আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে

Latest News:

শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫

ঘন্টু মামা (পর্ব-৬)

এন্ড্রয়েড মোবাইলে ঘন্টু মামা অনেকটা মানিয়ে নিয়েছেন। এখন তিনি অনায়াসে সব ধরনের এপস ব্যবহার করতে পারেন। ফেসবুক, হোয়াটসএপ আর ক্যান্ডি ক্রাশের তো রীতিমতো প্রেমে পড়ে গেছেন। অবশ্য ঘন্টু মামাকে এন্ড্রয়েডে অভ্যস্ত করাতে আমাকে কম ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়নি! জয়াদি তো হুকুম দিয়েই খালাস; কিন্তু আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি কতো ধানে কতো চাল। মাঝে মাঝে তো মনে হয়েছে ঘন্টু মামার মতো মানুষদের জন্য ইংলিশ লার্নিং কোর্সের মতো এন্ড্রয়েড লার্নিং কোর্স চালু করা যায় কিনা!

জয়াদি প্রথম যেদিন ঘন্টু মামাকে এন্ড্রয়েড মোবাইল উপহার দিয়েছিলেন সেদিন ঘন্টু মামার চেহারা দেখার মতো হয়েছিল। মানুষ দামী উপহার পেলে খুশী হয় আর আমার ঘন্টু মামা হয়েছিলেন ভয়ার্ত আর বিরক্ত। ঘন্টু মামা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন তার ওপর নজরদারী করতেই জয়াদির এতো আয়োজন।

ঘন্টু মামার ফেসবুক প্রোফাইলে অবিবাহিত মেয়েদের প্রবেশাধীকার নিষিদ্ধ। বিশেষ পদাধীকার বলে জয়াদি এই নিষেধাজ্ঞা জারী করে রেখেছেন। জয়াদির ধারনা সুন্দরী মেয়েরা যখন-তখন এরকম বাউন্ডুলে মানুষের প্রেমে পড়ে যায়। ঘন্টু মামার প্রতি জয়াদির কঠোর হুশিয়ারি কোনভাবেই যেন ফ্রেন্ডলিস্ট হাইড করে রাখা না হয়। অর্থাৎ ঘন্টু মামার প্রোফাইল সবসময় গোয়েন্দা নজরদারীতে থাকে।

জয়াদির এসব কর্মকান্ড দেখে একদিন বললাম, এতো কষ্ট করার কী দরকার! ঘন্টু মামার ফেসবুক পাসওয়ার্ড তুমি জেনে নিলেই হয়। তখন ঘন্টু মামার সকল একটিভিটিজ তুমি ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতে পারবে।

আমার কথা শুনে জয়াদি আমার দিকে এমনভাবে তাঁকালেন যে, আমি আর কোন কথা বলতে সাহস পেলাম না। একটা ব্যাপার আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকেনা সুন্দরী মেয়েরা এতো রাগী হয় কেন! তবে জয়াদির কাঠিন্যের মধ্যেও যে জিনিসটা স্পষ্ট বুঝা যায় তা হলো ঘন্টু মামাকে তিনি অনেক ভালোবাসেন। ঘন্টু মামার অনিশ্চিত ভবিষত নিয়েই তার যতো দুঃশ্চিন্তা।

একটু আগে ঘন্টু মামা ভাইবারে কল দিয়েছেন। আজকাল মোবাইল ব্যালেন্স খরচ করতে ঘন্টু মামার বড্ড অনীহা। কল রিসিভ করতেই বললেন, তুই এক্ষুনি আমার বাসায় চলে আয়। জয়ার বাসায় আজ দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ।

খাওয়ার নিমন্ত্রণ শুনে আমি প্রমাদ গুনলাম। ঘন্টু মামার রাক্ষুসে খাই খাই স্বভাবের জন্য আমাকে বেশ কয়েকবারই অস্বস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আজ আবার কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এই ভেবে আমি বললাম, আমি এখনো স্নান করিনি। এছাড়া আমার একটু জ্বর জ্বর লাগছে। আমি যেতে পারবোনা।

ঘন্টু মামা বললেন, ওই ব্যাটা ফাজিল। আমাকে হাঁদারাম পেয়েছিস? এই বলছিস স্নান করবি আবার বলছিস জ্বর! জ্বর হলে কেউ স্নান করে নাকি!

আমি সামলে নিয়ে বললাম, জ্বর হলে স্নান করতে বাধা কোথায়! বরং জ্বরের মধ্যে ঠান্ডা জল দিয়ে স্নান করলে জ্বর আরো তাড়াতাড়ি পালায়।

ঘন্টু মামা বললেন, কানের নিচে একটা লাগাবোনা। আমাকে শেখাচ্ছিস! জ্বর হোক আর যাই হোক এক্ষুনি আয়! না আসলে বাসা থেকে টেনে আনবো।

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘন্টু মামা কল কেটে দিলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে বেরুতে হলো। তবে আসন্ন দুর্যোগের কথা চিন্তা করে ঢোক গিললাম।

ঘন্টু মামা সবসময়ই ফ্যাশন সচেতন। এদিক দিয়ে ঘন্টু মামা আমাদেরও আইকন। ঘন্টু মামা আজ চকোলেট রঙের পাঞ্জাবি পড়েছেন। ক্লীন সেইভ, চুল পরিপাটী করে আছড়ানো। গা থেকে সুগন্ধী পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে। আমি বললাম, যা লাগছে না তোমায়! জয়াদি আজ নতুন করে আবার তোমার প্রেমে পড়ে যাবে।

ঘন্টু মামা আর আমি কথা বলতে বলতে জয়াদির বাসায় হাজির হলাম। দরজা খোলাই ছিলো। কষ্ট করে বেল টিপতে হলোনা। ঘন্টু মামা মোটা পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাঁকিয়ে বললেন, আসতে পারি।

ড্রয়িং রুমে কেউ ছিলোনা। ঘন্টু মামার গলার আওয়াজ পেয়ে পাশের রুম থেকে জয়াদি প্রায় দৌড়ে এলো। জয়াদিকে দেখে আমার টাসকি খাওয়ার জোগাড়। জয়াদি লালের মধ্যে কালো ডোরা কাটা শাড়ি পড়ে আছে। মুখমন্ডলে হালকা প্রসাধনী আর সদ্য স্নান সেরে আসা ভেজা চুলে জয়াদিকে একদম অপ্সরার মতো দেখাচ্ছে। জয়াদির চেহারা থেকে একটা স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য ঠিকরে পড়ছে।

বেশ খানিকক্ষন স্থির দাঁড়িয়ে থেকে ঘন্টু মামা বললেন, জয়া তুমি তো দিনকে দিন অসামাজিক হয়ে যাচ্ছো!

ঘন্টু মামার কথা শুনে জয়াদি আর আমি দুজনেই মারাত্বকভাবে বিষ্মিত। নিমন্ত্রন খেতে এসে এটা আবার কেমন কথা! এ কথায় জয়াদি কী রি-একশন দেখায় আমি ভাবিত হলাম। জয়াদি নিজের চেহারায় যথেষ্ট বিষ্ময় ফুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমি আবার কী করলাম!

ঘন্টু মামা বললেন, কতোক্ষণ হলো বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও ভেতরে আসতে বলোনি!

জয়াদি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, আসো আসো।

ঘরে ঢুকে ঘন্টু মামা চারদিক তাঁকিয়ে বললেন, কাকীমা কোথায়?

জয়াদি উত্তর দিলেন, মা রান্নাঘরে।

ঘন্টু মামা জয়াদির দিকে একদৃষ্টে খানিকক্ষণ তাঁকিয়ে রইলেন। আমার সামনে ঘন্টু মামা এভাবে তাঁকিয়ে আছেন দেখে জয়াদি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছেন। ঘন্টু মামা বললেন, তোমাকে আজ বেশ ভালো লাগছে। কপালে একটা ছোট্ট টিপ থাকলে আরেকটু ভালো লাগতো।

জয়াদি লজ্জ্বা পেয়ে বলল, কী শুরু করেছো? তোমরা বসো। আমি আসছি।

জয়াদি চলে যেতেই আমি ঘন্টু মামাকে বললাম, আমাকে না নিয়ে এলেই ভালো করতে। জয়াদি একান্তে তোমাকে নিমন্ত্রণ করেছেন।

ঘন্টু মামা বললেন, ধুর ব্যাটা হাঁদারাম। যদিও তুই আস্ত একটা আমড়া কাঠের ঢেঁকি তারপরও তোকে ছাড়া আমার চলেই না।

ঘন্টু মামা প্রকাশ্যে আমাকে অপমান করছে দেখে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমি চললাম। আর তোমার সাথে কোথাও যাবোনা।

আমি উঠতে যাবো এমন সময় জয়াদি ফিরে এলেন। জয়াদিকে দেখে ঘন্টু মামা বললেন, দেখো জয়া, মুন্না নাকি চলে যাবে!

জয়াদি আমার দিকে তাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কীরে কী হয়েছে? তুইও আজকাল ভাব দেখানো শুরু করেছিস নাকি!

আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। সত্যি কথা বললে জয়াদি ঘন্টু মামার ওপর চড়াও হবে। আমার সামনে ঘন্টু মামাকে নাস্তানুবাদ হতে দেখলে আমার খারাপ লাগবে তাই আমি মৃদু হাসি দিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম।

হঠাত ঘন্টু মামা জয়াদিকে বললেন, আজ কোন উপলক্ষ্য ছাড়াই হঠাত খাওয়ার নিমন্ত্রন যে?

জয়াদি বললেন, খাওয়ার জন্য কোন উপলক্ষ্যের দরকার আছে কী? আর তাছাড়া তোমার মতো খাদক মানুষের আবার উপলক্ষ্য কীসের!

ঘন্টু মামা হেসে বললেন, যদিও তুমি এইমাত্র আমাকে অপমান করলে তারপরও আমি গায়ে কিছু মাখলাম না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে হঠাত কেন খেতে বললে?

জয়াদি বললেন, আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই খেতে বলেছি। হেভ ইউ এনি প্রভলেম? ইফ ইউ হেভ এনি প্রবলেম প্লীজ এক্সপ্লেইন মী।

জয়াদির ইংরেজী শুনে ঘন্টু মামা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমাকে কতোদিন বলেছি ওসব ইংলিশ-ফিংলিশ সব আমার এন্টেনার ওপর দিয়ে যায়।

জয়াদি বললেন, ঠিক করেছি আজ তোমার সাথে ঝগড়া করবোনা। কাজেই আমার মেজাজটা বিগড়ে দিওনা প্লীজ।

ঘন্টু মামা বললেন, আবার ইংলিশ!

