

সুরমা নদীর উপর ঐতিহ্যবাহী কীনব্রীজ তখনো হয়নি। কবিগুরু ও তার সহসঙ্গীরা বজরায় সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে মূল সিলেট শহরে প্রবেশ করেন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চাঁদনীঘাটকে পত্র-পুষ্প পতাকা, মঙ্গল ঘট আর লাল শালু দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি মৌলভী আব্দুল করিমকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি সুসজ্জিত ফিটন গাড়িতে করে শহরের উত্তর-পূর্বাংশে ছোট টিলার উপর পাদ্রী টমাস সাহেবের বাংলোর পাশে একটি বাড়িতে যান। এখানেই কবির থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেখানে পৌছালে কবিকে সঙ্গীত ও চন্দন তিলকের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় ব্রাহ্মসমাজের আমন্ত্রণে কবি তাদের উপাসনায় যোগ দেন। পরদিন ৬ নভেম্বর সকালে লোকনাথ টাউনহলে কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সৈয়দ আব্দুল মজিদ। অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন নগেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনন্দনের জবাবে বক্তৃতা প্রদান করেন যা পরে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ‘বাঙালির সাধনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। একইদিন দুপুরে মুরারীচাঁদ কলেজের (এম.সি কলেজ) বাংলা ও সংস্কৃতের অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রীর  আমন্ত্রণে কবি তার বাড়িতে যান। বেলা দুইটায় ব্রাহ্মসমাজগৃহে সিলেট মহিলা সমিতি আয়োজিত সংবর্ধনায় যোগ দেন।

এরপর কবি শহরের উপকন্ঠে মাছিমপুর এলাকায় মনিপুরী পল্লীতে যান। কবির সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী রমনী কর্তৃক পরিবেশিত রাসনৃত্য মুগ্ধ হন। এখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিগুরু পরবর্তীতে শান্তি নিকেতনে মনিপুরী নৃত্য চালু করেছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে ১৯২০ সালে কবিগুরু তৎকালীন সিলেট জেলার কমলগঞ্জ থানার বালিগাও গ্রামের মণিপুরী নৃত্যগুরু নীলেশ্বর মুখার্জী, ত্রিপুরা থেকে গুরু বুদ্ধিমন্ত সিংহ ও আসামের গুরু সেনারিক সিংহ রাজকুমারকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান প্রশিক্ষক হিসেবে।

পরদিন সাত নভেম্বর সকালে সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌহাট্টার বিখ্যাত সিংহ পরিবারের এক নবজাতকের নামকরণ অনুষ্ঠানে কবি যোগদান করেন। এদিন দুপুরে মুরারিচাঁদ ছাত্রাবাসে কলেজের ছাত্র-শিক্ষকমন্ডলী কবিগুরুকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। কলেজের ছাত্ররা একটি শোভাযাত্রা করে গীতবাদ্য সহকারে সভামন্ডপে নিয়ে আসেন। অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রী সরচিত কবিতা পাঠ করেন। কবিকে একাধিক মানপত্র প্রদান করা হয়। অভিনন্দনের উত্তরে কবি সুদীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করেন। পরবর্তীতে এই বক্তব্য শান্তিনিকেতন পত্রিকার ১৩২৬ সালের পৌষ সংখ্যায় ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে প্রকাশিত হয়। এমসি কলেজের সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে পরবর্তীকালের একজন বিখ্যাত বহুভাষী রমসাহিত্যিক তন্ময় হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য শুনছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার গুণমুগ্ধ সেই ভক্তকে শান্তিনিকেতনে আসার কথা বলেন। ১৯২১ সালে সেই ছাত্র শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন এবং রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেন। তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী।

সভাশেষে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ অপূর্বচন্দ্র দত্তের আতিথ্যগ্রহণ করে তার বাসায় পদার্পন করেন। পরে শহরের গণমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে রায়বাহাদুর নগেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাসায় এক প্রীতিসম্মেলনে যোগ দেন। পরদিন আট নভেম্বর  কবিগুরু সিলেট থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার উদ্দেশ্যে সিলেট ত্যাগ করেন। আর বিমুগ্ধ নয়নে পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকেন তার গুণমুগ্ধরা।

মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়'

ঊনবিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ। ব্রিটিশ শাসনের প্রায় একশত বছর হতে চললো। এরই মধ্যে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় তৈরী হয়েছে এক নব্য ধনীকশ্রেণি যারা কাঁচা পয়সার গরমে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। মদ আর নারীতে দিনরাত ডুবে থাকে। দিনে কোন কাজ থাকুক আর না থাকুক সন্ধ্যে নামলেই বাঈজী বাড়ি, বেশ্যালয় আর মদের ফোয়ারার উদ্দেশ্যে এরা বেরিয়ে পড়ে।
এই ধনিকশ্রেণির সমান্তরালেই গড়ে উঠলো ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত একটা সমাজ। যদিও এই শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে অনেকেই ধনীর দুলাল, তারপরও ঈশ্বরচন্দ্রের মতো অনেকেই উঠে এসেছেন একেবারে অজপাড়া গা থেকে।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের শিক্ষাব্যবস্থাটাই ছিলো কেরানী তৈরীর কারখানা। হাজার হোক তারা রাজার জাত! অফিস আদালতের কেরানীর কাজ কী তাদের সাজে! তাই ব্রিটিশদের ছত্রছায়াতেই চলল কেরানী তৈরির স্কুল কলেজ। কিন্তু যোগ্যতা থাকলে ঠেকায় কে! বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও নিজেদের যোগ্যতাবলে কিছু সংখ্যক স্থানীয় লোক ব্রিটিশ রাজের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে! ব্রিটিশ সাহেবদের সমকক্ষ পদে চাকরী করবে নেটিভরা! ব্রিটিশরা তা মানবে কেন! তাই যতোই যোগ্যতা থাকুক একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে তাদের পদোন্নতি দেয়া হতোনা। সিনিয়র নেটিভদের চোখের সামনেই জুনিয়র ইংরেজরা উচে পদে বসে যেতো। কিন্তু চেয়ে দেখা ছাড়া আর কীইবা করার আছে! রন্ধ্রে রন্ধ্রে এভাবে বঞ্চিত করলেও কেউ কেউ এই ধারার পরিবর্তন করতে চাইলেন! এই নব্য শিক্ষিতদের মধ্য থেকেই একে একে বেরিয়ে এলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কালিপ্রসন্ন সিংহ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হরিশচন্দ্র মূখার্জীর মতো এমন কিছু মানুষ যারা শুধু নিজেদের সুখ নিয়েই স্থির থাকতে পারলেন না। এদের হাত ধরেই বাংলা ও বাঙালির জীবনে একে একে নব জাগরণ আসতে শুরু করলো। এ চরিত্রগুলোর কেউই বিতর্কের উর্ধ্বে নয়, তারপরও এক কথায় নির্দ্বিধায় বলা যায় এদের হাত ধরেই বাঙালির জীবনে এক নব ফল্গু ধারা বয়েছিলো। এদের হাত ধরেই বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি জগতে এলো আমূল পরিবর্তন। অনেক সামাজিক কুসংস্কার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো কেউ কেউ কথা বলতে শুরু করলেন এবং সফলতাও পেতে শুরু করলেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘সেই সময়’ উপন্যাসে বাংলার সেই সময় অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ (১৮৪০-১৮৭০) সময়কালের বাংলাকে তুলে ধরা হয়েছে। নবীনকুমার নামের এক বালকের জন্মের বর্ণনা দিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনী শুরু। সুনীল গাঙ্গুলী এই নামটি ছদ্দনাম হিসেবে ব্যবহার করলেও কাহিনীর গভীরে প্রবেশ করতেই বুঝা যায় এই ‘নবীনকুমার’ চরিত্রটি বাংলার এক বিখ্যাত ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কালীপ্রসন্ন সিংহ। তিনি হুতোমপ্যাচা নামেই সমধিক পরিচিত। তিনিই প্রথম সুললিত, শুদ্ধ ও মার্জিত বাংলায় মহাভারত অনুবাদ করেন। তবে তার বিখ্যাত গ্রন্থ “হুতোমপ্যাঁচার নক্সা”। এই গ্রন্থে অনেকটা কথ্য ভাষায় তিনি তৎকালীন নব্য বাবু সমাজের বিভিন্ন মুখোশ উন্মোচন করেছেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ অর্থাৎ নবীনকুমার চরিত্রটি উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ অবধি ছিলো। মূলত তাকে আবর্তিত করেই সুনীল গাঙ্গুলী পুরো উপন্যাসটি বিন্যস্ত করেছেন।

এই উপন্যাসের আরেকটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্রের সমাজ সংস্কারমূলক কাজগুলোর বর্ণনা চিরকাল আমরা পরীক্ষা পাশের জন্য ইতিহাস বই থেকে গলধকরন করে এসেছি। কিন্তু এই মহৎ কাজগুলো করতে তাকে পদে পদে কতো লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে, কতো কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে তা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি। সেই সময়ে সুনীল গাঙ্গুলী সেই কাজগুলোকে ইতিহাসের রসকষহীন উপাদানের মতো নয়, একদম জীবন্ত তুলে এনেছেন। হিন্দু বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন, বহু বিবাহের বিরোধীতা, শিক্ষা বিস্তারে একের পর এক স্কুল প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অনবদ্য অবদানগুলো খুব নিখুঁত আকারে কাহিনী আকারে উঠে এসেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এই উপন্যাসের শেষাবধী ছিলেন।

