আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে

Latest News:

রবিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৫

ঘন্টু মামা (পর্ব-২)



ঘন্টু মামার বাসাটা আমাদের পাড়ার একেবারে মধ্যিখানে। একতলা এই বাসাটি ঘন্টু মামার বাবা তৈরি করেছিলেন। অনেক শখ করে তৈরি করলেও ঘন্টু মামার বাবা এ বাসায় একটি দিনও থাকতে পারেননি। ঘর সঞ্চয় করে যেদিন বাসায় উঠবেন, ঠিক আগের দিন রাতে হার্ট এটাক করে তিনি মারা যান। এই বাসা তৈরি করার আগে ঘন্টু মামারা এ পাড়াতেই একটা ভাড়া বাসায় থাকতেন। স্বামীর শখের বাসায় স্বামী থাকতে পারেননি সেই শোকে ঘন্টু মামার মাও এ বাড়িতে উঠলেন না। পাঁচ কক্ষের বাসাটি ভাড়া দিয়ে ঘন্টু মামার মা গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। ঘন্টু মামা তখন অনেক ছোট। তিনিও মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে ছুটলেন। কয়েক বছর গ্রামে থেকে ঘন্টু মামা তার কাকার সাথে আবার এই বাড়িতে এসে উঠলেন। তিনি ও তার কাকা বাইরের দিকে একটা ঘরে থাকা শুরু করলেন। বাকি ঘরগুলো ভাড়াই থাকলো।

ঘন্টু মামার কাকা পড়ুয়া মানুষ। তিনি সবসময় তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ঘন্টু মামাকে তিনি ক্লাস সিক্সে ভর্তি করিয়ে দিলেন বটে কিন্তু ভাইপোর দিকে নজর দেয়ার মতো এতো সময় তার কোথায়! আর এই সুযোগে ঘন্টু মামা দিনকে দিন বেয়াড়া হয়ে উঠলেন। পড়াশোনা সব শিকেয় উঠলো। কোনরকমে উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়েছেন। বিএ তে ভর্তিও হয়েছিলেন কিন্তু সেটা চালিয়ে যাওয়ার মতো ইচ্ছা ও মানসিকতা কোনটাই ঘন্টু মামার ছিলোনা। ঘন্টু মামার কাকা নরেন পিএইচডি করার জন্য কানাডা পাড়ি জমালে ঘন্টু মামা চূড়ান্ত স্বাধীনতা পেয়ে যান।

ঘন্টু মামার মা তার মেধাবী দেবরের সাথে ঘন্টু মামাকে শহরে পাঠিয়েছিলেন এই ভেবে যে, পড়ুয়া কাকার সংস্পর্শে থেকে ঘন্টু মামাও পড়াশোনাটা ঠিকমতো চালিয়ে যাবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! ঘন্টু মামার মা আপাতত অদৃষ্টকে দোষ দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন।

ঘন্টু মামার কাকার অনুপস্থিতিতে ঘন্টু মামার রুমটাকেই আমরা আমাদের ক্লাব ঘর বানিয়ে নিয়েছি। আসলে ক্লাব বলতে যা বোঝায় এটি সেরকম না। এখানে কোন প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারীর বালাই নেই। এটা আমাদের রাজত্ব, এখানে আমরা সবাই রাজা। তবে এটা মানতেই হবে আমাদের এই রাজত্বে ঘন্টু মামাই মূল কান্ডারী তবে কোনভাবেই তাঁকে স্বৈরাচারী বলা চলেনা। ঘন্টু মামা অনেকটা আমাদের গাইডের মতো।

আজ সন্ধ্যায় ঘন্টু মামা ক্লাবঘরে অর্থাৎ তার রুমে আমাদের সবাইকে ডেকেছেন। সচরাচর এভাবে আয়োজন করে সবাইকে ডাকা হয়না। তাই আমি অনুমান করছি কোন বিশেষ কারনে ঘন্টু মামা আমাদের আজ ডেকেছেন।

আমি আর রিজু গেট দিয়ে ঢুকতে যাবো তখন ঘন্টু মামা হাঁক দিলেন, এই মুন্না তুই এদিকে আয়। আর রিজু মান্নানের দোকানে চপের অর্ডার দেয়া আছে তুই সেগুলো নিয়ে আয়। মনে করে সঙ্গে ভাঁজা শুকনো মরিচ আনিস কিন্তু।

আমি ঘন্টু মামার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, কি ব্যাপার! সবাইকে এতো জরুরী তলব করেছো কেন?