জয়াদি চরম বিরক্ত হয়ে বললেন, আরে বাবা প্লীজ, স্যরি এসব খুব সাধারন হয়ে গেছে।

এমন সময় জয়াদির বাবা ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ঘন্টু মামাকে দেখে তিনি বললেন, কীরে অকালকুষ্মান্ড তুই কখন এলি?

জয়াদির বাবা ঘন্টু মামাকে অকালকুষ্মান্ড বলায় আমার ভালো লাগলো। আমাকে অপদার্থ বলার মজা নিজে বুঝুক এবার! তবে সেই সাথে আরেকবার নিশ্চিত হলাম জয়াদি আর ঘন্টু মামার মিলনে যদি কেউ ভিলেন হয়ে দাঁড়ায় তবে একমাত্র তিনি জয়াদির বাবাই।

হবু শ্বশুর মশাইয়ের এমন সম্বোধন ঘন্টু মামা গায়ে খুব একটা মাখলেন বলে মনে হলোনা। তিনি দাঁত কেলিয়ে বললেন, কাকু কী কোথাও বেরোচ্ছেন?

জয়াদির বাবা অরুনোদয় বণিক পায়ে মুজো পড়তে পড়তে বললেন, পায়ে মুজো পড়ে কেউ নিশ্চয় বাড়িতে ঢেং ঢেং করে হেঁটে বেড়ায় না?

জয়াদির বাবা বেরিয়ে যেতেই ঘন্টু মামা বললেন, তোমার বাবা এতো খাটাশ কেন! উনার নাম অরুনোদয় না রেখে অরুনঅস্ত রাখা উচিত ছিলো।

আমি ভেবেছিলাম ঘন্টু মামার কথায় জয়াদি প্রবলভাবে আপত্তি জানাবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে জয়াদি একটা মিষ্টি হাসি দিলেন মাত্র।

ঘন্টু মামা আর জয়াদিকে একান্তে কথা বলার সুযোগ দিয়ে আমি পাশের ঘরে চলে গেলাম। অনেকক্ষণ পর জয়াদির মা আমাদের খেতে ডাকলেন। খেতে বসে ঘন্টু মামা বললেন, কাকিমা আপনারাও বসে পড়ুন।

ঝর্না কাকিমা থালা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, বাব্বা ঘন্টু তুই তো বেশ ভদ্রতা শিখে গেছিস!

“কাকিমা কথায় আছেনা, সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস।” বলেই ঘন্টু মামা জয়াদির দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হাসলো।
জয়াদি ভ্রু কুঁচকে ঘন্টু মামার মুচকি হাসিকে সোজা বাউন্ডারি সীমানা পার করে বললেন, বেশী বকোনা। খেতে শুরু করো।

ঘন্টু মামা ঘো ধরলেন, তোমরা না বসলে আমি খাবোনা। অগ্যতা জয়াদিকে আমাদের সাথে বসতে হলো।

টেবিল জুড়ে খাবার আর খাবার। হরেক রকম খাবারের গন্ধে পুরো ডাইনিং রুম মৌ মৌ করছে। খাবারের মাতাল করা গন্ধে আমি যতোটা উচ্ছ্বসিত, ঠিক ততোটাই উৎকণ্ঠিত ঘন্টু মামাকে নিয়ে। জয়াদি আমাদের প্রথমেই আমাদের পাতে নাজিরশাইল চালের ভাত তুলে দিলেন। সাদা ভাত অথচ কি সুন্দর গন্ধ। প্রথমেই বেগুন বড়া আর মুগডাল দিয়ে এক গ্রাস গলধঃকরন করলাম। জয়াদি একেক আইটেম তুলে দিচ্ছেন আর আমরা তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছি। এখন পর্যন্ত ঘন্টু মামা সংযত আচরণ করছেন। দাঁত দিয়ে মাংস ছিড়তে ছিড়তে তিনি বললেন, আহ! কি অমৃত! কাকিমার হাতের রান্না এতো ভালো জানা ছিলোনা! কাকিমা এখন থেকে নিয়মিত খেতে ডাকবেন কিন্তু।

ঝর্না কাকিমা হেসে বললেন, এ কী আর রাঁধলাম! আমার স্পেশাল রান্নাগুলো তোদের আরেকদিন রেঁধে খাওয়াবো।

ঘন্টু মামার উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। মহিলাদের রূপ আর রান্নার প্রশংসা করলে তারা একেবারে গলে গলে পড়ে। এবার ঘন্টু মামা যতো বেশীই খাননা কেন ঝর্না কাকিমা কিছু মনে তো করবেনই না উলটো গর্ব করে বলে বেড়াবেন, আমি এমন রান্না করেছিলাম যে ঘন্টু কবজি ডুবিয়ে খেয়েছে!

জয়াদি খাসির রেজালা ঘন্টু মামার পাতে তুলে দিতেই ঘন্টু মামা বলে উঠলেন, কী শুরু করেছো! এতো খেলে চলবে কীভাবে?

জয়াদি আমার দিকে তাঁকিয়ে বললেন, এ কীরে মুন্না! এ দেখি ভুতের মুখে রাম নাম!

ঘন্টু মামা গায়ে কিছু না মেখে বললেন, খেতে আমি ভালোবাসি ঠিক, তাই বলে আমাকে রাক্ষস ভেবোনা।

পাশ থেকে জয়াদির মা বললেন, এই জয়া তুই কী শুরু করেছিস! ছেলেটাকে ইচ্ছে মতো খেতে দে।

জয়াদি বললেন, খাও ঘন্টু সোনা খাও।

শনিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৫

চন্দ্রবিজয়ী তিন নভোচারীর ঢাকা ভ্রমণ

ষাট দশকের শেষার্ধ, তখন সময়টা এমন ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানীদের জীবনে খুব কম সময়ই উৎসবের উপলক্ষ্য আসতোসব সময় এক আতংকে সময় কাটতো সবার, এই বুঝি পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের অধিকার, আমাদের দাবী ছিনিয়ে নিয়ে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দিবে আমাদের মুখতারপরও এ সময় কিছু ব্যাপার এদেশবাসীর উৎসবের উপলক্ষ্য নিয়ে এসেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চন্দ্র বিজয়ী তিন নভোচারীর স্বস্ত্রীক ঢাকা ভ্রমণ

নভোচারীত্রয় বিশ্বভ্রমনের ১৭ টি দেশের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন
১৯৬৯ সালের ২৭শে অক্টোবর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা নগরী এক উৎসবমুখর বেশ ধারন করেসারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষের ঢল নামে ঢাকায়তৎকালীন কুর্মিটোলা বিমান বন্দর ও ঢাকায় প্রবেশের মুল রাস্তায় প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটেরাস্তার দু-পাশে নারী-পুরুষ, ছেলে, বুড়ো সমানে ভিড় করতে থাকে

দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের সময় মার্কিন বিশেষ বিমানটি এ্যাপোলো-১১ মিশনের নভোচারী ও চন্দ্রবিজয়ী বীর নেইল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স এবং তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে যখন বিমান বন্দরে অবতরণ করেন,তখন প্রতিরক্ষা বাহিনীর আবেষ্টনী ভেদ করে জনতা বিমানের দিকে দৌড়াতে শুরু করেতিন চন্দ্র বিজয়ী ও তাঁদের স্ত্রীরা বিমান থেকে বেরিয়ে আসলে জনতা তুমুল ও মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে তাঁদের অভিনন্দন জানায়নভোচারীরাও হাত তুলে এ অভিবাদনের জবাব দেনবিমান বন্দরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রঙীন পোষাক পরিধান করে তাঁদের ফুলের তোড়া দ্বারা বরণ করে নেয়বিমান বন্দরে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বহু সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেনপূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বহু মার্কিন নাগরিকও বিমান বন্দরে এসে উপস্থিত হন

বিমান বন্দরটিকে নভোচারীদের ছবি ও প্রতিকৃ্তি এবং পাকিস্তান ও মার্কিন পতাকায় সুসজ্জিত করা হয়একটি বিরাট ব্যানারে লেখা ছিল, “আপনাদের এ সাফল্যে সমগ্র মানবজাতি গৌরবান্বিতবিমান বন্দর হতে একখানা খোলা সেভ্রোলেট গাড়ীতে নভোচারীত্রয় এবং অপর একখানা গাড়ীতে মিসেস কলিন্স ও মিসেস অলড্রিনকে নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে শহরের প্রায় নমাইল রাস্তা পরিভ্রমণ করা হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছেলেরা ঢোল বাজিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানায়কেউ ফুলের তোড়া, কেউ ফুলের পাপড়ি, কেউবা অভিনন্দন লিখিত শব্দমালা চলন্ত গাড়ীর প্রতি নিক্ষেপ করে তাঁদের অভিনন্দন জানায়

দীর্ঘ শোভাযাত্রা শেষে অতিথীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন) পৌছেনসেখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা ভাষণ দেনগভীর আনন্দের সহিত তাঁরা সাংবাদিকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেনমহাশূন্যচারীদের আগমন উপলক্ষে তাঁদের চাঁদে অবতরণ এবং পরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়এ সময় নভোচারীদের স্ত্রীরাও স্থানীয় বিশিষ্ট মহিলা ও মহিলা সাংবাদিকদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন

ঢাকা টেলিভিশন (বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশন) সাধারনত সোমাবার বন্ধ থাকলেও এদিন মহাশূন্যচারীদের আগমনের দৃশ্য সরাসরি প্রচারের জন্য বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করেবিকেলে পূর্ব পাকিস্তান সরকার নভোচারীদের এক সম্বর্ধনা ও প্রীতিভোজের আয়োজন করেগভর্ণমেন্ট হাউসে ৬জন বিউগল বাদকের নিনাদের মধ্য দিয়ে মহাশূন্যচারীদের আগমনীবার্তা ঘোষনা করা হয়অনুষ্টানে উপ-মহাদেশের ঐতিহ্যবাহী জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীবৃন্দ ছাড়াও শ্রমিক ও ছাত্রনেতৃবৃন্দও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন

উক্ত অনুষ্ঠানে মহাশূণ্যচারীগণ তৎকালীন গভর্নর জনাব আহসানের সাথে উপহার ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেনজনাব আহসান এ অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানেরও প্রতিনিধিত্ব করেনঅনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথে অন্যতম আকর্ষন ছিল এ্যাপোলো-১১ রকেটের মডেল সন্নিবেশিত বিরাটকার একটি কেকচন্দ্রবিজয়ী নভোচারী ও তাঁদের স্ত্রীদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে গভর্ণর আহসান বলেন, “এ বিরাট সাফল্য বিজ্ঞান ও কারিগরী বিজ্ঞানের বিজয় এবং একটি মহান সমাজের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বিপুল আকারে মানবিক ও বৈষয়িক সম্পদের সমুন্নয় সাধনেরই ফলশ্রুতিগভর্ণর পূর্ব পাকিস্তান ভূগোল সমিতির পক্ষ হতে মহাশূণ্যচারীদের একটি স্বর্ণপদক প্রদান করেনপৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রদানদের বাণী সম্বলিত যে ফলকটি মহাশূণ্যচারীগণ চন্দ্রতরীতে করে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার একটি রেপ্লিকা তারা গভর্ণরের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে উপহার দেনপাকিস্তানের জনগণের জন্য ফেলে আসা ফলকের একটি প্রতিকৃতিও তারা আহসানের নিকট প্রদান করেন

