আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে

Latest News:

রবিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৪

ভার্চুয়াল জীবন

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর বালিশে হেলান দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে ব্ল্যাক কফির মগে চুমুক দিতে দিতে নেট ইউজ করাটা রক্তিমের একটা বিশেষ শখ। অফিস চলাকালীন সময়ে ইন্টারনেট ইউজ করলেও ফেসবুকে সময় দেয়া যায়না। তাই রাতের এই সময়টায় সে মূলত ফেসবুকেই সময় দেয় বেশী। ফেসবুকের হোমপেজ ব্রাউজ করতে করতে হঠাৎ রাহাতের স্ট্যাটাসে তার চোখ আটকে যায়। রাহাত এবং তার কয়েকজন বন্ধু মিলে ওই স্ট্যাটাসে জমজমাট আড্ডা দিচ্ছে। মাত্র ত্রিশ মিনিটে কমেন্টের সংখ্যা সত্তর ছাড়িয়ে গেছে! রক্তিম সবগুলো কমেন্ট মন দিয়ে পড়লো। যুথি নামের একটি মেয়ে আড্ডা বেশ জমিয়ে তুলেছে। কমেন্টগুলো দেখে রক্তিমের বেশ মজা লাগছিলো। সেও একটা কমেন্ট ছুড়ে দিলো, কি রে তোরা কি করছিস?

রাহাত রাগের ইমো দিয়ে বলে, গরুর ঘাস কাটছি! আজকাল চোখেও কম দেখছিস নাকি? রক্তিম উত্তর দেয়ার আগেই যুথি নামের মেয়েটা রক্তিমকে উদ্দেশ্য করে লিখে, রাহাত ভাই তোমার বন্ধুর চোখের লেন্স চেঞ্জ করতে হবে। তারপর শুরু হলো কমেন্টের মাধ্যমে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া। যুথির কথার তোড়ে রক্তিম প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলছিলো। একসময় যুথি বলে, বন্ধুরা যাচ্ছি। অনেক ঘুম পেয়েছে। কারো উত্তরের অপেক্ষা না করেই যুথি অফলাইন হলো। রক্তিম চাইছিলো যুথি আরো কিছুক্ষণ থাকুক। ওর সাথে কথা বলতে বেশ মজা লাগছিলো।

রক্তিম তারপরও বেশ খানিকক্ষণ কমেন্টগুলোয় চোখ বুলালো। যুথির কমেন্টগুলো বেশ ঝরঝরে, প্রানোচ্ছ্বল। সে অবচেতন মনে যুথির নামে ক্লিক করলো। যুথির প্রোফাইলে অনেক সুন্দর একটি প্রজাপতির ছবি দেয়া। ইনফোতে বিশেষ কিছু লেখা নেই। তবে ছবিটি দেখেই যে কারো ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে ইচ্ছে করবে। রিকুয়েস্ট পাঠাবে কি পাঠাবে না, ভাবতে ভাবতে রক্তিম শেষ পর্যন্ত ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই দিলো।

আড্ডায় আড্ডায় অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। রক্তিম ঘড়ির দিকে তাঁকাতে দেখলো রাত দেড়টা বাজে। সচরাচর সে সাড়ে বারোটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। তা নাহলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরী হয়ে যায়। আর দেরীতে ঘুম থেকে ওঠা মানে অফিসে যেতে দেরী হওয়া।

রক্তিম ল্যাপটপ বন্ধ করে পাশে তাকাতে দেখলো নীলা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় নীলাকে অনিন্দ্য সুন্দর দেখাচ্ছে। ছাব্বিশ বছর বয়সের নীলার বয়স যেন বছর পাঁচেক কমে গেছে। ঘুমের ঘোরে নীলার গোলাপী রঙের শাড়িটা হাটু পর্যন্ত উঠে গেছে। নীলচে আলোর স্নিগ্ধ প্রতিপ্রভা বিচ্ছুরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ওর সমস্ত মুখাবয়বে। আলো-ছায়ার খেলা, নীলার দুধে-আলতা মাখানো ফর্সা মুখমন্ডলে সৌন্দর্য্যের প্রলেপ আরেকটু এঁকে দিচ্ছে। নীলার ঠোটের পাতা খানিকটা ফাঁক হয়ে রয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে নাক দিয়ে নিঃশ্বাস না ছেড়ে ও ওষ্ঠদ্বয়ের ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। নীলার এমন মায়াবী রূপ দেখে রক্তিমের বেশ ভালো লাগছিলো, ইচ্ছে করছিলো নীলার কোমল ওষ্টে আলতো করে একটা চুমু এঁকে দেয়। কিন্তু এই মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে নীলা ভীষণ রাগ করবে। রক্তিম চায়না তার সোনা বৌ কোনভাবেই তার ওপর রাগ করুক। সে নিজেকে সংযত করে পাশ ফিরে শোয়।

পরদিন বেশ দেরীতে নীলার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে রক্তিমের। তাড়াহুড়ো করে নাস্তা সেরে অফিসে রওয়ানা দেয়। যাওয়ার আগে দরজার কপাট আড়াল করে নীলার স্নিগ্ধ ঠোটে একটা চুমু এঁকে দেয়। রক্তিম চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত নীলা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।

অফিসের প্রবেশ পথে করিডোরে এম.ডি সাহেবের সাথে রক্তিমের দেখা। করমর্দনের জন্য রক্তিমের দিকে ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে তিনি সহাস্যে বললেন, কি ব্যাপার রক্তিম, আজ এতো দেরী যে?

রক্তিম লজ্জ্বাবনত মুখে বলে, না স্যার, ঘুম থেকে সময়মতো উঠতে পারিনি তাই একটু লেট হয়ে গেছে।

এম.ডি ফারুক সাহেব মৃদু হাসি দিয়ে বলেন, ইটস ওকে, প্রতিদিনই তো সময়মতো আসো, একদিন দেরী হলে বিব্রতবোধ করার কোন কারণ নেই। তোমার টেবিলে গিয়ে মুবিন ব্রাদার্সের ফাইলটা আমার রুমে পাঠিয়ে দিও। বলেই করিডোরের দক্ষিণ কোণে নিজের রুমে প্রবেশ করলেন এমডি।

রক্তিম কিছুটা চাপমুক্ত হয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে। মুবিন ব্রাদার্সের ফাইলটা আরেকবার চেক করে বেয়ারাকে দিয়ে এম.ডির রুমে পাঠিয়ে দিলো। আর বেয়ারাকে বলে দিলো, আসার সময় যেন এক কাপ কড়া লীকার চা নিয়ে আসে। অফিসে আজ আর বিশেষ কোন কাজ নেই। জমে থাকা কাজগুলো গতকালই মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। রক্তিম ল্যাপটপ খুলে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলো। ওয়েবসাইটের প্রথম পাতায় চোখ বুলাতেই ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অধিকাংশ শেয়ারের সূচক আজ উঠতির দিকে। তার কেনা বেশ কিছু শেয়ারের দাম অনেকদিন থেকেই পড়তির দিকে ছিলো। আজ সে শেয়ারগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। দুপুরের মধ্যেই শেয়ারগুলোর দাম একটা ভালো পর্যায়ে পৌছবে আশা করা যায়।

সে খুশী মনে আরেকটা ট্যাবে ফেসবুক ওপেন করে। পেজ ওপেন হতেই দেখলো সাতটা নোটিফিকেশন। এর মধ্যে একটা নোটিফিকেশন, যুথি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এঙ্প্টে করেছে। পেজের বামদিকে নিচে তাকাতেই দেখলো তের জন বন্ধু এখন অনলাইনে রয়েছে। সে মনে মনে ভাবে, এইগুলার কি কোন কাজ নেই! সারাদিন ফেসবুকে বসে থাকে!