ঘন্টু মামা রহস্যের হাসি হেসে বললেন, সবাই আসুক। জানতে পারবি।

আমার আর তর সইছিলোনা। বললাম, বলোইনা।

“আরে এতো উতলা হচ্ছিস কেন? এক কাজ কর তুই চেয়ারগুলোকে ঠিকঠাক করে রাখ। আমি ছাদ থেকে আসছি।”

ঘন্টু মামা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে আছে। ঘরজুড়ে পীনপতন নীরবতা। ঘন্টু মামাকে ঘিরে আমরা ছয়জন বসে আছি। সবাই অপেক্ষা করে আছি ঘন্টু মামার বক্তব্য শোনার জন্য। ঘন্টু মামা কথা বলতে যাবেন এমন সময় হাসু বলে উঠলো, চপগুলো টেবিলের ওপর থেকে সরিয়ে রাখা হোক। বারবার চপের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে।
হাসুর কথা শুনে ঘরজুড়ে হাসির রোল উঠলো। ঘন্টু মামার সিরিয়াস ভঙ্গিতেও ছেদ পড়লো। তিনি বললেন, আপনি এতো রাক্ষস কেন! নিজের লোভকে সামলে রাখতে পারেন না? সামনে খাবার থাকলেই লোভ করতে হবে নাকি!

ঘন্টু মামা হাসুকে আপনি করে সম্বোধন করছেন দেখে আমরা সবাই ভীষন আশ্চর্য্য হলাম। রিজু জিজ্ঞেস করলো, কি গো মামা! তুমি ওকে আপনি করে বলছো কেন!

“এখানে একটা সভা চলছে। সভার নিয়ম অনুসারে সবাইকে আপনি করে বলতে হয়। কাজেই সভা চলাকালীন তুমি-তুই এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা চলবেনা। সবাই সবাইকে সম্মান প্রদর্শন করে কথা বলতে হবে।”

আমরা মাথা নাড়লাম। তবে ব্যাপারটা বেশ মজা লাগলো। ঘন্টু মামার অগোচরে একে-অপরকে চিমটি কাটতে লাগলাম। ঘন্টু মামা গলা খাকারি দিয়ে বললেন, তাহলে সভা শুরু করা যাক।

আমরা সবাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। ঘন্টু মামা বলতে শুরু করলেন, আজ আমরা এখানে একটা বিশেষ কারনে মিলিত হয়েছি।

সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে রইলাম। ঘন্টু মামা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বললেন, আমি যতোটুকু জানি আপনাদের কারো এখন কোন পরীক্ষা বা অন্য কোন কাজ নেই। অনেক ভেবে-চিন্তে দেখলাম এই সময়টা এভাবে অলস বসে না থেকে আমরা কিছু একটা করতে পারি।

আমি বললাম, কী করা যায়?

ঘন্টু মামা বললেন, কী করা যায় আপনারা ভেবে বের করুন।

এবার সবার মধ্যে গুনগুন শুরু হলো। খানিক পরে রিজু বলল, আমরা কোথাও ঘুরে আসতে পারি?

ঘন্টু মামা বললেন, ঘুরাঘুরি আমরা অনেক করেছি। আপাতত ঘুরাঘুরি বাদ। অন্য কিছু চিন্তা করুন।

অনেক আলোচনা করেও কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাচ্ছিলোনা। আমি এমনিতেই বললাম, আগামী মাস থেকে কাউন্সিলর কাপ সিক্স এ সাইড ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হতে যাচ্ছে আমরা তাতে অংশ নিতে পারি।

কথাটা ঘন্টু মামার মনে ধরলো। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সবাই কি বলেন?

সাধারণত কেউ ঘন্টু মামার সিদ্ধান্তের বাইরে যায়না। কিন্তু এবার রিজু বলল, প্রস্তাবটা মন্দ নয় তবে কথা হচ্ছে আমাদের তো ভালো ব্যাট-বলই নেই খেলবো কীভাবে?

রিজুর কথার সাথে সবাই একমত। আসলেই আমাদের ভালো ব্যাট-বল নেই। হাসু বলল, আমরা সবাই চাঁদা দিয়ে ব্যাট-বল কিনতে পারি।

আমি বললাম, চাঁদা দিয়ে ব্যাট-বল হয়তো কেনা যাবে কিন্তু একটা টুর্নামেন্টে অংশ নিতে হলে এন্ট্রি ফিসহ অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। আমরা মাত্র কয়েকজন চাঁদা দিয়ে কীভাবে কী হবে? ঘন্টু মামা কী বলো?

“হু আমিও তোর কথার সাথে একমত। তুই খোঁজ নে টুর্নামেন্টের এন্ট্রি ফি কতো? আর প্রাইজমানিটা কেমন সেটাও খবর নিস।”

“শুনেছি প্রাইজমানিটা বেশ ভালোই। ইন্ডিভিচুয়ালী ম্যাচ ফির পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ান টিমকে একটা ফ্ল্যাট টিভি পুরস্কার দেবে।”

ঘন্টু মামা চোখ কপালে তুলে বলল, বলিস কীরে! খুব বড় স্পন্সরকে বাগিয়েছে মনে হচ্ছে! অংশ নিতে পারলে ভালোই হতো। ক্লাবের জন্য একটা টিভির ব্যবস্থা হয়ে যেতো।

সবাই ঘন্টু মামার কথায় সায় দিলাম। হাসু বলল, সবই তো বুঝলাম কিন্তু টাকা-পয়সা কীভাবে ম্যানেজ হবে?