মাত্র একুশ ঘন্টা ঢাকায় অবস্থানের পর চন্দ্রমানবরা পরদিন মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটায় তাঁদের বিশেষ বিমানযোগে ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগ করেনবিমান বন্দরে বহু লোকজন ও সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ তাঁদের বিদায় অভিবাদন জানান সময় অনেকের চোখের কোণে জলের চিলিক দেখা যায়স্বল্পসময়েই তারা এদেশের জনগণের হৃদয়ের মণি কোঠায় স্থান করে নেন

তথ্যসূত্র; এই পোষ্টটি তৈরী করতে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত গাজীউর রহমান লিখিত রকেট ও চন্দ্র বিজয়ের ইতিকথানামক তথ্যবহুল বইয়ের যথেষ্ট সাহায্য নেয়া হয়েছেউইকিপিডিয়ারও কিছু সাহায্য নেয়া হয়েছেআর গুগলে অনেক খুঁজাখুঁজি করেও নভোচারীদের ঢাকা ভ্রমনের ভালো কোন ছবি পাইনি!

সোমবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৫

ঘন্টু মামা (পর্ব-৫)

গড়ের মাঠ বলতে যা বুঝায় আমাদের পকেট এখন ঠিক তাই। বাসায় ফেরার ভাড়া পর্যন্ত পকেটে নেই। রাগে আমার গা রি রি করছে। ঘন্টু মামাকে পেছনে ফেলে আমি আগে আগে হাঁটছি। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ঘন্টু মামার সাথে এখনও একটা কথা বলিনি। চুপচাপ অনেকটা হাঁটার পর ঘন্টু মামা আমার প্রায় কাছাকাছি এসে বললেন, তুই কী মৌনব্রত পালন করছিস নাকি?

আমি কোনরকম উত্তর দিলাম না। ঘন্টু মামা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে বললেন, রাগ করিস না মুন্না। বললাম তো বাসায় ফিরে তোর টাকা দিয়ে দেব। আচ্ছা পাঁচশর সাথে আরো পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে দেব। এবার খুশী তো?

আমি চোখ বড় করে ঘন্টু মামার দিকে তাঁকালাম। ঘন্টু মামা দুষ্টুমির হাসি হেসে বললেন, মনে করিস না আবার তোকে ঘুষ দিচ্ছি

এবার আমি ঘন্টু মামার দিকে ফিরে বললাম, তোমার শরীর আসলে কীসের চামড়া দিয়ে তৈরী? এই অল্প সময়ের মধ্যে দুই-দুইবার অপমানিত হয়েও তোমার কোন ভাবান্তর নেই!

আমার কথা শুনে ঘন্টু মামা এমন হো হো করে হেসে উঠলেন যে পাশ দিয়ে যাওয়া কয়েকজন পথচারীও আমাদের দিকে তাঁকাতে বাধ্য হলো। এক গাল হেসে নিয়ে ঘন্টু মামা আমাকে বললেন, বুঝলি! জন্মের সময় আমার গায়ে মানুষের চামড়াই ছিল। তবে হলো কী, আমার মা মানে তোর দিদা একজন দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন মহিলা। আমার জন্মের পরপরই তিনি বুঝে নিয়েছিলেন তার এই ছেলের লজ্জা-শরম-অপমান
বোধ একটু কম হবে, তাই তিনি বুদ্ধি করে তখনই আমার গায়ে একটা গন্ডারের চামড়া সেলাই করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই সব লজ্জ্বা-শরম-অপমানবোধ আমার নেই বললেই চলে।

ঘন্টু মামার এহেন কথা শুনে আমার ভীষন হাসি পাচ্ছিলো। একটা লোক কী নির্দ্বিধায় বকে যাচ্ছে! আমি চেহারায় যথেষ্ট কাঠিন্য ফুটিয়ে বললাম, রাখো তোমার বাজে কথা। এখন বাসায় ফিরবো কী করে সেটা বলো?

ঘন্টু মামা বললেন, এ আর চিন্তা কী! পায়ে হেঁটেই ফিরে যাবো।

আমি বললাম, পাগল! এখান থেকে বাসা কতোদূর হিসেব আছে! আমি এতোদূর হেঁটে যেতে পারবোনা।

হঠাত করে ঘন্টু মামা পায়ে ভর দিয়ে রাস্তায় বসে পড়লেন। আমি আশ্চর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার! বসে পড়লে যে?

ঘন্টু মামা তার নিজের কাঁধের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, হাঁটতে যখন পারবিনা তখন কী আর করা! তুই আমার কাঁধে চড়ে বস। আমি তোকে কাঁধে নিয়ে বাসায় ফিরবো।

আমি যারপরনাই বিষ্মিত হয়ে বললাম, পাগল হয়েছো। আচ্ছা কাইন্ডলী বলবে তোমার মাথায় এতো উদ্ভট চিন্তা আসে কীভাবে?

ঘন্টু মামা হেসে বলল, বুঝলি আমার এই মাথাটা হচ্ছে চিন্তা তৈরির কারখানা। উপস্থিত বুদ্ধিতে আমার জুড়ি মেলা ভার! ঐ যে ব্যাকরণের ভাষায় বলে না প্রত্যুতপন্নমতিতা!

আমি ব্যঙ্গ করে বললাম, প্রত্যুতপন্নমতি না ছাই! তোমার পাল্লায় যে পড়েছে তার অবস্থা একেবারে কেরোসিন হয়ে যাবে। এতো চেষ্টা করেও যে কেন তোমার সঙ্গ ছাড়তে পারিনা!

ঘন্টু মামা হেসে বলল, এটাই ঘনাচরণ সরকারের কারিশমা! একবার আমার সাথে যে সেঁটে গেছে সে আর আলগা হতে পারেনা।

ঘন্টু মামা কথা শেষ করার আগেই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। মোবাইল স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে ঘন্টু মামার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উৎফুল্ল হয়ে আমাকে বললেন, বলেছিলাম না যোগাযোগ ওকে করতেই হবে। ফোন রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে ভেসে এলো, ঘনাচরণ বাবু এখন ঠিক কোথায় আছেন?

ঘন্টু মামা বললেন, আপনার অফিস থেকে বেরিয়ে ডানদিকে দুই-আড়াইশো গজ এগুতে থাকুন। আমাদের পেয়ে যাবেন।

ওপর পাশ থেকে উত্তর এলো, একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।

কল কেটে দিতেই আমি ঈশারায় ঘন্টু মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে?

ঘন্টু মামা ভুবন জয়ের হাসি হেসে বললেন, মিস্টার বাঁধন এস চৌধুরী।

আমি বললাম, এই বাঁধন এস চৌধুরীটা আবার কে?

ঘন্টু মামা বললেন, এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি! এই একটু আগে যার অফিস থেকে এলাম।

আমি বিষ্মিত হয়ে বললাম, এখন আবার কী জন্য! একটু আগেই না দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো!

ঘন্টু মামা বললেন, যতোই তাড়িয়ে দিক না কেন, উনি যে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন তা আমি জানতাম। সে জন্যেই তো সময় কাটানোর জন্যে ইচ্ছে না থাকাও সত্ত্বেও এতো প্লেট বিরিয়ানী খেলাম। এ সব ঘনাচরণ সরকারের কারিশমা!

আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, হয়েছে হয়েছে আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবেনা। তোমার ব্যাপার-স্যাপার আমার ভালো ঠেকছে না। তুমি এই লোকটাকে শুধু শুধু এমন ব্ল্যাকমেইলিং করছো কেন?
ঘন্টু মামা রহস্যের হাসি হেসে বললেন, ধুর ধুর আমি কোন ব্ল্যাকমেইলিং করছি না। কেউ যদি নিজে থেকে ভয় পায় আমার কী করার আছে! আমি শুধু দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একটু ফায়দা হাসিল করতে চাইছি মাত্র।

আমি বললাম, না না এটা মোটেও ঠিক না।

ঠিক তখন মার্সিডিজ বেঞ্জের একটি কালো গাড়ি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘন্টু মামা গাড়ির গ্লাসে নিজের চুলকে একটু ঠিক করে নিলেন। গাড়ি থেকে বাঁধন এস চৌধুরী বেরিয়ে এলেন। ঘন্টু মামা হেসে বললেন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

বাঁধন চৌধুরী প্রথমেই বললেন, এবার কীসে স্পন্সর দরকার? কতো দরকার ঝটপট বলে ফেলুন?

ঘন্টু মামা বিস্তারিত বলতেই বাঁধন চৌধুরী ঘন্টু মামাকে বললেন, আমার পি.এস আগামীকাল আপনার কাছে চেক পৌছে দেবে।

ঘন্টু মামা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক আছে।

বাঁধন এস চৌধুরী গাড়িতে উঠতে যাবেন তখন ঘন্টু মামা বললেন, আপনার কাছে খুচরো দুশো টাকা হবে। আমার কাছে একটা এক হাজার টাকার নোট; কোথাও ভাংতি পাচ্ছিনা।

বাঁধন চৌধুরী ভ্রু কুঁচকে নিজের ওয়ালেট চেক করে বললেন, স্যরি আমার কাছেও খুচরো টাকা নেই।

গাড়িটি চলে যেতেই ঘন্টু মামা বাঁধন এস চৌধুরীর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগলেন। তারপর কী ভেবে আমাকে বললেন, আজকাল কী সব মোবাইল ব্যাংকিং-ট্যাংকিং বেরিয়েছে না? আমরা তো আমাদের মোবাইলে টাকা আনাতে পারি।

আমি বললাম, তা পারি। কিন্তু মোবাইলে আগে একাউন্ট খুলতে হয়। আমার কোন একাউন্ট নেই। তোমার থাকলে আনাতে পারো।

ঘন্টু মামা নিজের চুল টানতে টানতে বলল, আমার একাউন্ট আসবে কোত্থেকে! তুইও কি করিস! একটা একাউন্ট খুলে রাখতে পারিস না? তোর একাউন্ট থাকলে তো জয়াকে বলে কিছু টাকা আনতে পারতাম।

আমি বললাম, জয়াদি দেবে টাকা! জয়াদি সাফ বলে দিয়েছে তোমাকে আর কোন টাকা দেবেনা। তুমি আজ পর্যন্ত কতো টাকা ধার এনেছো মনে আছে? একটা টাকা ফেরত দিয়েছো?