বামদিকের চ্যাট অপশনে ভালো করে খেয়াল করতেই যুথির প্রোফাইলের প্রজাপতির ছবি তার চোখে পড়লো, তার মানে যুথিও অনলাইনে। সে যুথির নামের উপর ক্লিক করতেই চ্যাটের ছোট পেজটা খু্েলল গেল।

সে লিখলো, হাই যুথি!!!

অনেকক্ষণ চলে যাওয়ার পরেও যুথি কোন রিপ্লাই দিলোনা। রক্তিম আবার লিখলো, কি অবস্থা, বেশী বিজি নাকি?

এবার প্রায় সাথে সাথেই রিপ্লে আসলো, না ভাইয়া, আসলে আমি গুগলে ইলেক্ট্রো ডায়নামিকসের একটা থিওরি সার্চ করছিলাম, তাই এদিকে খেয়াল করিনি।
রক্তিম রিপ্লাই দেয়,

– হুম তাই বলো, তারপর কেমন আছো তুমি?

– আমি ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?

-হ্যাঁ আমিও ভালো আছি। আচ্ছা আমি তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করায় রাগ করোনি তো?

-না ভাইয়া রাগ করার কি আছে 

-যাক নিশ্চিন্ত হলাম। তারপর তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?

-আপনাদের দোয়ায় ভালোই চলছে।

-ভালো হলেই ভালো  তা তুমি কিসে পড়াশোনা করছো?

-আমি কম্পিউটার সায়েন্সে ২য় বর্ষে পড়ছি।

-ওয়াও গ্রেট! আমিও সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিলাম। গণিতে অনার্স কমপ্লিট করার পর এমবিএ করে এখন কর্পোরেট চাকরে পরিণত হয়েছি।

-ভাইয়া আপনার এডুকেশনাল এন্ড জব ব্যাকগ্রাঊন্ড দারুন!

-থ্যাংকস , তারপর তুমি কোন ভার্সিটিতে পড়ছো?

-আমি SUST এ পড়ছি।

– গ্রেট! একে তো SUST, তার ওপর জাফর ইকবাল স্যারের ডিপার্টমেন্টে পড়ছো! দারুন!

-ঠিক বলেছেন জাফর স্যারের ডিপার্টমেন্টে পড়ে আমি নিজেও গর্বিত।

-এই একজন মানুষ যার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলেই নিজের আত্নবিশ্বাস অনেকখানি বেড়ে যায়। তিনি নিশ্চয় কোন যাদু জানেন নাহলে কেন উনার ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠলে সব ভয়-ডর দূরে চলে যাবে! একবার স্যারের দেখা পেলেই ধন্য হয়ে যাই, আর তুমি সরাসরি উনার ছাত্রী! স্যার কি নিয়মিত ক্লাস নেন?

-হ্যাঁ, উনি উনার প্রায় প্রতিটা ক্লাসেই আসেন। ঝড়-বাদলার দিনে কারেন্ট চলে গেলেও স্যার মোমবাতি দিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা নেন।

-হুম জাফর ইকবাল স্যার সত্যিই এক অন্যরকম ব্যক্তিত্ত্ব। উনাকে দেখলেই অনুপ্রাণিত বোধ করি।
-হুম, ভাইয়া আপনি কি স্যারকে কখনো সরাসরি দেখেছেন?

-কত্তোবার দেখেছি। প্রথমবার দেখেছিলাম একুশে বইমেলায়। সাদা-কালো ধুসর চুলের এই মানুষটাকে দেখলেই আমার মাথা শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যায়।

তারপর অনেকক্ষণ ধরে চললো তাদের চ্যাট। হঠাৎ করেই যুথি ডিসকানেক্ট হয়ে গেলো। রক্তিমও ফেসবুক থেকে লগআউট করলো

দুপুর ২টার দিকে ডিএসই’র ওয়েবসাইটে ঢুকেই রক্তিমের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। তার কেনা শেয়ারগুলোর দর স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চসীমায় উঠেছে। এখনি বিক্রি করে দিতে পারলে পুরো পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা প্রফিট। সে ব্রোকার হাউজ এ ফোন লাগালো, কিন্তু ফোন এনগেজ মারছে। রক্তিম বেশ বিরক্ত হলো। কয়েকবার চেষ্টার পর লাইন পেতে বলে দিলো তার লটগুলো যেন চলতি দরে বিক্রি করে দেয়া হয়।

রক্তিমের বুক থেকে যেন একটা বড় পাথর নেমে গেছে। এ শেয়ারগুলো নিয়ে অনেকদিন থেকেই সে চিন্তিত ছিলো। অনেকদিন থেকে লসে ছিলো, কিছুতেই দাম বাড়ছিলোনা। আজ যখন বাড়লো, এক লাফে এতো লাভ! সে তার ভাগ্যকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলোনা।

বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে সোফাতে গা এলিয়ে দিতেই নীলা চা আর চিকেন স্যান্ডউইচ নিয়ে পাশে এসে বসলো। রক্তিম দুপুরে অফিসের কেন্টিনে খেয়ে নেয় তাই বাসায় ফিরে ভাত খায়না। স্যান্ডউইচ খেতে খেতে রক্তিম আড়চোখে নীলাকে দেখে। সাধারণ সাজে নীলাকে অসাধারণ দেখাচ্ছে। সে নীলার একটা হাত ধরে বলে, আজ তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। নীলা লাজুক হাসি দিয়ে হাত সরিয়ে নিতে চায়। রক্তিম নীলাকে আরো ঘনিষ্ট করে কাছে টেনে আনে। নীলা মৃদু প্রতিবাদ জানিয়ে রক্তিমের বাহুর বাঁধন আলগা করতে চায় কিন্তু পারেনা।

রক্তিম নীলাকে বলে, আজ আমার অনেক খুশির দিন। অনেকদিনের চাপানো পাথর আজ বুক থেকে নেমে গেছে।

নীলা আদুরে সুরে বলে, কেন, এতো খুশি কেনো?

রক্তিম নীলাকে বাঁধন থেকে কিছুটা আলগা করে দিয়ে বলে, আমার আটকে থাকা শেয়ারগুলো আজ ভালো দামে বিক্রি করে দিয়েছি। মোটা অংকের প্রফিট এসেছে। আগামীকালকেই ব্যাংকে টাকা জমা পড়বে।

নীলা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, যাক তাহলে একটা সুরাহা হলো শেয়ারগুলোর। আমিও ভীষন চিন্তিত ছিলাম ওগুলো নিয়ে।

রক্তিম চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলে, এই আনন্দে আমি তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। কি চাও বলো?

নীলা বলে, টাকা নষ্ট করার কোন দরকার নেই। আমার শ্রেষ্ট উপহার তুমি। তুমি সবসময় পাশে থাকলে আমার আর কিছু চাইনা। বলেই নীলার দুচোখ জলে ভিজে ওঠে।

নীলার ভালোবাসার এমন বহিঃপ্রকাশে রক্তিম আশ্চর্য্য হয়। এমন লক্ষী স্ত্রী কয়জনের ভাগ্যে জুটে! রক্তিম নীলাকে আরো কাছে টেনে নেয়। ভালোবাসার আবেশে এ সন্ধ্যারাতে উভয়ে একে-অপরের সাথে মিশে যায় মধুর আলিঙ্গনে। আর মেঘমুক্ত আকাশে বৈশাখী পূর্ণিমার বাঁধভাঙ্গা আলো জানালার ফাঁক গলে আচড়ে পড়ে অন্ধকার ড্রয়িংরুমে।