ঘন্টু মামা বললেন, এতো চিন্তা করার কী আছে! তোর আইফোনটা বিক্রি করে দিলেই তো মোটা অংকের টাকা পাবো।
হাসু ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো সে কিছু বলতে যাচ্ছিলো পাশ থেকে আলম টিপ্পনী কেটে বললো, এভাবে হাতে হাতে বিক্রি করলে বেশী টাকা পাওয়া যাবেনা।

রিজু বললো, সমস্যা কী! এখন তো বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবহৃত জিনিস বিক্রি করা যায়। ওখানে অনেক ক্রেতা পাওয়া যায়। দামও বেশ ভালোই পাওয়া যায়।

হাসু অনেকক্ষন পর সুযোগ পেয়ে বলল, মোটেও আমি আমার আইফোন বিক্রি করবোনা। আমার মামা লন্ডন থেকে এটা পাঠিয়েছে।

আমি ব্যঙ্গ করে বললাম, ছি ছি হাসু! তুই আমাদের জন্য এই ছোট্ট সেক্রিফাইসটা করতে পারবি না!

হাসু মুখ কালো করেই জবাব দিল, তোর ট্যাবটাই বিক্রি করে দেসনা। ওটা বিক্রি করলেও ভালো টাকা পাওয়া যাবে।

ঘন্টু মামা এতোক্ষন চুপচাপ মজা দেখছিল। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে দেখে তিনি বললেন, কী শুরু করলি তোরা। আমি থাকতে তোদের চিন্তার কী আছে! তোদের কিচ্ছু বিক্রি করার দরকার নেই।

আমি বললাম, সে তো ঠিক আছে। কিন্তু গতবারের ফাংশানের কথা নিশ্চয় মনে আছে! এরপরও সহজে স্পন্সর পাবে বলে মনে করছো?

ঘন্টু মামা চিন্তিত মুখে বললেন, সেটা খানিকটা দুশ্চিন্তার বিষয়। তবে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে ফেলবো। আর যদি ম্যানেজ নাই করা যায় তাহলে বিকল্প ভাবনা ভেবে রেখেছি।

সবাই উৎসুক হয়ে একসাথে জিজ্ঞেস করলাম, কী ভাবনা?

ঘন্টু মামা বললেন, সবগুলা একসাথে কথা বলছিস কেন! যদি কোনভাবেই স্পন্সর যোগাড় না হয় তবে সেগুন গাছটা কেটে ফেলবো।

সেগুন গাছ কাটার কথা শুনেই আমরা সবাই আঁতকে উঠলাম। শুধু ঘন্টু মামার সাথেই নয়, এ পাড়ার সাথেই সেগুন গাছটির একটি আত্মিক বন্ধন হয়ে গেছে। ঘন্টু মামার বাবা এই বাসা তৈরির সময় সামনের উঠোনে গাছটি লাগিয়েছিলেন। আজ গাছটি একটি মহীরূহ হয়ে পুরো বাড়িটাকে ছায়া দিয়ে রেখেছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, পাগল হয়েছো নাকি! মাত্র ক’টা টাকার জন্য এতো বড় গাছ কাটবে? দরকার নেই টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার।

আমার কথায় সবাই সায় দিলো। রিজু বলল, এই সেগুন গাছের দাম কতো হবে জানো? কয়েক লাখ টাকা হবে। এটা কাটা হবে চূড়ান্ত বোকামী।

ঘন্টু মামা বললেন, আমি এখনই কাটবো বলছিনা। যদি টাকার ব্যবস্থা না হয় তখনই এটা কাটা যায় কিনা দেখবো। এছাড়া আমার কিছু দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা আছে। এজন্য অনেক টাকার দরকার।

আমি বললাম, পরিকল্পনাটা কী জানতে পারি?

ঘন্টু মামা বললেন, অনেক প্ল্যান করে রেখেছি। এছাড়া ক্লাবঘরের জন্য কিছু চেয়ার-টেবিল-আলমিরা বানাতে হবে। সেগুন গাছের কাঠ দিয়েই যদি তা করা যায় মন্দ কী! দক্ষ কাঠমিস্ত্রী দিয়ে আমরা কয়েকটা ভালো ব্যাট বানিয়ে নিতে পারি। এতে করে সারা বছর সবাই প্র্যাকটিসের মধ্যে থাকতে পারবে। এখন সবাই মনে মনে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা আমার লেখনীকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। দয়া করে অশালীন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।

Copyright © 2014 রিপন ঘোষের খেরোখাতা All Right Reserved
^
Blogger দ্বারা পরিচালিত.