ঘন্টু মামা বললেন, ধার করলেই ফেরত দিতে হবে এমন কোন কথা আছে নাকি? তাছাড়া জয়ার টাকা মানে তো আমার টাকা তাইনা?

আমি বললাম, এমনভাবে বলছো যেন তুমি নিজে রুজি করে ওর কাছে টাকা জমা রেখেছো!

ঘন্টু মামা চিন্তিত মুখে বললেন, “বাদ দে ও কথা। এখন কী করি বল তো। দুপুরে খেলে আমার শরীরে এমনিতেই আলসেমী চলে আসে। আর ভরদুপুরে এই রোদে এতো রাস্তা হেঁটে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।” কথা শেষ করেই ঘন্টু মামা একটা অটোকে ঈশারায় থামতে বললেন। আমরা দুজন অটোতে উঠে বসলাম কিন্তু এখনও জানিনা অটো ভাড়া কোত্থেকে আসবে!

রবিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৫

ঘন্টু মামা (পর্ব-৪)

রেস্টুরেন্টের ওয়েটার হা করে ঘন্টু মামার খাওয়া দেখছে। তার অবাক চাহনীতে এটা স্পষ্ট যে এরকম খাদক মানুষ সে আগে কখনো দেখেনি। অবশ্য আমার কাছে ব্যাপারটা একদম স্বাভাবিক কেননা নিয়মিত ঘন্টু মামার এমন ভুড়িভোজ দেখে আমি অভ্যস্ত।

ঘন্টু মামার শরীর এমন দশাসই কিছু না যে তার এতো খাবার খেতে হবে! এছাড়া তিনি এমন কোন পরিশ্রমী কাজও করেন না যাতে শরীর থেকে প্রচুর ক্যালরি ক্ষয় হয়! তাহলে এতো খাদ্যের চাহিদা তার আসে কোথা থেকে!

পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চির ঘন্টু মামা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। মাত্র আধা ইঞ্চির জন্য পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি না হতে পারায় ঘন্টু মামাকে প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতে শুনি, ভগবানটা বড় কিপটে! আধা ইঞ্চির জন্য কেউ কাউকে এভাবে আটকে রাখে!

ঘন্টু মামা শরীরের প্রতি কোনকালেই সচেতন ছিলেন না। জয়াদির সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর কয়েকদিন জিম করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু জিমের পরিশ্রম তার সহ্য হয়নি। একদিন একটা ভারী ডাম্বেল তুলতে গিয়ে কোমড়ের হাড়ে মোচড় খেয়ে সাতদিন বেড রেস্টে থাকতে হয়েছিল। সেই থেকে ঘন্টু মামা আর জিমের দিকে পা বাড়াননি।

ঘন্টু মামার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। চুলগুলো কোকড়ানো। ইদানীং মাথার মাঝখানে চুল একটু হালকা হয়ে এসেছে। চুল হালকা হওয়ার লক্ষন দেখে আমরা তাঁকে প্রায়ই খেপাই। কিন্তু ঘন্টু মামা থুড়ি মেরে আমাদের উড়িয়ে দিয়ে বলেন, আমার চৌদ্দগোষ্ঠীতে কারো টাক নেই। কাজেই তোরা যতোই নাচানাচি করিস না কেন আমার মাথায় টাক পড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।

পাঁচ নম্বর প্লেট শেষ করে ঘন্টু মামা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ওয়েটারকে কাছে ডাকলেন। তারপর তাঁকে বললেন, কেউ খাওয়ার সময় তার দিকে এভাবে তাঁকিয়ে থাকতে নেই। শোন, আজ যদি আমার পেট ব্যাথা করে তাহলে কাল এসে কড়ায়-গন্ডায় শোধ তুলবো।

ওয়েটারকে খানিকটা অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। ঘন্টু মামা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুই দেখি এক প্লেটই শেষ করতে পারলিনা!

ঘন্টু মামা পাশ ফিরে দেখলেন ওয়েটার তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি বললেন, কি হে এখনও স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো! যাও একটা কোক নিয়ে এসো। আর মনে করে বত্রিশ জর্দা দিয়ে একটা কড়া পান আনবে।

ওয়েটার কোকের বোতল আর পান ঘন্টু মামার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আর কিছু লাগবে স্যার?

ঘন্টু মামা হাঁফ ছেড়ে বললেন, যাক বাবা! তুমি তাহলে কথাও বলতে পারো। আমি তো ভেবেছিলাম বোবা। এবার দয়া করে বিলটা নিয়ে এসো।

ওয়েটার বিল হাতে দিতেই ঘন্টু মামার চোখ কপালে উঠলো। তিনি আঁতকে উঠে বললেন, এ যে দেখি দিনে-দুপুরে ডাকাতি! এতো টাকা বিল কীভাবে হয়?

ওয়েটার বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো, স্যার ছয়টা কাচ্চি বিরিয়ানী, দুই বোতল মিনারেল ওয়াটার, একটা হাফ লিটার কোক, একটা পান আর পনের শতাংশ ভ্যাট মিলিয়ে মোট সতেরশো সাত টাকা পঞ্চান্ন পয়সা।

ঘন্টু মামা রেগে গিয়ে বললেন, বললেই হলো! অন্য জায়গায় এর চেয়ে অনেক কম দামে খেতে পারতাম।

ওয়েটার মৃদু হেসে বললো, বেশী দূর যাওয়ার দরকার নেই স্যার। রাস্তার ওপাশে গেলেই এর চেয়ে অনেক কম দামে খাবার পাবেন।

ঘন্টু মামা বললেন, ইয়ার্কি মারছো? ডাক দাও তোমার মালিককে।

ওয়েটার মাথা চুলকে বলল, আমাদের মালিকের কী এই একটা বিজনেস! উনি অন্য জায়গায় ব্যস্ত আছেন। আপনি ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে পারেন।

ঘন্টু মামা উচ্চ স্বরেই বললেন, ডাক দাও তোমাদের ম্যানেজারকে।
ঘন্টু মামার উচ্চস্বরে কথা শুনে অন্যান্য টেবিলের মানুষগুলোও আমাদের দিকে বারবার তাঁকাচ্ছে। ঘন্টু মামার এহেন আচরণে আমার অস্বস্তি লাগছে। ওয়েটার চলে যেতে আমি ঘন্টু মামাকে বললাম, এখানে খাবারের এরকমই দাম। দেখছো না পুরো রেস্টুরেন্টে এসি লাগানো।

ঘন্টু মামা এবার আমার ওপর ক্ষেপে গেলেন। “এসি লাগানো তো কী হয়েছে? আমি কি ঠান্ডা হাওয়া খেতে এসেছি!”

খানিক পর ম্যানেজার এসে ঘন্টু মামাকে বললেন, আপনার সমস্যাটা কী জানতে পারি?

ঘন্টু মামা বললেন, সমস্যার শেষ আছে নাকি! আপনারা এখানে ব্যবসা করতে বসেছেন নাকি ডাকাতি করতে বসেছেন?

ম্যানেজার যথেষ্ট বিনয় করেই বললেন, দেখুন এখানে যারা খেতে আসে তারা খাবারের বেশী দাম জেনেই আসে। আমরা কাউকে জোর করে আসতে বলিনা। আপনার যতো বিল হয়েছে তা সব পরিশোধ করতে হবে। বিল পরিশোধ না করে যেতে দেওয়া হবেনা।

ঘন্টু মামার গলা একটু মিইয়ে আসলো। তার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছায়া দেখতে পেলাম। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে ম্যানেজারকে বললেন, আপনি যান। আমি আসছি।

আমি এতোক্ষণ চুপচাপ ঘন্টু মামার কান্ড-কারখানা দেখছিলাম। ম্যানেজার চলে যেতেই ঘন্টু মামা আমাকে বললেন, সব টাকা না দিলে শালারা ছাড়বে বলে মনে হয়না! কিন্তু এখন কি করি?

আমি বললাম, কী আর করবে? বিল পরিশোধ করবে।

ঘন্টু মামা বললেন, আমার কাছে বারোশো টাকার মতো। বাকি টাকা পাবো কোথায়! তোর কাছে কিছু টাকা ধার হবে?

আমি বললাম, আমার কাছে পাঁচশো টাকা আছে। বাবা পুরো সপ্তাহের মধ্যে আর একটি টাকাও দেবেনা। আমি এই টাকা দিতে পারবোনা।

ঘন্টু মামা মিনতির সুরে বললেন, এমন করিস না মুন্না। এই বিপদে এমন করতে নেই। আমি বাসায় গিয়ে তোর টাকা ফেরত দিয়ে দেবো। তাছাড়া খাবার তো আমি একা খাইনি। তুই ও তো খেয়েছিস তাইনা?

আমি পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে বললাম, আমি খেয়েছি বটে। তবে রাক্ষসের মতো পাঁচ প্লেট খাইনি। এই নাও টাকা। বাসায় গিয়ে আমার টাকা যেন ঠিকঠাক ফেরত পাই।

শেষপর্যন্ত সাত টাকা পঞ্চান্ন পয়সা কম বিল দিয়ে আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। এসির ঠান্ডা বাতাস থেকে গরমে বের হয়েও বড্ড আরাম লাগছিল। বাব্বা! খেতে ঢুকেছিলাম না যুদ্ধ করতে ঢুকেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ঘন্টু মামার শুভ বুদ্ধির উদয় না ঘটলে আজ নিশ্চিত গনধোলাই খেয়ে ফিরতে হতো। না ঘন্টু মামার সঙ্গ আমাকে ছাড়তেই হবে। তা না হলে কবে কোথায় কোন বিপদে যে পড়বো!

ঘন্টু মামা (পর্ব-৩)

রিসিপশনের মেয়েটি খটমট করে আমাদের দিকে তাঁকাচ্ছে। মেয়েটির চাহনীতে স্পষ্টত বিরক্তি। কিন্তু ঘন্টু মামার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি পা নাড়ানো ও পান চিবুনো দুটোই সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি ঈশারা করেও তাঁকে থামাতে পারিনি। অনেকক্ষণ পান চিবোনোর পর এদিক-ওদিক তাঁকিয়ে বললেন, ধুস! এতো বড় অফিস, সব আছে অথচ পানের পিক ফেলার কিছু নেই! মানুষগুলোর কমনসেন্স নেই বললেই চলে!