৩ মাস পর…
রক্তিম ও নীলার দাম্পত্য জীবন পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও, ওদের কোল জুড়ে এখনও কোন সন্তান আসেনি। আসলে রক্তিম সবসময় চেয়েছে নীলা উচ্চশিক্ষাটা কমপ্লিট করুক। পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে সন্তান নিলে নীলার পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে রক্তিম সন্তান নিতে চায়নি। নীলার এম.এস.সি সম্পন্ন হওয়ার পরও রক্তিম সন্তান নিতে আগ্রহী নয়। সন্তানের কথা তুললেই কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নীলার মাতৃহৃদয় একটি সন্তানের জন্য আকুল হয়ে আছে।

নীলা ইদানীং লক্ষ্য করেছে রক্তিমের আচরণ আগের তুলনায় অনেক পরিবর্তিত। আগে কখনোই রক্তিম নীলার সাথে কড়া ভাষায় কথা বলেনি, অথচ ইদানীং সুযোগ পেলেই নীলাকে অপমান করতে ছাড়েনা। তাদের পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে এমন রক্তিমকে সে কখনোই দেখেনি। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একজন মানুষ কতোটা পরিবর্তিত হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ রক্তিম। গত কিছুদিন যাবত সে রাতে ঘুমায়ও বেশ দেরীতে। সে জন্য প্রায়দিনই অফিস যেতে দেরী হয়। রাত জেগে নেটে কি করে জানতে চাইলে বলে, অফিসের কাজ করছে। নীলা ঠিক বুঝতে পারেনা রাত জেগে কি এতো কাজ!

রক্তিম আর যুথির ভার্চুয়াল সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্টতা লাভ করেছে। তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর হয়ে প্রেম-ভালোবাসার পর্যায়ে চলে গেছে বলা যায়। রক্তিম যুথির কাছে নীলার কথা গোপন রেখেছে। যুথি জানে রক্তিম অবিবাহিত। রক্তিম বেশ কয়েকবার সিলেট গিয়ে যুথির সাথে দেখাও করেছে। যুথি দেখতে বেশ সুন্দর ও স্মার্ট, নীলার চেয়ে সামান্য একটু ফর্সা। কিন্তু তারপরও নীলার ব্যক্তিত্ত্ব আর সৌন্দর্য্যের কাছে যুথির সৌন্দর্য্য যেন ম্লান হয়ে যায়।

ঘরে সুন্দরী, শিক্ষিত স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও রক্তিম যুথির চটপটে কথাবার্তার মধুময়তা ও চঞ্চলতায় নিজেকে সঁপে দেয়। প্রিয়তমা স্ত্রীর ভালোবাসাও তুচ্ছ মনে হয় যুথির প্রাণচাঞ্চল্যে। দিনে অন্তত একটিবার যুথির সাথে কথা না বললে মনে হয় যেন যুগ-যুগান্তর পেরিয়ে যাচ্ছে জাগ্রত চৌরঙ্গীর নির্বাক ভাস্কর্য্যের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে। সময় পেলেই ফেসবুক আর সেলফোনের বিচ্ছুরিত তরঙ্গকণায় হারিয়ে যায় কথার ভুবনে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে কি দুজনকেই ঠকাচ্ছেনা! কিন্তু তা নিমিষেই মিলিয়ে যায় হৃদয়ের কোলাহলে। এ সবকিছুই চলে নীলার দৃষ্টির অগোচরে।

অফিসের গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। ড্রাইভার হর্ণ দিচ্ছে একটু পরপর। রক্তিম তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে গিয়ে উঠে। আগে অফিসে যাওয়ার আগে রক্তিম নীলার কোমল অধরে আলতো করে চুমুর পরশ বুলিয়ে দিতো। অথচ এ ক’দিনে সবকিছু বদলে গেছে। নীলার ভীষণ কান্না আসে। রক্তিম দৃষ্টি সীমা ছাড়িয়ে পর্যন্ত নীলা সজল চোখে দরজা আকড়ে থাকে।

ড্রয়িংরুম দিয়ে যাওয়ার সময় নীলার চোখে পড়ে টি-টেবিলের মধ্যে ল্যাপটপ পড়ে রয়েছে। রক্তিম তাড়াহুড়োয় নিতে ভুলে গেছে। নীলা অনেক খুশী হলো ল্যাপটপ দেখে। আজ তাহলে প্রাণখুলে কানাডায় বড় আপুর সাথে কথা বলা যাবে। নীলা ডান হাতে চোখ মুছতে মুছতে ল্যাপটপের পাওয়ার বাটনে অন করে। কিন্তু চারপাশ কোথাও মডেমের অস্তিত্ত্ব খুঁজে পেলনা। তো কি আর করা, বিফল মনোরথ হয়ে হার্ডডিস্কের এক ড্রাইভ থেকে আরেক ড্রাইভে ঘুরতে লাগলো। ডি ড্রাইভে বেশ কিছু ছবি রয়েছে। সে মাউসে ক্লিক করে ডি ড্রাইভ ওপেন করতেই সাতটি ফোল্ডার দেখা গেলো। সব ফোল্ডারেই রাখা বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবি। প্রথম ফোল্ডারে রাখা থাইল্যান্ড ট্যুরের বেশ কিছু ছবি। সে ছবিগুলো দেখতে দেখতে জঔ১৪৩ নামে একটি ফোল্ডার দেখতে পেলো।

সে ফোল্ডারে থাম্বনেইলস দিতেই নীলার শিরদাড়া বেয়েএকটি শীতল তরঙ্গ বিদ্যুৎবেগে নেমে গেলো। প্রায় প্রত্যেকটি ছবিতেই রক্তিম আরেকটি মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। উভয়েই একে অপরের সাথে বেশ ঘনিষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে। নীলা তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে কান্না বেরিয়ে আসতে গিয়েও পারছেনা, গলা পর্যন্ত এসে আটকে যাচ্ছে।

হঠাৎ সে ভীষন একাকীত্ব অনুভব করছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব অন্ধকার একত্রে জমা হয়েছে ওর হৃদয়ের অন্দরমহলে। সে যতোটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে ছবিগুলো দেখলো। অল্পবয়েসী একটি মেয়ে যার দুচোখ কাজলে আঁকা, মাঝারী গড়ন, ফর্সা বর্ণ, কালো চুলের মধ্যে হালকা লালচে শেড, ভরাট যৌবন। প্রত্যেকটি ছবিই সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো।

গলায় আটকে থাকা কান্না হঠাৎ করে বমির আদলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নীলা দ্রুত বেসিনের কছে যায়। গড়গড় কওে অনেকখানি তরল পদার্থ উদগীরণ করে। একটু ধাতস্থ হয়ে দুহাত ভরে চোখ মুখে পানি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই নীলার বুকের আঁচল খসে পড়ে পায়ের পাতা অবধি। বেসিনের আয়নায় নিজের উদ্ধত যৌবনের দৃশ্যমান চোখ রাঙ্গানিতে নীলা ভীষণ লজ্জ্বিতবোধ করে। দুহাতে উর্ধ্বভাগ ঢাকতে গিয়েও ঢাকেনা। তার অবয়ব গঠনে স্রষ্টা কোন কৃপণতা করেননি। নারী সৌন্দর্য্যের ষোলকলায় সে পরিপূর্ণ। তারপরও তার স্বামী কেন অন্য নারীতে আকৃষ্ট! কি আছে সেই মেয়েটির মধ্যে! নীলা রাগ মাখা ঈর্ষায় আবিষ্ট হয়।

সন্ধ্যায় বেশ দেরীতে বাসায় ফিরলো রক্তিম। নীলার মধ্যে কোন ভাবাবেগ নেই। এক্ষুনি রক্তিমকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবেনা। রক্তিম ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকতে, নীলা চুপিচুপি রক্তিমের মোবাইল ফোনের লাস্ট ডায়াল কল থেকে আন্দাজে যুথির নাম্বার নিয়ে নিজের মোবাইলে সেভ করলো।

সন্ধ্যার নাস্তা সেরে রক্তিম বাইরে বেরুলো। রক্তিম বেরুতেই নীলা দরজা বন্ধ করে দিলো। ওর বুক টিপটিপ করছে। নিজেকে অস্তিত্ত্বহীন জড় পদার্থের মত মনে হচ্ছে। যেন কোন অনুভুতি নেই ওর দেহপিন্ডে। ওপাশে কে ফোন ধরবে? তার সাথে রক্তিমের কি সম্পর্ক ভাবতেই নীলার পুরো শরীর ভুমিকম্পের মত প্রবল বেগে কাঁপতে শুরু করে। সে কাঁপা হাতে যুথির নাম্বারে ডায়াল করলো।

অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পরও অপরপ্রান্তে কেউ কল রিসিভ করলোনা। দ্বিতীয়বার বেশ কিছুটা সময় রিং হওয়ার পর অপরপ্রান্ত হতে ভেসে এলো, হ্যালো, স্লামালিকুম।

নীলা কাঁপা গলায় বললো, হ্যালো।

যুথি বলে, জ্বী, কে বলছেন?

