আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে

Latest News:

বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৬

ভূমিকম্প: আতংকিত নয়, সচেতন হোন

২০০৮ থেকে এ অবধি ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা বিষয়ক অনেকগুলো প্রশিক্ষণ ও মহড়ায় আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছে। বর্তমানে নিজের ব্যক্তিগত পেশার পাশাপাশি জরুরী সাড়াদান পরিকল্পনা বিষয়ক প্রশিক্ষক হিসেবে কমিউনিটি লেভেলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তালিকাভুক্ত স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করছি। দুর্যোগ বিশেষত ভূমিকম্প নিয়ে কাজ করার ফলে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা আমার দায়ীত্বের মধ্যে পড়ে। তাই ভূমিকম্পের আগে-পরে করণীয় নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশ বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল মারাত্বক ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সিলেটের তামাবিল সীমান্তের ঠিক পাশে ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি জেলার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে একটি মারাত্বক ঝুঁকিপূর্ণ ফল্ট যা ‘ডাউকি ফল্ট’ নামে পরিচিত। এটি খুবই সক্রিয় ফল্ট। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর এর বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এবং প্রতিবারই দেখা যায় এটি আগের অবস্থান থেকে সরে গেছে। সর্বশেষ ১৮৯৭ সালে এই ফল্ট থেকে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়, যা ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক’ নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্পের প্রভাবে সিলেটের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে। মাটির সাথে মিশে যায় সিলেটসহ ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুরের অনেক উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ঢাকার নবাব পরিবারের আবাস ‘আহসান মঞ্জিল’।

ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের বিশেষত্ত্ব হচ্ছে প্রতি একশো বছরে সেখানে একটি বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে। সেই হিসেবে আমাদের এই অঞ্চলে সর্বশেষ ভূমিকম্পের ১১৯ বছর পেরিয়ে গেছে। ভূ বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের এই অঞ্চলে কমপক্ষে সাত মাত্রার দশটি ভূমিকম্প পাওনা হয়ে গেছে।

আজ ভোরের ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি যদি কোনভাবে ডাউকি ফল্টে ঘটতো তবে এতোক্ষণে সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, শিলং, গৌহাটিসহ আরো অনেক শহর-জনপদ ধ্বংসের জনপদে পরিণত হতো। মনিপুরে উৎপন্ন ভূমিকম্পের প্রভাবে সমগ্র বাংলাদেশ তো বটেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত যেভাবে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠেছে তা স্মরণকালের তীব্র। পাশের বাসার এক পচাত্তর বছরের বৃদ্ধার মুখেও শুনলাম ‘এমন ভূমিকম্প আমার বাপের জন্মে দেখিনি’।

ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি যতোটা না প্রাকৃতিক তার চাইতে বেশী মনুষ্যসৃষ্ট। মানুষের অতিলোভ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। আগের ভূমিকম্পগুলোতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল নিতান্তই সামান্য। কিন্তু এখন যদি একটি সাতমাত্রার ভূমিকম্প ঘটে তবে বিস্তীর্ণ এলাকা বিরাণভূমিতে পরিণত হবে। ১৮৯৭ সালের পর সিলেট ও আসাম অঞ্চলে হাফ দেয়াল ও উপরে বেড়ার উপর চুন-সুরকির প্রলেপ দেওয়া এক ধরণের বাসা-বাড়ির প্রচলন ঘটে। যা আসামিজ স্টাইল নামে পরিচিত। এছাড়া কাঠের ঘর-বাড়িরও প্রচলন ছিলো। সিলেটের পুরনো মহল্লাগুলোর আনাচে কানাচে এখনও এমন কিছু বাড়ির দেখা মেলে। গত পনের বছরে সিলেট শহরের চালচিত্র বদলে গেছে অনেকখানি। এক সময়ের শান্ত ছোট্ট শহর ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। শহরের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার বিশাল অট্টালিকা। সুউচ্চ ভবনগুলোর দিকে তাকালেই গলা শুকিয়ে আসে। ঢাকার অবস্থা তো আরো শোচনীয়! এই অপরিকল্পিত নগরায়নই ভূমিকম্পের প্রধান ক্ষয়ক্ষতির কারন।

ভূমিকম্পকে আটকানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এর কোন পূর্বাভাসও দেয়া যায়না। তাই ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় যথাযথ পূর্ব-প্রস্তুতি। কথায় আছে, Prevention is better then cure অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ সর্বোত্তম উপায়। কিছু সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নিলে আমরা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি অনেকাংশে।

<<< ভূমিকম্প পূর্ববর্তী প্রস্তুতি >>>

•কবে না কবে ভূমিকম্প হবে সেই ভয়ে এই প্রস্তুতি আপনার কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে! তবুও আমরা যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে আছি তাই হাতের কাছেই নিরাপদ জায়গায় সবসময় ফাস্ট এইড বক্স, টর্চলাইট, রেডিও ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করে রাখুন। মনে রাখবেন ভূমিকম্প কখনোই ঘূর্ণিঝড়ের মতো পূর্বাভাস দিয়ে আসেনা।

•ঘরের সদস্যদের সমান সংখ্যক হেলমেট জোগাড় করে রাখুন। যদি হেলমেট নাই থাকে তবে বালিশগুলো ভালো তুলা দিয়ে যথেষ্ট মোটা করে তৈরি করুন। মনে রাখবেন ভূমিকম্পের সময় মাথা বাঁচানোটাই হচ্ছে আসল কাজ।