আমি ফিসফিস করে বললাম, কমনসেন্স তো নেই তোমার। এতো বড় অফিসে এসে কেউ এভাবে জাবর কাটে! তোমাকে নিয়ে আর পারা গেলোনা। ওপাশে বোধহয় ওয়াশরুম আছে। যাও পিক ফেলে মুখ ধুয়ে এসো।

ঘন্টু মামা উৎসাহ নিয়ে বললেন, কী যে বলিস! পিক ফেললে পানের মজা আছে?

আমি রেগে বললাম, “তাহলে আর কী করবে! গিলেই ফেলো।”

রিসিপশনের মেয়েটি ঠোঁটে কাঠহাসি ফুটিয়ে ভেতরে যাওয়ার ইঙ্গিত করতেই আমরা উঠে দাঁড়ালাম। ঠিক তখনই ঘটলো বিপত্তি। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে ঘন্টু মামার পা লেগে একটা বড় ফ্লাওয়ার ভাস মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে গেলো। ভাঙ্গার শব্দে পাশের রুম থেকে দু-জন ছুটে এলো। আমি আর ঘন্টু মামা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘন্টু মামা আমতা আমতা করে বললেন, স্যরি। আমি দেখতে পাইনি।

একজন মোটামতো লোক ঘন্টু মামার দিকে বিকটভাবে তাঁকিয়ে বলল, ইটস ওকে। কোথায় যাচ্ছিলেন, যান।

বিশাল রুম। চারদিকে দামী দামী আসবাব ছড়িয়ে আছে। সবগুলো জিনিসই চকচক করছে। একপাশের দেয়ালে বড় একটা পেইন্টিং। মেঝে এতোটাই স্বচ্ছ যে একটা ছোট্ট সুঁচ পড়লেও অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যাবে। একটা বড় চেয়ারে একজন সুদর্শন লোক বসে আছেন। লোকটির বয়স বড়জোর পঁয়ত্রিশের কোটায়। কিন্তু এর মধ্যেই যে তিনি নিজেকে ঘুচিয়ে নিয়ে ভালো একটা অবস্থানে আছেন তা উনাকে দেখেই অনুমান করা যায়। তিনি ঘন্টু মামার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, কী ব্যাপার ঘনাচরন বাবু? অনেকদিন পর দেখছি। হঠাত কী মনে করে বলুন তো?
ঘন্টু মামা একগাল হেসে বললেন, আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। তাই চলে এলাম।

লোকটি বললেন, আপনি মশাই নিজের স্বার্থ ছাড়া কোনদিকে এক পা বাড়ান না। এবার কীসে স্পন্সর করতে হবে! বলে ফেলুন চট করে।

ঘন্টু মামা হেসে বললেন, এজন্যই আপনাকে আমার এতো পছন্দ।

লোকটি বললেন, পছন্দ করে কী করবেন! আমার বারোটা বাজানোই তো আপনার কাজ। এইতো এসেই এতো দামী একটা ফ্লাওয়ার ভাস ভেঙ্গে ফেললেন! আচ্ছা বলুন তো আপনি এতো দুর্ঘটনা প্রবন কেন?

ঘন্টু মামা লজ্জ্বিত হয়ে বললেন, কী করবো বলুন। ইচ্ছে করে তো দুর্ঘটনা ঘটাতে চাইনা। তো যে কাজে এসেছিলাম....

লোকটি ঘন্টু মামাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এসব কাজ-টাজ পরে হবে। আগের বারের কথা আমি ভুলিনি। আমি এখন খুব ব্যস্ত। চা দিতে বলছি, খেয়ে বিদেয় হোন।

লোকটির কথায় আমি অপমানিতবোধ করছি। ঘন্টু মামার মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছেনা। তিনি মুখে হাসি ঝুলিয়েই বললেন, কী যে বলেন! এক কাপ চা খাওয়ার জন্য এতো টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে এখানে এসেছি নাকি! মান্নানের পাঁচ টাকা দামের চায়ের চেয়ে ভালো চা কী আপনার এখানে বানায়?

লোকটি বললেন, বাজে কথা রাখুন। আপনার কোন কাজে আসতে পারলাম না বলে দুঃখিত। প্লীজ আসুন।

ঘন্টু মামা রহস্যের হাসি হেসে বললেন, যেতে বললে আর কী যাওয়া যায়! আমার হাতে আপনাকে বধ করার একটা গোপন অস্ত্র আছে নিশ্চয় ভুলে যাননি?

লোকটিকে খানিকটা অপ্রস্তুত দেখালো তবে যথাসমভব গাম্ভীর্য্য বজায় রেখে বললেন, এই একটা ইস্যু নিয়ে আর কতোকাল ব্ল্যাকমেইল করবেন। এবার নতুন কিছু ভাবুন। এসব আমার কোন মাথাব্যাথা নেই।

ঘন্টু মামা মাথা চুলকে বললেন, ঠিক বলছেন তো?

লোকটি বললেন, সবকিছুর লিমিট আছে। আপনি নিজের সীমা অতিক্রম করছেন। আমি আপনার কোন বিষয়ে স্পন্সর করতে পারবোনা। গতবার আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। টাকা গাছে ধরেনা। অনেক কষ্ট করে রোজগার করতে হয়।

ঘন্টু মামা বললেন, কী করবো বলুন! গতবার কমিটির মধ্যেই একটা গন্ডগোল ছিল। এবার কোন সমস্যা হবেনা। আপনার প্রচারনা ঠিকমতো হবে।

লোকটি বললেন, আমার কোন প্রচারনা চাইনা। দয়া করে আপনি আসুন।

ঘন্টু মামা উঠে দাঁড়ালেন। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার পেছন ফিরলেন। লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সত্যি যাচ্ছি।

লোকটি ঘন্টু মামার কথাকে কোন পাত্তা না দিয়ে ফাইলে মনোযোগ দিলেন। ঘন্টু মামা আর আমি বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে আসার সময় রিসিপশনের মেয়েটি এমনভাবে আমাদের দিকে তাঁকাচ্ছিল যেন পারলে গিলে খায় আর কি!

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমি ঘন্টু মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, এ কী গো! তুমি যে লোকটাকে রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল করছিলে? কী ব্যাপার বলো তো?

ঘন্টু মামা হেসে বললেন, সে অনেক কাহিনী। তোর জেনে কাজ নেই।

আমি বললাম, কিন্তু লোকটি তো কোন স্পন্সর করবেনা। এখন কী করবে? হাতে খুব একটা সময় নেই। শীঘ্রই টিম এন্ট্রি করতে হবে।

ঘন্টু মামা আবার রহস্যের হাসি হেসে বললেন, চিন্তা করিস না। কালকের মধ্যে দেখিস ঠিকই যোগাযোগ করবে। শোন, এদিকে কোন একটা দোকানে খুব ভালো বিরিয়ানী বিক্রি করেনা? এদিকে যখন এসেছি বিরিয়ানীটা খেয়েই যাই।

এই একটা ব্যাপারে ঘন্টু মামার কোন ক্লান্তি নেই। একটু আগেই যে পরিমাণ অপমানিত হয়ে এসেছেন তারপরও একজন মানুষ এতো নির্দ্বিধায় খাওয়ার কথা বলে কীভাবে! অপমান গিলে আমার পেট এমনিতেই ভরে গেছে তবুও ঘন্টু মামার পেছনে আমাকেও ছুটতে হলো।

ঘন্টু মামা (পর্ব-২)



ঘন্টু মামার বাসাটা আমাদের পাড়ার একেবারে মধ্যিখানে। একতলা এই বাসাটি ঘন্টু মামার বাবা তৈরি করেছিলেন। অনেক শখ করে তৈরি করলেও ঘন্টু মামার বাবা এ বাসায় একটি দিনও থাকতে পারেননি। ঘর সঞ্চয় করে যেদিন বাসায় উঠবেন, ঠিক আগের দিন রাতে হার্ট এটাক করে তিনি মারা যান। এই বাসা তৈরি করার আগে ঘন্টু মামারা এ পাড়াতেই একটা ভাড়া বাসায় থাকতেন। স্বামীর শখের বাসায় স্বামী থাকতে পারেননি সেই শোকে ঘন্টু মামার মাও এ বাড়িতে উঠলেন না। পাঁচ কক্ষের বাসাটি ভাড়া দিয়ে ঘন্টু মামার মা গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। ঘন্টু মামা তখন অনেক ছোট। তিনিও মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে ছুটলেন। কয়েক বছর গ্রামে থেকে ঘন্টু মামা তার কাকার সাথে আবার এই বাড়িতে এসে উঠলেন। তিনি ও তার কাকা বাইরের দিকে একটা ঘরে থাকা শুরু করলেন। বাকি ঘরগুলো ভাড়াই থাকলো।

ঘন্টু মামার কাকা পড়ুয়া মানুষ। তিনি সবসময় তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ঘন্টু মামাকে তিনি ক্লাস সিক্সে ভর্তি করিয়ে দিলেন বটে কিন্তু ভাইপোর দিকে নজর দেয়ার মতো এতো সময় তার কোথায়! আর এই সুযোগে ঘন্টু মামা দিনকে দিন বেয়াড়া হয়ে উঠলেন। পড়াশোনা সব শিকেয় উঠলো। কোনরকমে উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়েছেন। বিএ তে ভর্তিও হয়েছিলেন কিন্তু সেটা চালিয়ে যাওয়ার মতো ইচ্ছা ও মানসিকতা কোনটাই ঘন্টু মামার ছিলোনা। ঘন্টু মামার কাকা নরেন পিএইচডি করার জন্য কানাডা পাড়ি জমালে ঘন্টু মামা চূড়ান্ত স্বাধীনতা পেয়ে যান।

ঘন্টু মামার মা তার মেধাবী দেবরের সাথে ঘন্টু মামাকে শহরে পাঠিয়েছিলেন এই ভেবে যে, পড়ুয়া কাকার সংস্পর্শে থেকে ঘন্টু মামাও পড়াশোনাটা ঠিকমতো চালিয়ে যাবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! ঘন্টু মামার মা আপাতত অদৃষ্টকে দোষ দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন।

ঘন্টু মামার কাকার অনুপস্থিতিতে ঘন্টু মামার রুমটাকেই আমরা আমাদের ক্লাব ঘর বানিয়ে নিয়েছি। আসলে ক্লাব বলতে যা বোঝায় এটি সেরকম না। এখানে কোন প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারীর বালাই নেই। এটা আমাদের রাজত্ব, এখানে আমরা সবাই রাজা। তবে এটা মানতেই হবে আমাদের এই রাজত্বে ঘন্টু মামাই মূল কান্ডারী তবে কোনভাবেই তাঁকে স্বৈরাচারী বলা চলেনা। ঘন্টু মামা অনেকটা আমাদের গাইডের মতো।

আজ সন্ধ্যায় ঘন্টু মামা ক্লাবঘরে অর্থাৎ তার রুমে আমাদের সবাইকে ডেকেছেন। সচরাচর এভাবে আয়োজন করে সবাইকে ডাকা হয়না। তাই আমি অনুমান করছি কোন বিশেষ কারনে ঘন্টু মামা আমাদের আজ ডেকেছেন।

আমি আর রিজু গেট দিয়ে ঢুকতে যাবো তখন ঘন্টু মামা হাঁক দিলেন, এই মুন্না তুই এদিকে আয়। আর রিজু মান্নানের দোকানে চপের অর্ডার দেয়া আছে তুই সেগুলো নিয়ে আয়। মনে করে সঙ্গে ভাঁজা শুকনো মরিচ আনিস কিন্তু।

আমি ঘন্টু মামার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, কি ব্যাপার! সবাইকে এতো জরুরী তলব করেছো কেন?