নীলা তার কন্ঠে যতোটাসম্ভব দৃঢ়তা এনে বলে, আমি নীলা। ঢাকা থেকে বলছি। আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।

আমার সাথে কথা! আপনি কে? যুথি জিজ্ঞেস করে।

আমি কে আগেই বলেছি। এখন আমি আপনাকে যা যা জিজ্ঞেস করবো তার সঠিক জবাব দিয়ে আমাকে সাহায্য করবেন প্লীজ। কথাগুলো বলে নীলা থামে।

-আমার সাথে আপনার এমন কি কথা আমি বুঝতে পারছিনা! তারপরও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কি বলবেন বলুন।

-আপনি নিশ্চয় রক্তিমকে চিনেন?

-চিনব না কেন! অবশ্যই চিনি। কি হয়েছে রক্তিমের! ওর কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

-না ওর কিছু হয়নি। আচ্ছা আপনি কতোদিন থেকে ওকে চিনেন?

-অনেকদিন থেকেই চিনি তবে ঠিক কতোদিন বলতে পারবোনা।

-হুম, তা আপনি ওর সম্পর্কে কতোটুকু জানেন?

-একজন মানুষকে যতোটা জানা গেলে ভালোবাসা যায় তার চেয়ে অনেক বেশী জানি।

-আপনি জানেন কি আপনি একটা বড় ভুল করতে চলেছেন?

-ভুল! ভুল কোথায় করছি! আমি তো ভুলের কিছু দেখছিনা। আমি ওকে ভালোবাসি, সেও আমাকে ভালোবাসে।

একটা ছোট দম নিয়ে আসল বোমা ফাটালো নীলা। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, রক্তিম যে বিবাহিত সে কথা কি জানেন?

অপরপ্রান্ত থেকে সাথে সাথে হুংকার দিয়ে যুথি বললো, অসম্ভব! এটা কখনোই হতে পারেনা। আপনি বানিয়ে বলছেন। আপনি নিশ্চয় আমাদের সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য এসব বলছেন।

নীলা বলে, আমি এক বিন্দুও বানিয়ে বলছিনা। রক্তিম বিবাহিত এবং আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী। আমরা আজ থেকে পাঁচ বছর আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি।

যুথির গলা মিইয়ে আসে। সে ভাঙ্গাগলায় বলে, আপনি সত্য বলছেন তার প্রমাণ কি?

নীলা দৃঢ়কন্ঠে বলে, আমিই সবচেয়ে বড় প্রমাণ, সবচেয়ে বড় সত্য। পৃথিবীতে এর চেয়ে ধ্রুব সত্য আর কিছু হতে পারেনা।

যুথি বলে, আপনার মুখের কথাতেই প্রমাণ হয়না আপনি রক্তিমের বিবাহিতা স্ত্রী। আপনি কি প্রমাণ দিতে পারবেন? আপনি যতোক্ষণ না উপযুক্ত কোন প্রমাণ দিতে পারছেন ততোক্ষণ আমিও বিশ্বাস করতে পারছিনা।

নীলা শান্তস্বরে উত্তর দেয়, আমার কাছে যথেষ্ট পরিমাণ প্রমাণ আছে। আমি উপযুক্ত প্রমাণ নিয়েই আপনার সাথে কথা বলছি। আপনি চাইলে আমাদের কাবিননামার কপি আপনাকে পাঠাতে পারি।

এবার যুথির খানিক বিশ্বাস হয়। একজন মেয়ে আরেকজন মেয়ের সাথে এতোটা মিথ্যে কখনো বলবেনা। যুথির ভীষণ কান্না পায়। প্রেম-ভালোবাসা নামক জিনিসটার ওপর ভীষন রাগ হয়। নীলা রিসিভারে কান রেখেই বুঝতে পারছিলো, ওপাশে যুথি কাঁদছে। যুথি কান্নাতাড়িত কন্ঠে বলে, আপনার কথাগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু ভাবতে কষ্ট হচ্ছে রক্তিম কীভাবে আমার সাথে এ ছলনা করলো! জীবনে এই প্রথম আমি কাউকে ভালোবেসেছিলাম আর সে ভালোবাসাতেই এমন প্রতারিত হলাম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, আপনি কোন চিন্তা করবেন না আমি চাইনা আমার কারনে কারও জীবন তছনছ হয়ে যাক। সে আমার কাছে আর কোন প্রশ্রয় পাবেনা। সে এটাও জানবেনা আপনি আমায় ফোন করেছেন।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে যুথি মোবাইল রাখতে গিয়েও রাখেনা। নীলা বুঝতে পারে অপরপ্রান্তে যুথি অঝোরে কেঁদে চলেছে। ঢুকরে ঢুকরে কান্নার শব্দে তারহীন ফোনের সমস্ত তরঙ্গ বিষাদময় হয়ে উঠে। অনেকক্ষণ পর নীলা ফোন কেটে দেয়। মেয়েটা প্রাণভরে কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে হালকা করুক নিজের মনটাকে। নীলা নিজেও মেয়ে তাই সে বুঝতে পারে, একটা মেয়ে কতোটা আবেগ, কতোটা মন দিয়ে একজন মানুষকে ভালোবাসে। তার চোখের কোনও অশ্রুজলে ভিজে ওঠে।

সকালের তেজোদীপ্ত সূর্য্যকীরণ উজ্জ্বল জ্যেতি ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো শোবার ঘরে। আড়মোড়া ভেঙ্গে পাশ ফিরতেই রক্তিমের চোখে পড়ে, সদ্য গোসল সেরে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় নীলা হালকা প্রসাধনী করছে। সাদা তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল বেঁধে রাখা। কানের লতি বেয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জলকণা। তারুন্যের উজ্জ্বল আভায় রাঙ্গানো মুখমন্ডল যেন নন্দনকাননে প্রস্ফুটিত পুষ্পের একটি কোমল পাঁপড়ি। এমন সুন্দরী স্ত্রী ঘরে থাকা সত্ত্বেও সে কেন অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে ভাবতেই নিজে লজ্জ্বিতবোধ করছে, অপরাধবোধে আচ্ছ্বন্ন হচ্ছে। সে মনে মনে যুথিকে ধন্যবাদ জানায়। যুথি যদি গতরাতের অপ্রিয় সত্য বজ্রকঠিন কথাগুলো না বলতো তবে হয়তো তার জীবনে একটা ঝড় বয়ে যেত। সে মনে মনে যুথির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ছাদের কার্নিশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বিড়বিড় করে বলে, যুথি তুমি অনেক ভালো থেকো আর এই পিশাচকে ক্ষমা করে দিও নিজগুণে। যদিও জানি এই অপরাধের কোন ক্ষমা হয়না তবুও তোমার কাছে এতোটুকু করুণা ভিক্ষা করছি।