সেই সময় উপন্যাসের আরেকটি ক্ষ্যাপা চরিত্র মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনিও দাপটের সাথে পুরো উপন্যাসে বিরাজিত ছিলেন। মধুসূদনের উশৃংখল জীবন, ইংরেজী ভাষার মহাকবি হওয়ার বাসনায় হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ, তারপর অনেক পুড় খেয়ে কলকাতা ছেড়ে মাদ্রাজে গমন, প্রায় মধ্য ত্রিশে আবার কলকাতায় প্রত্যাগমন, ভাগ্যের ফেরে বাংলা সাহিত্যের সাথে জড়িয়ে যাওয়া, অতঃপর শর্মিষ্ঠা’র মতো প্রথম সার্থক বাংলা নাটক, মেঘনাদবধ কাব্যের মতো কালজয়ী সব রচনা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটগুলো খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে উঠে এসেছে এই উপন্যাসের বিস্তৃত জমিনে। কথিত চাষাভূষোদের ভাষাই তাকে দিলো মহাকবির তকমা! একেই বলে অদৃষ্ট। বাংলা ভাষায় তার সাহিত্য চর্চা খুব বেশীদিনের নয়। এ যেন এলাম দেখলাম আর জয় করলাম।

এই উপন্যাসের তুলনামূলক কম আকর্ষনীয় চরিত্র হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম ধর্মকে তিনি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। মূলত তার হাত ধরেই ব্রাহ্ম ধর্ম ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এখানে দেখা যাবে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ব্রাহ্ম ধর্মও কুসংস্কার ও প্রচলিত রীতি থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে বেরিয়ে আসতে পারেনা। সময়ের পরিক্রমায় ব্রাহ্মধর্মেও ভাঙ্গন ধরে।

এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছেন ডিরোজিও শিষ্যরা। ডিরোজিও ছিলেন একজন পর্তুগীজ শিক্ষক। তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজের প্রথম দিককার শিক্ষক। এই তরুন শিক্ষকের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে তার একশ্রেণির অনুগামী তৈরি হয়। ডিরোজিওর সেই শিষ্যরা ইয়াং বেঙ্গল নামে পরিচিত ছিলেন। ইয়াং বেঙ্গলের সদস্যরাই প্রথম হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার ও অনিয়মগুলোর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেন। এদের পদাংক অনুসরন করেই পরবর্তীতে অন্যরা অগ্রসর হয়েছেন। ডিরোজিও শিষ্যদের মধ্যে রয়েছেন দক্ষিনারঞ্জন মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামগোপাল ঘোষ এর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা।

উপন্যাসটির কাহিনী পরিক্রমায় আমরা নিখুঁত বর্ণনা পাই সিপাহী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর। সিপাহী বিদ্রোহের ঢামাঢোলের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য দেখা যায় বাংলার মুসলিম নব জাগরণের দুই দিকপাল সৈয়দ আমীর আলী ও নওয়ার আব্দুল লতিফ কে।

ঐতিহাসিক চরিত্র না হলেও উপনাসটির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে গঙ্গানারায়ন, বিধুশেখর মুখার্জী, রাইমোহন, দুলালচন্দ্র, দিবাকর, কুসুমকুমারী, হীরা বুলবুল, চন্দ্রনাথ ওরফে চাদু, কমলাসুন্দরী।

উনবিংশ শতকের অন্যতম বিখ্যাত চরিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপস্থিতি আমরা এই উপন্যাসে পাইনা। কারন উপন্যাসের কাহিনী শেষ হয়েছে নবীনকুমারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তখন রবীন্দ্রনাথ মাত্র আট-নয় বছরের বালক। বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও আমরা এই উপন্যাসে তেমনভাবে পাইনা। এই দুজনকে ভালোভাবে জানতে হলে পড়তে হবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘প্রথম আলো’। প্রথম আলো নিয়ে আরেকদিন লিখবো।
যাদের খাটখোট্টা টাইপের নিরস ইতিহাস পড়তে খুব অরুচি তারা চোখ বন্ধ করে এই উপন্যাসখানা পড়ে নিতে পারেন। এতে করে সাহিত্যের স্বাদ তো পাবেনই সেই সাথে পাবেন উনবিংশ শতকের এক উল্লেখযোগ্য সময়ের বাস্তব আখ্যান।

Copyright © 2014 রিপন ঘোষের খেরোখাতা All Right Reserved
^
Blogger দ্বারা পরিচালিত.