ঘন্টু মামা রহস্যের হাসি হেসে বললেন, সবাই আসুক। জানতে পারবি।

আমার আর তর সইছিলোনা। বললাম, বলোইনা।

“আরে এতো উতলা হচ্ছিস কেন? এক কাজ কর তুই চেয়ারগুলোকে ঠিকঠাক করে রাখ। আমি ছাদ থেকে আসছি।”

ঘন্টু মামা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে আছে। ঘরজুড়ে পীনপতন নীরবতা। ঘন্টু মামাকে ঘিরে আমরা ছয়জন বসে আছি। সবাই অপেক্ষা করে আছি ঘন্টু মামার বক্তব্য শোনার জন্য। ঘন্টু মামা কথা বলতে যাবেন এমন সময় হাসু বলে উঠলো, চপগুলো টেবিলের ওপর থেকে সরিয়ে রাখা হোক। বারবার চপের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে।
হাসুর কথা শুনে ঘরজুড়ে হাসির রোল উঠলো। ঘন্টু মামার সিরিয়াস ভঙ্গিতেও ছেদ পড়লো। তিনি বললেন, আপনি এতো রাক্ষস কেন! নিজের লোভকে সামলে রাখতে পারেন না? সামনে খাবার থাকলেই লোভ করতে হবে নাকি!

ঘন্টু মামা হাসুকে আপনি করে সম্বোধন করছেন দেখে আমরা সবাই ভীষন আশ্চর্য্য হলাম। রিজু জিজ্ঞেস করলো, কি গো মামা! তুমি ওকে আপনি করে বলছো কেন!

“এখানে একটা সভা চলছে। সভার নিয়ম অনুসারে সবাইকে আপনি করে বলতে হয়। কাজেই সভা চলাকালীন তুমি-তুই এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা চলবেনা। সবাই সবাইকে সম্মান প্রদর্শন করে কথা বলতে হবে।”

আমরা মাথা নাড়লাম। তবে ব্যাপারটা বেশ মজা লাগলো। ঘন্টু মামার অগোচরে একে-অপরকে চিমটি কাটতে লাগলাম। ঘন্টু মামা গলা খাকারি দিয়ে বললেন, তাহলে সভা শুরু করা যাক।

আমরা সবাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। ঘন্টু মামা বলতে শুরু করলেন, আজ আমরা এখানে একটা বিশেষ কারনে মিলিত হয়েছি।

সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে রইলাম। ঘন্টু মামা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বললেন, আমি যতোটুকু জানি আপনাদের কারো এখন কোন পরীক্ষা বা অন্য কোন কাজ নেই। অনেক ভেবে-চিন্তে দেখলাম এই সময়টা এভাবে অলস বসে না থেকে আমরা কিছু একটা করতে পারি।

আমি বললাম, কী করা যায়?

ঘন্টু মামা বললেন, কী করা যায় আপনারা ভেবে বের করুন।

এবার সবার মধ্যে গুনগুন শুরু হলো। খানিক পরে রিজু বলল, আমরা কোথাও ঘুরে আসতে পারি?

ঘন্টু মামা বললেন, ঘুরাঘুরি আমরা অনেক করেছি। আপাতত ঘুরাঘুরি বাদ। অন্য কিছু চিন্তা করুন।

অনেক আলোচনা করেও কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাচ্ছিলোনা। আমি এমনিতেই বললাম, আগামী মাস থেকে কাউন্সিলর কাপ সিক্স এ সাইড ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হতে যাচ্ছে আমরা তাতে অংশ নিতে পারি।

কথাটা ঘন্টু মামার মনে ধরলো। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সবাই কি বলেন?

সাধারণত কেউ ঘন্টু মামার সিদ্ধান্তের বাইরে যায়না। কিন্তু এবার রিজু বলল, প্রস্তাবটা মন্দ নয় তবে কথা হচ্ছে আমাদের তো ভালো ব্যাট-বলই নেই খেলবো কীভাবে?

রিজুর কথার সাথে সবাই একমত। আসলেই আমাদের ভালো ব্যাট-বল নেই। হাসু বলল, আমরা সবাই চাঁদা দিয়ে ব্যাট-বল কিনতে পারি।

আমি বললাম, চাঁদা দিয়ে ব্যাট-বল হয়তো কেনা যাবে কিন্তু একটা টুর্নামেন্টে অংশ নিতে হলে এন্ট্রি ফিসহ অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। আমরা মাত্র কয়েকজন চাঁদা দিয়ে কীভাবে কী হবে? ঘন্টু মামা কী বলো?

“হু আমিও তোর কথার সাথে একমত। তুই খোঁজ নে টুর্নামেন্টের এন্ট্রি ফি কতো? আর প্রাইজমানিটা কেমন সেটাও খবর নিস।”

“শুনেছি প্রাইজমানিটা বেশ ভালোই। ইন্ডিভিচুয়ালী ম্যাচ ফির পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ান টিমকে একটা ফ্ল্যাট টিভি পুরস্কার দেবে।”

ঘন্টু মামা চোখ কপালে তুলে বলল, বলিস কীরে! খুব বড় স্পন্সরকে বাগিয়েছে মনে হচ্ছে! অংশ নিতে পারলে ভালোই হতো। ক্লাবের জন্য একটা টিভির ব্যবস্থা হয়ে যেতো।

সবাই ঘন্টু মামার কথায় সায় দিলাম। হাসু বলল, সবই তো বুঝলাম কিন্তু টাকা-পয়সা কীভাবে ম্যানেজ হবে?

ঘন্টু মামা বললেন, এতো চিন্তা করার কী আছে! তোর আইফোনটা বিক্রি করে দিলেই তো মোটা অংকের টাকা পাবো।
হাসু ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো সে কিছু বলতে যাচ্ছিলো পাশ থেকে আলম টিপ্পনী কেটে বললো, এভাবে হাতে হাতে বিক্রি করলে বেশী টাকা পাওয়া যাবেনা।

রিজু বললো, সমস্যা কী! এখন তো বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবহৃত জিনিস বিক্রি করা যায়। ওখানে অনেক ক্রেতা পাওয়া যায়। দামও বেশ ভালোই পাওয়া যায়।

হাসু অনেকক্ষন পর সুযোগ পেয়ে বলল, মোটেও আমি আমার আইফোন বিক্রি করবোনা। আমার মামা লন্ডন থেকে এটা পাঠিয়েছে।

আমি ব্যঙ্গ করে বললাম, ছি ছি হাসু! তুই আমাদের জন্য এই ছোট্ট সেক্রিফাইসটা করতে পারবি না!

হাসু মুখ কালো করেই জবাব দিল, তোর ট্যাবটাই বিক্রি করে দেসনা। ওটা বিক্রি করলেও ভালো টাকা পাওয়া যাবে।

ঘন্টু মামা এতোক্ষন চুপচাপ মজা দেখছিল। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে দেখে তিনি বললেন, কী শুরু করলি তোরা। আমি থাকতে তোদের চিন্তার কী আছে! তোদের কিচ্ছু বিক্রি করার দরকার নেই।

আমি বললাম, সে তো ঠিক আছে। কিন্তু গতবারের ফাংশানের কথা নিশ্চয় মনে আছে! এরপরও সহজে স্পন্সর পাবে বলে মনে করছো?

ঘন্টু মামা চিন্তিত মুখে বললেন, সেটা খানিকটা দুশ্চিন্তার বিষয়। তবে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে ফেলবো। আর যদি ম্যানেজ নাই করা যায় তাহলে বিকল্প ভাবনা ভেবে রেখেছি।

সবাই উৎসুক হয়ে একসাথে জিজ্ঞেস করলাম, কী ভাবনা?

ঘন্টু মামা বললেন, সবগুলা একসাথে কথা বলছিস কেন! যদি কোনভাবেই স্পন্সর যোগাড় না হয় তবে সেগুন গাছটা কেটে ফেলবো।

সেগুন গাছ কাটার কথা শুনেই আমরা সবাই আঁতকে উঠলাম। শুধু ঘন্টু মামার সাথেই নয়, এ পাড়ার সাথেই সেগুন গাছটির একটি আত্মিক বন্ধন হয়ে গেছে। ঘন্টু মামার বাবা এই বাসা তৈরির সময় সামনের উঠোনে গাছটি লাগিয়েছিলেন। আজ গাছটি একটি মহীরূহ হয়ে পুরো বাড়িটাকে ছায়া দিয়ে রেখেছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, পাগল হয়েছো নাকি! মাত্র ক’টা টাকার জন্য এতো বড় গাছ কাটবে? দরকার নেই টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার।

আমার কথায় সবাই সায় দিলো। রিজু বলল, এই সেগুন গাছের দাম কতো হবে জানো? কয়েক লাখ টাকা হবে। এটা কাটা হবে চূড়ান্ত বোকামী।

ঘন্টু মামা বললেন, আমি এখনই কাটবো বলছিনা। যদি টাকার ব্যবস্থা না হয় তখনই এটা কাটা যায় কিনা দেখবো। এছাড়া আমার কিছু দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা আছে। এজন্য অনেক টাকার দরকার।

আমি বললাম, পরিকল্পনাটা কী জানতে পারি?