রক্তিমের বিড়বিড় শব্দে নীলা পেছন ফিরে চাইলো। চোখের ঈশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার? রক্তিম কোন কথা না বলে নীলার ডানহাতে আচমকা টান দিয়ে বিছানায় নিজের বুকে নিয়ে এলো। নীলা মৃদু রাগ দেখিয়ে উঠে যেতে চাইলো। ঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে নীলা বললো, এই সাত-সকালে এসব কি হচ্ছে! শেষ পর্যন্ত রক্তিমের দৃঢ় বাঁধুনীতে পিষ্ট হয়ে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হলো। নীলার কোমল ওষ্ঠে রক্তিম নিজের ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিলো বেশ জোর করে। ভালোবাসার মধুর অবগাহনে দুটি ভিন্ন সত্ত্বা অভিন্ন সত্ত্বায় পরিণত হয়ে সাঁতরে বেড়াতে লাগলো ভালোবাসার গহীন সমুদ্রে। যে ভালোবাসা কখনোই হারিয়ে যাবার নয়।

ইতি প্রেমাংশু

প্রিয়তমেষু, আজ সকাল থেকেই ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষার এই সময়টাতে অবিরাম বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও কোন এক অদৃশ্য কারনে গত সপ্তাহখানেক একফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি। এটা কি শুধুই প্রকৃতির বে-খেয়াল নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বুঝা মুশকিল! সে যে কারনই হোক আজ কিন্তু মনের মতো করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরঝির বৃষ্টির তালে তালে প্রায়ই নেচে উঠছে মানকচুগুলো। হলুদ কৃষ্ণচূড়ার গাছটিও অদ্ভুত ছন্দে দুলছে।

আজ বৃষ্টি সকালে বৃষ্টি দেখে ভেবেছিলাম ক্যাম্পাসে যাবো কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ইচ্ছে করলোনা। মনে আছে ক্যাম্পাসের বৃষ্টিভেজা দূর্বাঘাস তুমি কত্তো পছন্দ করতে? জুতোজোড়া দূরে ফেলে আলতা রঙে রাঙ্গানো পা মেলে ছুটে চলতে দূর্বা মাড়িয়ে। তোমার নিশ্চয় মনে আছে ক্যম্পাসের সেই কদম গাছটির কথা। সৌন্দর্য্যহানির দোহাই দিয়ে কর্তৃপক্ষ সেই গাছটি কেটে ফেললো এই ক’দিন আগে। সত্যি বলতে কি গাছটা এমন এক অবস্থানে ছিলো যে আমারও দেখতে ভালো লাগতোনা। কিন্তু এই কদম গাছটিকে তুমি এতোটাই ভালোবাসতে যে আমি সাহস করে এই অপছন্দের কথা কখনো বলতে পারিনি। ছোট্ট হলুদ বলের মতো দেখতে ওই ফুলে তুমি কি যে খুঁজে পেতে তা আমার কাছে আজও রহস্য! আমার প্রায়ই মনে হতো তুমি আমার চেয়ে ওই কদম গাছকেই বেশী ভালোবাসতে। ঝুম বৃষ্টিতে তুমি যখন ওই গাছ পানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে তখন আমার দারুন হিংসে হতো। মনে হতো একটা সাধারণ উদ্ভিদ আমার ভালোবাসায় ভাগ বসাচ্ছে! তখন ইচ্ছে হতো গাছটি কেটে ফেলি। তোমাকে এ ভাবনাগুলো ঘুণাক্ষরেও জানতে দেইনি। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, সেই প্রতিদ্বন্ধী কদম গাছটি যেদিন সত্যি সত্যি আমার চোখের সামনে কেটে ফেলা হলো সেদিন আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। গণিত বিভাগের সামনে জন্মানো তোমার প্রিয় দূর্বাঘাসগুলোও আজ আর নেই। আসলে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে তোমার প্রিয় দুটো জিনিসও আমাকে ত্যাগ করে চলে গেলো।

তুমি যেদিন আমার কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে গেলে সেদিনটিও ছিলো এমন বৃষ্টিস্নাত। তুমি বলেছিলে, তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। শুধু এতোটুকুই, আর কিছু নয়। সেশনজটের করালগ্রাসে আবদ্ধ আমার পক্ষে তোমাকে জীবনসাথীরূপে গ্রহণ করার সাহস ছিলোনা। আমি শুধু তোমার অশ্রুসিক্ত নয়নপানে চেয়ে ছিলাম। তুমিও শুধু অবাক বিষ্ময়ে নিষ্পলক চেয়ে ছিলে। আজ এতোবছর পর মনে হয় আমি সেদিন তোমার চোখের ভাষা সঠিকভাবে পড়তে পারিনি। তোমার সেই না বলা গভীর চাহনীর মধ্যে ছিলো একটি সুন্দর ও পবিত্র আকুতি। তোমাকে হারানোর আসন্ন যন্ত্রনায় আমি এতোটাই কাতর হয়ে গিয়েছিলাম যে তোমার সেই আকুতি আমি বুঝতে পারিনি। চিরকালের নির্বোধ আমি হয়তো তোমার চাহনীর মানে বুঝিনি কিন্তু তুমি তো পারতে মুখ ফুটে কথাটি বলতে। আমি জানি তুমি বড্ড অভিমানী। হয়তো সেই অভিমান থেকেই তুমি কিছু বলোনি।

আজ আমার বেকারত্ব ঘুচেছে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এসেছে। বউকে দামী কাপড়, দামী গহনা কিনে দিচ্ছি, ছেলে-মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াচ্ছি কিন্তু এতোসব পাওয়ার মধ্যেও তোমাকে না পাওয়ার বেদনা আমাকে সবসময় কুঁকড়ে খায়। একটা কথা জানো আমার মেয়েটা না ঠিক তোমার মুখের আদল পেয়েছে। হয়তো সঙ্গমের কোন এক চূড়ান্তলগ্নে অবচেতন মনে তোমাকেই স্ত্রীরূপে কল্পনা করেছিলাম। স্ত্রী আমার সুন্দরী, সুশিক্ষিত। তবে প্রায়ই মনে হয় ব্যক্তিত্ত্বের দিক দিয়ে ও কোনভাবেই তোমার ধারেকাছেও যাবেনা। তোমার সেই অবাক অভিব্যক্তিমাখা সুন্দর চাহনী আমি ওর মধ্যে প্রায়ই খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু না কোনভাবেই সেই তোমাকে ওর মধ্যে খুঁজে পাইনা।

ছোট ছেলেটা পাশের ঘরে ভীষণ কাঁদছে। ছেলেটা আবার বাপের ভীষন ন্যাওটা। এবার কলম ছেড়ে তাই আমাকে পিতৃদায়িত্ব পালন করতে যেতে হবে। কাজেই তোমাকে লেখা এ চিঠি এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। আগামী বর্ষার প্রথম বাদল দিনে ক্যাম্পাসে আসার নিমন্ত্রণ দিয়ে আজকের মতো কলম রাখছি।

ইতি

তোমারই প্রেমাংশু

বেনাট


এ মাসের মধ্যেই অফিসের চূড়ান্ত বাজেট পেশ করতে হবেতাই ছুটির দিনেও একগাদা ফাইলপত্র বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে উপুড় হয়ে হিসাব কষছিলামপাশের ঘরে একমাত্র মেয়ে ঝিনি হাই ভলিঊমে টম এন্ড জেরী দেখছেউচ্চ শব্দের জন্য প্রায়ই মনোযোগ বিঘ্নিত হচ্ছিলো। হিসেবে তালগোল পাকিয়ে ফেলছিলাম
এ ঘর থেকে হাঁক দিলাম, এই ঝিনি টিভি বন্ধ করবি নাকি ও ঘরে এসে তোর ঘাড় মটকাবোকথাটা শুনেই পাশের ঘরে কচি কন্ঠের হাসির গাড়ি ছুটলোদরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ঝিনি বললো, বাবা তুমি ভুত নাকি! বলেই হাসতে হাসতে পালালোসেইসাথে টিভির শব্দও বন্ধ হয়ে গেলো