•অযথা মোবাইলের চার্জ নষ্ট করবেন না। সম্ভব হলে সাথে ব্যাকআপ ব্যাটারি রাখুন। বর্তমানে মোবাইল চার্জ দেয়ার জন্য পোর্টেবল পাওয়ার ব্যাংক পাওয়া যায়, সেটিও রাখতে পারেন সাথে।

•ঘরের আসবাবপত্র বিশেষ করে খাট ও টেবিল শক্ত কাঠ দিয়ে, আরো উঁচু করে তৈরি করুন। এতে করে ভূমিকম্পের সময় এদের তলায় ঢুকে আত্মরক্ষা করতে পারবেন।

•রান্নার কাজ শেষ হলেই গ্যাসের চুলা নিভিয়ে রাখুন।

•ঘরের ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস ও বৈদ্যুতিক সংযোগ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেরামত করুন।

•জরুরী সাহায্য প্রদানকারী সংস্থাগুলোর টেলিফোন নম্বর মোবাইলে সেভ করে রাখুন।

•ঘরে ঝুলন্ত কোন বস্তু (যেমনঃ ঝাড়বাতি) রাখবেন না। আলমারী, শোকেস, সানশেড, বা তাঁকের উপর ভারী কিছু রাখবেন না

<<<ভূমিকম্পকালীন করণীয়>>>

•আতংকগ্রস্থ না হয়ে ধীর স্থির থাকুন। পরিবারের সকলকে নিয়ে (শিশু ও বৃদ্ধদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে) দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে।

•বহুতল ভবনে অবস্থানকালে জরুরী নির্গমন পথ না পেলে বের হওয়ার চেষ্টা না করে সেই ভবনের পিলারের নিচে অবস্থান নিন। মনে রাখবেন পিলার সাধারণত ভেঙে পড়েনা। আপনি আটকা পড়লেও উদ্ধারকারীরা সহজেই আপনাকে উদ্ধার করতে পারবেন।

•হাতের কাছে হেলমেট থাকলে দ্রুত পরিধান করুন। হেলমেট না পেলে মাথার উপর বালিশ চাপা দিন। মনে রাখবেন মাথা বাঁচাতে পারলেই জীবন বাঁচবে। অনেকসময় বিল্ডিং ভেঙে পড়েনা কিন্তু ছাদের প্লাস্টার খসে পড়ে। এগুলো মাথায় আঘাত হানলে নির্ঘাত মৃত্যু। হেলমেট বা বালিশ জাতীয় কিছু নাই পান তবে দুহাতের কবজি দিয়ে মাথা ঢেকে রাখবেন।

•টেবিল বা খাটের নিচে আশ্রয় নিন।

•গ্যাসের লাইন চালু থাকলে তা দ্রুত বন্ধ করার চেষ্টা করবেন।

•বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করুন। এতে করে আগুন লাগার সম্ভাবনা কমে যাবে।

•বহুতল ভবনে অবস্থান করলে ভুলেও লিফট ব্যবহার করবেন না।

•গাড়িতে থাকলে গাড়ি চালনা বন্ধ করে গাড়ির মধ্যেই অবস্থান করতে হবে।

•নদী বা পুকুরে অবস্থান করলে দ্রুত উপরে উঠে আসতে হবে।

<<<ভূমিকম্প পরবর্তী করণীয়>>>

•বারবার ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের চার্জ নষ্ট করবেন না।

•বড় ভারী কোন কিছুর নিচে চাপ পড়লে অযথা টানা হ্যাঁচড়া করবেন না। তা নাহলে শরীরের শক্তি নিঃশেষিত হবে।

•বড় ভূমিকম্পের পর আবার আফটার শক অনুভূত হয়। তাই তাতক্ষণিকভাবে ঘরে প্রবেশ করবেন না। মনে রাখবেন প্রথমবারের আঘাতের চেয়ে আফটার শকের তীব্রতা কম হলেও তা খুব বিপদজনক। কারন প্রথম আঘাতে ভবনের ভিত্তি দূর্বল হয়ে পড়ে। তাই আফটার শকের সময় সেই দূর্বল ভবন ভেঙ্গে পড়তে পারে।

•ফাটল ধরা কোন ভবনে কোনভাবেই প্রবেশ করবেন না।

•সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে রেডিও ও অন্য বেতার বার্তা শুনার চেষ্টা করবেন।

•জরুরী বাহিনীকে (যেমনঃ ফায়ার সার্ভিস, এম্বুলেন্স) দ্রুত খবর দেওয়ার চেষ্টা করবেন।

•উদ্ধারকর্মীদের উদ্ধার কাজে সর্বাত্বক সহযোগীতা করতে হবে। মনে রাখবেন আপনার এলাকার অলি-গলি আপনিই ভালো চিনেন।

•কোন ভবনে আটকা পড়লে আপনার কন্ঠ যদি উদ্ধারকর্মী পর্যন্ত না পৌছায় তবে শক্ত কিছুতে আঘাত করুন।

•আর সবচেয়ে বড় কথা মনোবল হারাবেন না একদম।

সবাই সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন। বিপদে ধৈর্য্য হারাবেন না।

Copyright © 2014 রিপন ঘোষের খেরোখাতা All Right Reserved
^
Blogger দ্বারা পরিচালিত.