ঘন্টু মামা বললেন, অনেক প্ল্যান করে রেখেছি। এছাড়া ক্লাবঘরের জন্য কিছু চেয়ার-টেবিল-আলমিরা বানাতে হবে। সেগুন গাছের কাঠ দিয়েই যদি তা করা যায় মন্দ কী! দক্ষ কাঠমিস্ত্রী দিয়ে আমরা কয়েকটা ভালো ব্যাট বানিয়ে নিতে পারি। এতে করে সারা বছর সবাই প্র্যাকটিসের মধ্যে থাকতে পারবে। এখন সবাই মনে মনে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করো।

ঘন্টু মামা (পর্ব-১)

আমার মায়ের সাথে কোন প্রকার আত্মীয়তার সম্পর্ক না থেকেও তিনি আমার মামা। কবে, কীভাবে যে তিনি আমার মামা হয়ে গিয়েছিলেন তা আমি নিজেও জানিনা।! আমার দেখাদেখি আমার সমবয়সীরাও তাঁকে মামা বলে ডাকা শুরু করেছিল। সেই থেকে তিনি আমাদের সবার প্রিয় ঘন্টু মামা।

ঘন্টু মামার ভালো নাম ঘনাচরণ সরকার। তবে খুব কমসংখ্যক লোকই তাঁকে এ নামে চেনে। সবার কাছে তিনি ঘন্টু নামেই বেশী পরিচিত। ঘন্টু মামা মানুষটা খুব মজার তবে অসম্ভব রকমের নরম মনের মানুষ। অন্যের দুঃখ-কষ্ট তিনি একদম সইতে পারেননা। পাড়ার গরীব অসহায় মানুষের এক অন্যতম ভরসার নাম ঘন্টু মামা। নিজে না খেয়ে হলেও তিনি অন্যের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে মরীয়া হয়ে উঠেন।

ঘন্টু মামার আরেকটা গুণ হচ্ছে তিনি খুব সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারেন। একেবারে অপরিচিত মানুষের সাথেও তিনি অল্প সময়ের মধ্যে মিশে যেতে পারেন। ঘন্টু মামার সাথে রাস্তায় বেরোলেই বোঝা যায় তিনি কতোটা পরিচিত! তার পরিচিতির ঠেলায় পাঁচ মিনিটের রাস্তা পেরুতে বিশ মিনিট লেগে যায়। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলি ইলেকশানে তোমাকে দাঁড় করিয়ে দিলে তুমি অনায়াসেই পাশ করে যাবে!

এলাকার মেয়ে মহলে ঘন্টু মামার আলাদা একটা কদর আছে। কতো যুগলের প্রেম-বিরহের গল্প রচিত হয়েছে ঘন্টু মামার হাত দিয়েই। পাড়ার উঠতি ছেলেরা ঘন্টু মামা বলতেই অজ্ঞান। ঘন্টু মামাকে বাদ দিয়ে পাড়ার কোন ধরনের খেলাধুলা বা ফাংশনের কথা চিন্তাই করা যায়না। খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্পন্সর যোগাড় করা সহ সব আয়োজনের অগ্রসৈনিক আমাদের প্রিয় ঘন্টু মামা।

জয়াদির সাথে ঘন্টু মামার এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক আছে। আমি আর আমাদের কাছের কয়েকজন ছাড়া এ বিষয়ে কেউ একটা জানেনা। ঘন্টু মামাও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাতে আগ্রহী না। ঘনাচরণ সরকার ওরফে ঘন্টু মামাকে আমি যেহেতু মামা বলে ডাকি সেহেতু উনার প্রেমিকাকে আমার মামী বলে সম্বোধন করা উচিত। কিন্তু এখানে ছোট্ট একটা গন্ডগোল আছে। গন্ডগোলটা বাঁধিয়েছেন ঘন্টু মামা স্বয়ং। আমার পাড়াতুতো সুন্দরী দিদির সাথে ঘন্টু মামা প্রেম করলে আমার কী করার আছে! জয়াদিকে ছোটবেলা থেকেই দিদি ডেকে অভ্যস্ত; এখন হঠাত করে মামী বলে ডাকি কেমন করে?

ঘন্টু মামা আর আমি হরিহর আত্মা। ঘন্টু মামা যেখানে আমি আছি সেখানে। আর যেহেতু আমি সবসময় উনার সাথে ছায়ার মতো সেঁটে আছি কাজেই ঘন্টু মামার অনেক অজানা কাহিনীরও প্রত্যক্ষদর্শী আমি।

অনেকদিন থেকেই আঁচ করছিলাম জয়াদি আর ঘন্টু মামার মধ্যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। রাস্তা বা অন্য কোথাও যখন দুজন একে-অপরের মুখোমুখি হতেন তখন তাদের অঙ্গভঙ্গিই বলে দিতো ডাল ম্যা কুচ কালা হ্যায়! প্রানোচ্ছ্বল, মিশুক আর সদা হাসোজ্জ্বল ঘন্টু মামাকেও দেখতাম কেমন জানি চুপসে যেতেন। জয়াদির সাথে কথা বলতে গেলেই ঘন্টু মামার কথা জড়িয়ে যেতো; জয়াদির মুখোমুখি হলে ঘন্টু মামার কথা শুনে যে কেউ মনে করবে কোনকালে ঘন্টু মামার তোতলানোর অভ্যাস ছিল। জয়াদিকে ঘন্টু মামার মতো এতোটা অপ্রস্তুত না দেখালেও স্পষ্টত বুঝা যেতো উনার মধ্যেও কিছু একটা ঘটছে। তবে জয়াদি তার স্বভাবসুলভ সুন্দর হাসি দিয়ে পুরো পরিস্থিতিটা সামলে নিতেন। এভাবেই অনেকদিন চলছিলো। কেউ আগ বাড়িয়ে মনের কথা খুলে বলতে পারছিলো না।

সে প্রায় বছর দেড়েক আগের কথা। একদিন বিকেলে জয়াদি তার কাকাতো ভাই দেবাকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন। জয়াদি আমায় ডেকেছেন শুনে আমি বিষ্মিত হলাম। দেবা নিতান্তই একটা বাচ্চা ছেলে। ওকে কারনটাও জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না। ভাবলাম ঘন্টু মামাকে একটা ফোন দেবো কিনা! পরক্ষণেই মনে হলো গিয়েই দেখি না কি ব্যাপার!

আজকাল জয়াদি খানিক রাগী রাগী হয়ে গেলেও তখন মোটেও রাগী ছিলেন না। তবু আমার কেন জানি ভয় ভয় করছিলো। আসলে অতিরিক্ত সুন্দরী জয়াদির আচরনে এমন একটা গাম্ভীর্য্য ছিল; যে কেউ তাঁকে সমীহ করে চলতে বাধ্য। আমি ভীরু ভীরু পায়ে জয়াদির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। এর আগেও আমি এ বাড়িতে কত্তো এসেছি। কখনো এতোটা ইতঃস্তত লাগেনি।

দরজায় নক করতেই জয়াদি দরজা খুলে দিলেন। ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই দেখলাম ঝর্না কাকীমা টিভিতে কী একটা অনুষ্ঠান দেখছেন। আমাকে দেখে বললেন, আরে মুন্না! তুই কোত্থেকে! আজকাল তো  তোকে দেখাই যায়না! বেশ বড় হয়ে গেছিস দেখছি। তা এবার কোন ক্লাসে উঠলি?

আমি বুক চিতিয়ে জবাব দিলাম, ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি।

কাকীমা অবাক হয়ে বলল, বলিস কীরে! সেদিনও তো দেখতাম তোর মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেতিস। বাব্বা! তোরা সবাই কতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলি! কোন কলেজে এডমিশন নিয়েছিস?

আমি উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। জয়াদি থামিয়ে দিয়ে বলল, মা কি শুরু করেছো? আসার পর থেকেই ওকে জেরা করে চলেছো! এই মুন্না আমার ঘরে চল।

আমি জয়াদির পিছু পিছু জয়াদির রুমে হাজির হলাম। রুমে ঢুকেই আমার বিষ্ময় আকাশ স্পর্শ করলো। পুরো ঘরের দেয়াল পার্পল রঙের ইমালশন রঙ দিয়ে রাঙ্গানো। দরজার বাঁ-পাশে দুটি আলমিরা ভর্তি বই আর বই। এক পলকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম নামী-দামী লেখকের বইয়ে আলমিরা ঠাসা। আলমিরার পাশে দেয়ালে সারি করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শেকসপীয়ার, ম্যাক্সিম গোর্কী, বঙ্গবন্ধু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের ছবি ঠাঙ্গানো।

ডানপাশে একটা হোম থিয়েটার সেট করা হয়েছে। হোম থিয়েটারের পাশেই দুটো সেলফভর্তি হরেক রকম ডিভিডি। ঘরের ঠিক মাঝখানে শুভ্র সাদা চাদর বিছানো একটা খাট। বালিশের উপর আধখোলা ল্যাপটপ। খাটের পাশে টেবিলে ছড়ানো কয়েকটি কাগজের টুকরো। মেঝেজুড়ে বিছানো মখমলের কার্পেট। পুরো ঘরের মধ্যে যেন একটা সুভাষ ছড়ানো। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো আমি কোন স্বর্গালোকে প্রবেশ করেছি। বিষ্মিত হয়ে জয়াদিকে বললাম, এ কী গো! আমার তো মনে হচ্ছে আমি এক ভিন্নজগতে এসে পড়েছি।

জয়াদি মৃদু হাসলো। আমার ঘোর তখনো কাটছেনা। আমি বললাম, এই বইগুলো কী তুমি পড়? এই ডিভিডিগুলোও কি তোমার?

জয়াদি বলে, তোর কি মনে হয়?

আমি বললাম, ঘরটাকে তো পুরো স্বর্গ বানিয়ে রেখেছো।

জয়াদি মৃদু হাসলো। তারপর বলল, তুই বস। আমি তোর জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।

জয়াদি পাশের ঘরে চলে যেতেই আবার বুকে ধুকপুকানি শুরু হলো, জয়াদি কেন আমায় ডেকে পাঠালো!