একটা করে হিসাব কষছি আর এক্সেলের ওয়ার্কশীটে এন্ট্রি করছিযেই না ওয়ার্কশীটে গুটিকয়েক ডাটা এন্ট্রি করেছি ওমনি বেলকনিতে কিছু একটার শব্দ হতেই বাইরে চোখ দিলামবিরক্তিভরে বেলকনিতে চোখ রাখতেই অবাক হলামখোলা বেলকনির দেয়ালে একটা বানর বসে আছেইট-পাথর-কংক্রিট এর যাঁতাকলে পিষ্ট এ শহরে এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলাম।

বানরটির গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল বিভিন্ন রঙ্গের লোমে সমস্ত দেহ আবৃতমুখের দিকে তাঁকালে মনে হয় কে যেন সমস্ত মুখমন্ডল আগুনে জ্বলসে দিয়েছেপোড়া মুখের আড়ালে উজ্জ্বল মারবেল পাথরের মতো চকচক করছে দুটি মায়াবী নিষ্পাপ চোখএতোক্ষণে ঠাওর করতে পারলাম এটা ঠিক বানর নয়, কালোমুখী হনুমানস্থানীয়ভাবে মুখপোড়া হনুমান নামেই বেশী পরিচিতছেলেবেলায় কোন দুষ্টুমি করলে মা মুখপোড়া হনুমান বলে বকা দিতেনআজ সেই মুখপোড়া হনুমান আমার সামনে বসে আছে!

ঝিনি কখন যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমি বুঝতেই পারিনি। ঝিনি অবাক বিস্ময়ে হনুমানের দিকে তাঁকিয়ে আছে। সদ্য আটে পা দেয়া ঝিনি তার ফোকলা দাঁত বের করে যেভাবে তাঁকিয়ে আছে বোঝাই যাচ্ছে এই প্রথম ও এতো কাছ থেকে বানর জাতীয় কোন প্রাণি দেখতে পেয়েছে। শুধু ঝিনির কথাই বা বলি কেন! আমি নিজেও তো এই প্রথম এতো কাছ থেকে হনুমান দেখছি!
ঝিনি সামনে এগুতে চাইছিল। আমি এগুতে দিলাম না। আমার ভয় হচ্ছিলো হনুমানটি যদি ঝিনিকে খামচে দেয়। হনুমানটি হাত নেড়ে কিছু ঈশারা করছেআমরা বাপ-মেয়ে একে-অপরের দিকে তাঁকালামকিন্তু কেউই হনুমানটির ঈশারার পাঠোদ্ধার করতে পারলাম না। ঝিনি বললো, বাবা, বানরটি মনে হয় কিছু খেতে চায়

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ঝিনি দৌড়ে ঘরে চলে গেল। ফিরে এলো হাতে একটা কলা নিয়ে। ঝিনি কলাটি ছুড়ে দিতেই হনুমানটি মেঝে থেকে কলা কুঁড়িয়ে নিলো তারপর নিজে নিজেই খোসা ছাড়িয়ে খেতে লাগলো খোসা ছাড়ানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতে সে খুব অভ্যস্ত। ঝিনি আর আমি অবাক হয়ে ওর কলা খাওয়া দেখছি।

 ঝিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা বানরটার মুখ এত্তো কালো কেন? আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, এটা ঠিক বানর নয়বানর প্রজাতির একটি প্রাণী হনুমানএই জাতের হনুমানের মুখ এরকম কালো হয় তাই এদের কালোমুখী হনুমান নামে ডাকা হয়।

হনুমানের মুখের দিকে তাঁকিয়ে বুঝতে পারলাম খাবার পেয়ে সে ভীষণ খুশী হয়েছেশিশুরা যে প্রাণীদের কথা বুঝতে পারে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আজ পেলামকলার শেষ অংশ মুখে পুরে হনুমানটি আড়মোড়া ভাঙ্গার মতো রাজকীয় ভঙ্গিতে একটা মোচড় দিলোতারপর আমাদের দিকে বিদায় জানানোর মতো হাত নেড়ে পাশের বেল গাছে ঝাঁপ দিলোঝিনি তো বটেই আমিও ছোট বাচ্চাদের মতো অবাক ভঙ্গিতে হনুমানের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলামএক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফাতে লাফাতে হনুমানটি একসময় চোখের আড়ালে চলে গেলো

এরপর থেকে প্রায়ই হনুমানটিকে দেখা যেতে লাগলোবেলকনিতে এসে লক্ষীটির মতো চুপচাপ বসে থাকে কাউকে কোন উৎপাত করেনা। এরই মধ্যে ঝিনির সাথে হনুমানটির বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ঝিনি হনুমানটির একটা নামও দিয়েছেনামটা বেশ অদ্ভুত! বেনাট
আমি অবাক হয়ে ঝিনিকে জিজ্ঞেস করলাম, এমন অদ্ভুত নাম দিয়েছিস কেন মামনি? উত্তর যেন ওর ঠোটের মধ্যেই ঝুলানো ছিলোসাথে সাথে উত্তর দিলো, হনুমানটা কলা আর বাদাম ছাড়া কিছুই খেতে চায়না। তাই বেনানার বে আর নাটের নাট নিয়ে ওর নাম দিয়েছি বেনাটসুন্দর হয়েছে না বাবা?
ঝিনির সাংঘাতিক বুদ্ধির প্রমাণ পেয়ে আমি মনে মনে খুশী হলামতারপর মৃদু হেসে বললাম, বেশ সুন্দর হয়েছে মা

ঝিনি প্রতিদিনই বেনাটকে বিভিন্ন রকম খাবার দেয় বেনাটের জন্য বাজার থেকে বাদাম-কলা আনতে আমাকে বাধ্য করেমাত্র কয়েক সপ্তাহে হনুমানটি আমাদের অনেক আপন হয়ে গেছেআমার অসম্ভব বদমেজাজী স্ত্রীও হনুমান ওরফে বেনাটকে বেশ আপন করে নিয়েছেহনুমানটির পরিচ্ছন্নতা ও আচার ভঙ্গিতে মনে হয় এটা কারো গৃহপালিত ও প্রশিক্ষিতবন জঙ্গলের প্রাণী এতোটা ভদ্র হওয়ার কথা নয়ঝিনি আর বেনাট মিলে সারাদিন খেলা করেঝিনি বেনাটকে ওর ছোট্ট ছোট্ট টপস আর জিন্স পড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেমাঝে মাঝে বেনাটের মাথায় পড়িয়ে দেয় ছোট্ট ক্যাপক্যাপে বেনাটকে ভীষণ মানায়ওকে নিয়ে ঝিনির এতো আহ্লাদ দেখে বেনাট যেন খানিকটা লজ্জ্বা পায়। মুখ আড়াল করে পালানোর চেষ্টা করে

ঘরের ভেতর পর্যন্ত বেনাটের প্রবেশাধীকার বিস্তৃত হয়েছেড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে ঝিনি আর বেনাট আয়েশ করে পোগো আর কার্টুন নেটওয়ার্কে মজে থাকেকার্টুন আর এনিমেশন মুভি দেখে ওরা দুজনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়আমাদের তিনজনের এই ছোট্ট সংসারে বেনাট এক নতুন অতিথি হয়ে এসেছে। একদিন সাইকেল চালাতে গিয়ে ঝিনির পায়ের খানিকটা কেটে গিয়েছিলোবেশ রক্তও গড়িয়ে পড়ছিলো তা দেখে বেনাটের সে কী দৌড়ঝাঁপ! একটা বন্য প্রাণী কখন যে আমাদের এতোটা আপন হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি!

দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবারসকালবেলা ঝিনিকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলাম রিকশার খোঁজ করতে করতে গলির মোড়ে এসে দাঁড়ালামরাস্তার বাঁ-দিকে তাকাতে মানুষের জটলা চোখে পড়লোজটলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি? লোকটি কোন উত্তর না দিয়ে সামনে এগুনোর রাস্তা ছেড়ে দিলোলোকটির ছেড়ে দেয়া রাস্তা ধরে সামনে এগুতে দেখলাম মাটিতে বেনাট পড়ে আছে। বেনাটকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত কাছে এগিয়ে গেলামআমার পিছু পিছু ঝিনিও এগিয়ে এলোপাশ থেকে একজন বললো, রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা মাইক্রোবাস বানরটিকে ধাক্কা দিয়েছে

বেনাটের ঘাড় থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছেঅবিরাম রক্তক্ষরণে সে নিস্তেজ হয়ে গেছেবেনাটকে এ অবস্থায় দেখে ঝিনির দু-চোখ জলে ভরে উঠলোঝিনি বেনাটকে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেঝিনিকে দেখে বেনাট দু-বার ঠোট নাড়লোও যেন কিছু বলতে চাইছে। 

ঝিনি আমাকে বারবার তাগিদ দিলো, বাবা, বেনাটকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলোআমি বেনাটকে কাছের পশু হাসপাতালে নিয়ে গেলামডাক্তার বললেন বেশ সিরিয়াস ইনজুরি তবে চিন্তার কিছু নেইডাক্তারের কথায় আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ঝিনিকে বুঝানো যাচ্ছিলোনাওকে যতো বলি বেনাটের কিছু হবেনা সে ততো জোরে জোরে কান্না শুরু করেডাক্তার প্রথমে ইনজেকশন দিলেনতারপর ঘাড়ের ক্ষতস্থানটি পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন

বেশ কিছুটা সময় পর বেনাট চোখ খুললোতার চেহারার নিস্তেজ ভাব কাটতে শুরু করেছেবেনাটকে চাইতে দেখে ঝিনির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলোসে এক হাতে চোখের পানি মুচছে আরেক হাতে বেনাটের শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেঝিনির হাতের কোমল স্পর্শে বেনাট পাশ ফিরে ঝিনির দিকে তাঁকিয়ে যেন মৃদু হাসলোঝিনিও একটা মৃদু হাসি দিলোদুই বন্ধুর মধ্যে কি যেন গোপন কানাকানি হয়ে গেলো সবার অন্তরালে!

একটি ভ্রুণ ও একজন মায়ের যুদ্ধ

সারা রাত চোখ দুটির ওপর দিয়ে বেশ ধকল গেছে তা অরণ্যার দিকে তাকালে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে ধরা দেয়। এক রাতেই চোখের নীচে কালশীটে দাগ পড়ে গেছে। ফুলে ঢুল হয়ে গেছে চোখের পাতা দুটি। মুখের বিভিন্ন স্থানে কান্নার ছোপ ছোপ দাগ। মাথার চারপাশে অগুছালো চুল ছড়িয়ে আছে। কাল বিকেলেও এমনটি ছিলনা। অথচ আজ মনে হচ্ছে, দেবী প্রতিমার স্নিগ্ধ অবয়বে কে যেন বিষাদের কালো কালি মেখে দিয়েছে।

গতকাল বিকেল থেকেই বারবার অরণ্যার গা গুলাচ্ছিলো। মাথা ঝিম ঝিম করছিলো। তীক্ষ্ণ ধাতব আওয়াজ যেমন কানের ভিতর আঘাত হানে, মাথার মধ্যে ঠিক তেমনটি করছিলো। বিকেলে দু-বার প্রায় বমি হতে গিয়েও হয়নি। সন্ধ্যা নামতেই বার কয়েক বমি হলো। বমির তীব্র গতিবেগে মনে হচ্ছিলো পেটের সমস্ত নাড়িভূড়ি বুঝি ছিড়ে যাবে। তবে বমি হওয়াতে শরীর বেশ হালকা হয়েছিল। হঠাত করে শরীরের এমন আচরণে সে নিজেই বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলো। কোন পূর্বাভাস ছাড়াই যেন এক মহা প্রলয় বয়ে গেল।

মহা প্রলয় থামতেই সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। চোখ সামান্য বুজে আসতেই মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মেলে দেখল, জেসমিন বেশ কঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। রাগে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। মুখের নীলাভ শিরাগুলো যেন ফর্সা চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তিনি চেহারার ন্যায় বজ্র-কঠিন কন্ঠে বললেন, ‘অরণ্যা, তুমি উঠে বস। তোমার সাথে দুটো কথা আছে।’

অরণ্যা এর আগে মায়ের এমন কঠিন রূপ দেখেনি। চিরকালের স্নিগ্ধ, কোমল মায়ের এ রকম আচরণে সে আশ্চর্য্য হল, সেই সাথে ভয় ভয় লাগল। সে কী নিজের অজান্তে কোন অন্যায় করে ফেলেছে? না, শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না কোন অন্যায় করেছে কিনা! সে ভয়ে ভয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসতে চাইল কিন্ত ঠিকমতো বসতে পারলনা। একটু আগে বয়ে যাওয়া ঝড়ে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গেছে। শরীরের শেষ শক্তিকণাগুলো যেন উদ্বায়ী পদার্থের ন্যায় সরাসরি বাতাসের সাথে মিশে গেছে। কোন রকমে হেলান দিয়ে বসতেই জেসমিন বললেন, ‘তোমাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করবো, তুমি সাফ সাফ জবাব দিবে।’

অরণ্যা এখনও কিছু বুঝতে পারছেনা। সে ভয়ে ভয়ে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

মা মুখটা সামান্য গম্ভীর করে বললেন, ‘তোমার কী হয়েছে? আমাকে খুলে বলো।’

অরণ্যার বুক থেকে একটা চাপা আতংক দীর্ঘশ্বাসের সাথে স্বস্তি হয়ে বেরিয়ে এলো। এই কথা জিজ্ঞেস করার জন্য এতো কঠিন হওয়ার কি কোন কারণ হয়! সে মুখে সামান্য হাসি এনে বললো, ‘এই কথা! বাইরে চটপটি আর ফুচকা খেয়েছিলাম হয়তো সে কারণেই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হচ্ছে। এ নিয়ে তুমি কোন চিন্তা করোনা মা। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।’

জেসমিন কন্ঠ আরেকটু উচু করে বললেন, ‘হেয়ালী ছাড়ো। সত্যি করে বলো তোমার সমস্যা কি? আমি অন্য কিছুর আভাস পাচ্ছি।’

এবার অরণ্যার মেজাজ সত্যি বিগড়ে গেলো, সেও খানিকটা উচু স্বরে বলল, ‘কি হয়েছে তোমার! বলছি সামান্য গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, তা নিয়ে এতো মাথা ঘামানোর কোন কারণ আমি দেখছিনা।’

জেসমিনের গলাটা যেন একটু ধরে এলো। তবুও আগের সেই তীব্রতা বজায় রেখে ধরা গলাতেই বললেন, ‘তুমি কিছু লুকোনোর চেষ্টা করোনা। আমি যা ধারণা করছি তা সত্যি হলে সমাজে আর মুখ দেখানো যাবেনা।’

অরণ্যা যেন আকাশ থেকে পড়ল। এসব কথার মানে কি! সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সরাসরি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আশ্চর্য্য! তুমি কি বলতে চাইছো একটু পরিষ্কার করে বল তো।’

জেসমিন ইতস্তত করে সরাসরি বললেন, ‘আমার ধারণা তুমি প্রেগনেন্ট।’

যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটল। এক ধারালো কুঠার দিয়ে কেউ যেন অরণ্যার মাথা দ্বিখন্ডিত করে ফেলেছে। সে রাগে ফুসতে ফুসতে বলল, ‘ছি মা! ছি! তোমার চিন্তা-ভাবনা এতো নীচ! নিজের মেয়েকে তুমি এমন কথা বলতে পারলে! আমার ঘেন্না হচ্ছে।’

জেসমিন বললেন, ‘ঘেন্না তো হওয়ার কথা আমার। তোমার মতো মেয়ে পেটে ধরেছি বলে লাজে আমার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে।’

অরণ্যা অশ্রু সজল চোখে বলল, ‘মা! প্লীজ তুমি থাম। এভাবে অন্যায় অপবাদ তুমি আমাকে দিওনা। তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি প্রেগনেন্ট?’