খানিক পরেই জয়াদি একপ্লেট সন্দেশ আর এক গ্লাস পানি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমার সামনে প্লেট রেখে বলল, নে খা।
আমি বললাম, পাগল হয়েছো এতো সন্দেশ খাবো কী করে?
যতোটা পারিস খা। বাকিগুলো তোর গুরুদেব ঘনাচরণের জন্য নিয়ে যাস।

সন্দেশগুলো খাঁটি গরুর দুধ থুক্কু গরুর খাঁটি দুধের ক্ষীর দিয়ে তৈরি। বেশ মজা করে তিনটে সন্দেশ খেয়ে নিলাম। প্লেটে পড়ে রইলো আরো তিনটে সন্দেশ। সন্দেশগুলো এতোটাই সুস্বাদু যে ইচ্ছে করছিলো আরো দু-একটা খেতে। তবে ইচ্ছেকে দমন করলাম কেননা বেশী খেলে জয়াদি আবার আমাকে রাক্ষস ভেবে বসতে পারে।

ঢক ঢক করে পানির গ্লাস শেষ করতেই জয়াদি বলল, তোকে আজ একটা কাজে ডেকেছি।

আমি জিজ্ঞাসু চোখে জয়াদির দিকে তাঁকালাম। জয়াদি ভাঁজ করা একটা সাদা কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা তোর ঘন্টু মামাকে দিবি।

আমি মনে মনে এরকম কিছুই আন্দাজ করছিলাম। আমি বাধ্য ছেলের মতো কাগজটা বুক পকেটে ভরে উঠে দাঁড়ালাম। জয়াদিকে খানিকটা লজ্জ্বিত দেখাচ্ছে। আমি পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, তুমি কোন চিন্তা করোনা। আমি ঠিকঠাক ঘন্টু মামার কাছে পৌছে দেব।

জয়াদি আমাকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় জয়াদি পেছন থেকে বলল, মুন্না আর কাউকে কাগজটি দেখাস নে আমার লক্ষী ভাই। আমি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে তড়তড় করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম।

জয়াদির বাসা থেকে বেরিয়ে বুঝলাম আমার ছোট্ট পকেটে চিঠিখানা বড্ড ভারী হয়ে গেছে। যার জিনিস তার হাতে পৌছে না দেয়া পর্যন্ত শান্তি পাবোনা। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এখন মান্নানের চা স্টলে গেলেই ঘন্টু মামাকে পেয়ে যাবো। তাই সোজা মান্নানের চা স্টলের দিকে রওয়ানা দিলাম।

মান্নানের চা স্টলের কাছাকাছি পৌছতেই মান্নানের স্পেশাল আলুচপের গন্ধ নাকে ভেসে এলো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মান্নানের স্পেশাল আলুচপ খাওয়ার জন্য দূর-দূরান্তের মানুষ ভীড় জমায় এ পাড়াতে। এ পাড়ার অনেক রহস্যের মধ্যে মান্নানের স্পেশাল আলুচপ আরো একটা গুরুতর রহস্য। আর দশটা দোকানের প্রচলিত আলুচপ থেকে এর স্বাদ ও আকৃতি সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের। ঘন্টু মামা মান্নানকে পটিয়ে এই স্পেশাল আলু চপ তৈরির কলাকৌশল জানার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে আশাহত হতে হয়েছে। মান্নান কোনভাবেই তার ব্যবসায়িক রহস্য ফাঁস করতে রাজী নয়। ঘন্টু মামা একবার ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন, আমি তোর আলুচপের সেম্পল বিএসটিআই এ পাঠাবো। না জানি কি সব বিষ-টিষ সবাইকে খাওয়াচ্ছিস! পরীক্ষা করে যদি পাওয়া যায় উল্টোপাল্টা কিছু মিশিয়ে আলুচপ তৈরি করিস তাহলে কিন্তু সোজা চৌদ্দ শিকের ভেতরে পাঠাবে। বিয়ে না করেও শ্বশুরবাড়ি দেখে আসবি। তবে কোন প্রকার ভয় দেখিয়েও লাভ হয়নি, মান্নান তার আটাশখানা দাঁত কেলিয়ে সব হুমকি বাতাসে ঊড়িয়ে দিয়েছে।

এখন মান্নানের ব্যবসার পিক আওয়ার। দোকানে মানুষ গিজগিজ করছে। চারটে বেঞ্চের সবগুলোই বহিরাগত মানুষের দখলে। চা স্টলের বাইরের দিকে একটা বেঞ্চে ঘন্টু মামা আর রাজু বসে আছে। ঘন্টু মামার এক হাতে আলু চপ, আরেক হাতে আরেকহাতে চায়ের কাপ। তিনি আলুচপে একটা কামড় বসিয়ে মান্নানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বিষ-টিষ যাই মেশাশ না কেনো রে ভাই, তোর এই আলুচপ না খেয়ে একটা দিনও কাটাতে পারবোনা। ধন্যি তোর মায়ের পেটের।

মান্নান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, চপ তৈরি করছি আমি আর ধন্যি আমার মায়ের পেটের কেন?

ঘন্টু মামা চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বললেন, আরে গাড়ল এটাও বুঝলি না। যে মায়ের ছেলে এমন অমৃত বানাতে পারে তার পেটকে ধন্যি না দিয়ে উপায় আছে!

ঘন্টু মামা আলুচপে আরেকটা কামড় দিতে যাচ্ছিলেন তখন আমি উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তোমার সাথে জরুরী কথা আছে। একটু উঠে এসো।

ঘন্টু মামা চপে মজে আছে, আমার কথা শোনার সময় কোথায়! আমাকে বসার ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, ওসব কথাটথা পরে হবে, আগে একটা আলুচপ খেয়ে নে।

আমি রাগ দেখিয়ে বললাম, তোমার শুধু খাওয়া আর খাওয়া! তুমি এতো পেটুক কেন?

ঘন্টু মামা হো হো করে হেসে উঠলেন। জগতে খাওয়া ছাড়া আর কি আছে বল! তার ওপর মান্নানের স্পেশাল আলুচপ হলে তো আর কথাই নেই।

উত্তেজনায় আমার হার্টবিট এমনিতেই অনেক বেড়ে গেছে; আর চাপ সামলাতে পারছিলাম না। জয়াদি বলে দিয়েছে আর কেউ যেন না দেখে তাই সবার সামনে চিঠিখানা দিতেও পারছিনা। আমি আকুতির স্বরে বললাম, প্লীজ একটু আসবে। খুব জরুরী দরকার।

মুখ কাঁচুমাচু করে বলায় কাজ হলো। ঘন্টু মামা উঠলেন। মান্নানকে বললেন, ওই আরো দুইটা চপ ভালো করে ভেজে রাখ। আমি আসছি।

ঘন্টু মামা আর আমি দোকানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবছা অন্ধকারে ঘন্টু মামার হাতে কাগজটি তুলে দিলাম। কাগজ হাতে নিয়ে ঘন্টু মামা জিজ্ঞেস করলেন, কী এটা?

আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম, খুলেই দেখোনা।

ঘন্টু মামা তার বিখ্যাত নোকিয়া ১১০০ মডেলের সেটখানা বের করে টর্চ লাইটের আলো জ্বেলে কাগজে চোখ রাখলেন। অন্ধকারে ঘন্টু মামার মুখের মানচিত্র ঠিক বুঝা যাচ্ছিলোনা। বেশ খানিকক্ষণ মৌন থাকার পর ঘন্টু মামা নীরবতা ভাঙ্গলেন, অ্যাইরে! যা আন্দাজ করেছিলাম শেষ পর্যন্ত তা সত্যি হয়ে গেলো দেখছি!

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি খুশী হওনি?

ঘন্টু মামা বললেন, এতে খুশী হওয়ার কি আছে? বুঝলি এসব প্রেম-ট্রেম আমার জন্য না। জয়াকে তো বুদ্ধিমতী মেয়ে বলেই জানতাম। ও এমন কান্ড করে বসবে বুঝতে পারিনি!

আমার খুব রাগ হতে লাগলো। ভাব নিচ্ছো, তাইনা? এখন সব দোষ জয়াদির! জয়াদি সামনে এলে তোমার অবস্থা কি হয় সে আমার দেখা আছে। নিজে আগ বাড়িয়ে প্রপোজ করার মুরোদ তো নেই ই। উলটো আরেকজনকে দোষারোপ করছে!

ঘন্টু মামা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই এতো রাগ করছিস কেন?

আমি রাগ করবো কেন! আমি তোমার ভাব নেওয়া দেখে বিষ্মিত হচ্ছি মাত্র। তোমার সাত জন্মের ভাগ্য জয়াদির মতো ধনীর দুলালী তোমাকে আগ বাড়িয়ে প্রপোজ করেছে।

ঘন্টু মামা হো হো করে হেসে উঠলেন, জয়া তোকে কতো ঘুষ দিয়েছে বলতো? সেই কখন থেকে ওর হয়ে ওকালতি করেই যাচ্ছিস!

ধুর বাবা আমার কী! আমি তো শুধু চেয়েছি তোমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক হোক। আচ্ছা সত্যি করে বলো তো তুমি জয়াদিকে ভালোবাসোনা? তোমার উত্তর না হলে আমি এখনই জয়াদিকে জানিয়ে আসবো।

ক্ষেপেছিস! ঘরের লক্ষী পায়ে টেলতে আছে! আমি জীবনেও ওকে আগ বাড়িয়ে ভালোলাগার কথা বলতে পারতাম না। এখনই তো ওর চোখের দিকে ভালো করে তাঁকাতে পারিনা; এরপর তো আর তাঁকাতেই পারবোনা

কেন জয়াদির চোখে বিজলী আছে নাকি যে তাঁকালে তোমার চোখ ঝলসে যাবে!

বিজলী বলিস কীরে! বল এটম বোমা! ওই চোখে তাঁকালেই বুকে বিস্ফোরন শুরু হয়ে যায়।

ভালোই তো। হ্যাঁ বলে দাও চট করে।

অনেক সমস্যা আছে

সমস্যার দোহাই দেয়া তোমার মানায় না।

দেখ এ জীবনে এ পাড়ার কতো জনেরই প্রেম-বিরহের গল্প আমার হাত দিয়ে লেখা হয়েছে। তাতে করে বুঝেছি প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে একটা দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হয়ে যায়। নিজের মধ্যে রেসপনসিবিলিটি না থাকলে একটা সম্পর্কের ভার বহন করে চলা খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। জবাবদিহিতা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। আসল সমস্যা হলো রেসপনসিবিলিটি। আমি আমার নিজেকে তো চিনি তাই যতো দুশ্চিন্তা।

ঘন্টু মামার কথা শুনে আমি চূড়ান্ত বিষ্মিত। আমি বললাম, এ কী গো মামা! তুমি এতো জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলছো যে!

জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বললাম কোথায়? এটা হচ্ছে প্র্যাক্টিক্যাল জ্ঞান। চোখের সামনে অনেককেই তো দেখছি তাই বললাম।

আমি এতোকিছু বুঝতে চাইনা। তোমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক হচ্ছে এটাই ফাইনাল কথা। আমি কালকেই জয়াদিকে বলে দেবো তুমি উনার প্রস্তাব গ্রহন করেছো। এবার চলো মান্নানের স্পেশাল আলুচপ খাওয়াবে।

যাই হোক এভাবেই ঘন্টু মামা আর জয়াদির মধ্যে একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। গত দেড় বছর থেকে দেখছি ওরা দুজন ভালো-মন্দের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছে। জয়াদি প্রতিনিয়ত ঘন্টুমামাকে ঘরমুখো রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোন প্রচেষ্ঠাই কাজ দিচ্ছেনা। ঘন্টু মামা আছেন ঘন্টু মামার মতো। যদিও অনেকের কাছেই ঘন্টুমামার কাজকর্ম নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। তবে আমাদের কাছে ঘন্টু মামা ইজ দ্য বস। ঘন্টু মামাকে বাদ দিয়ে আমরা কোন কাজের কথা চিন্তাই করতে পারিনা।
Copyright © 2014 রিপন ঘোষের খেরোখাতা All Right Reserved
^
Blogger দ্বারা পরিচালিত.