জেসমিন কিছুক্ষণ মৌন হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার শারীরিক লক্ষণই বলে দিচ্ছে তুমি কনসিভ করেছো। কয়েকদিন আগেই তুমি আমাকে জানিয়েছো তোমার পিরিয়ডে সমস্যা হচ্ছে। আর এর মাঝে তোমার এমন গা গুলানো ভাব, বমি বমি ভাব, শারিরীক অবসাদ স্পষ্টত সেটাই প্রমাণ করে।’
অরণ্যা ততোক্ষণে পুরোপুরি অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘এসব তো খুব স্বাভাবিক মেয়েলী সমস্যা। তাই বলে এ নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবার মানেটা কি? তাছাড়া বিশ্বাস করো, আমি কোন পাপ কাজ করিনি।’

জেসমিন বললেন, ‘দেখ অরণ্যা, আমি নিজে একজন নারী। নারীত্বের এরকম কিছু মূহুর্ত্ব আমিও অতিক্রম করে এসেছি। একজন নারীর নিকট এ ব্যাপারগুলো লুকানোর কোন উপায় নেই।’
অরণ্যা বলে, ‘মা তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রাখ।’

‘আমি তোমার ওপর বিশ্বাস রাখতে চাই। আমার অনুমান মিথ্যে হলে আমার চেয়ে খুশী আর কেউ হবেনা।’ রুক্ষ্ণস্বরে জেসমিন কথাগুলো বলেন।

অরণ্যা কোন কথা খুঁজে পায়না। লজ্জ্বায় তার মাথা নিচু হয়ে আসে। মায়ের দিকে তাঁকাতে সাহস হয়না। অশ্রুসিক্ত চোখ বন্ধ করতেই অক্ষিপটে ভেসে ওঠে একটা ডিঙ্গি নৌকা। নতুন বাঁশ দিয়ে ডিঙ্গিটার ছই ছাওয়া। সেই নৌকার একপাশের গলুইয়ে বসে আছে এক জোড়া যুবক-যুবতী। ছোট্ট ডিঙ্গিটা শ্রাবণের প্রবল স্রোতে আপন গতিতে ঠিকানাবিহীন ছুটে চলেছে। যুবক-যুবতীর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যুবকের ভরাট কন্ঠ রবি ঠাকুরের কোন এক রোমান্টিক কবিতা আউরাচ্ছে। আর যুবতী মুগ্ধ হয়ে সেই ভরাট কন্ঠের মাধুর্য্য শ্রবণ করছে আর মাঝে মাঝে নদীর স্বচ্ছ নীলাভ জল যুবকের দিকে ছিটিয়ে দিচ্ছে। যুবক এ দুষ্টুমি বেশ উপভোগ করছে।

হঠাত করে আকাশ বেয়ে নেমে এলো বারিধারা। বৃষ্টির পরশ পেয়ে যুবতী যেন নতুন আনন্দে জেগে উঠল। সে চোখ বন্ধ করে, বিস্তৃত দিগন্তের দিকে দু-হাত প্রসারিত করে বৃষ্টির শীতল পরশ নিতে লাগল। যুবতীর বৃষ্টিবিলাস যুবক মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করছে। ক্রমে বৃষ্টির বেগ বাড়তেই যুবক-যুবতী ছইয়ের তলায় আশ্রয় নিলো। বৃষ্টিসিক্ত বসন যুবতীর দেহকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছে। যুবতীর মুখখানা লজ্জ্বায় কুঁকড়ে আসছিল। সে দু-হাত বুকের কাছে আড়াআড়ি করে নিজেকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করল। তারপর গুটিসুটি মেরে আড়ষ্টতার সাথে বসে রইল।

যুবতীর গোলাপী ওষ্ঠে বিন্দু বিন্দু জলকণা চিকচিক করছে। কম্পমান ওষ্ঠদ্বয় যেন একটুখানি উষ্ণতার অপেক্ষায় রত। যেন সামান্য উষ্ণতা পেলেই যুবতীর সকল আড়ষ্টতা কেটে যাবে। যুবক এতোক্ষণ চুপচাপ যুবতীকে দেখছিল। কিন্ত যুবতীর ঠোটের ওপর দীপ্যমান মুক্তোদানার ঔজ্জ্বল্যে সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাল। যুবতীকে কোন কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়েই যুবক নিজের খয়েরী অধরে জড়িয়ে নিলো যুবতীর সিক্ত অধর। ঘটনার আকষ্মিকতায় যুবতী বিষ্মিত হয়। কিন্ত সেই বিষ্ময় বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। যুবকের অবিরাম চুম্বনে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। যুবকের কঠিন অথচ ভালোবাসাময় বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে একে-অপরের সাথে লতায়পাতায় মিশে যায়। এ যেন শরীরের সাথে শরীরের; হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের; এক গভীর আত্মিক বন্ধন।

ঘোর যখন কাটলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় যুবতী স্তম্ভিত হয়ে গেল। লজ্জ্বা-ঘৃনা-ভয় ধারালো ছুরির ন্যায় যুবতীর অন্তরে আঁচড় কাটতে লাগল। নৌকার পাটাতনে মুখ লুকিয়ে যুবতী সব লজ্জ্বা ঢাকার চেষ্টা করল। আর পাটাতনের ফাঁক বেয়ে যুবতীর খানিকটা অশ্রু নদীর জলে গিয়ে মিশল। যুবক পাটাতন থেকে যুবতীর মুখ তুলে আনলো। যুবতীর চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘কাঁদছো কেন লক্ষীটি? আমরা কোন অন্যায় করিনি।’

যুবতী তখনও লজ্জ্বা কাটিয়ে উঠতে পারেনা। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, ‘এ কী অন্যায় নয়? একটু নিশ্বাস নিয়ে আবার বলে, আমার ভীষণ ভয় করছে।’

যুবক সে রকমই শান্ত স্বরে বলে, ‘না অন্যায় নয়। আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি। সে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে বলছি তুমি নির্ভয় থাকো।’ যুবতী কোন কথা খুঁজে পায়না। সে যুবকের বুকের আড়ালে নিজের মুখ লুকায়।

আর কিছু ভাবতে পারেনা অরণ্যা। অশ্রুজলে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে অরণ্যা শিউরে উঠল। একরাতেই চেহারাটা এমন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। যদি ঘটনা সত্যি হয়! অরণ্যা আর ভাবতে পারেনা। সে এলো চুলগুলো কোন রকমে কানের পেছনে সামলে স্বপ্নীলকে ফোন দিলো। ওপর পাশ থেকে স্বপ্নীলের ভরাট গলা ভেসে আসতেই সে নিজের মনোবল যেন খানিকটা ফিরে পেল। এ ভরাট কন্ঠের যাদুতেই সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভালোবাসার তরীতে স্বপ্নচারী হয়ে ভাসার সাহস পেয়েছে। এই সুলায়লিত কন্ঠের আহবানে সাড়া দিতে গিয়েই আজ সে কলংকিনী হওয়ার পথে। তবুও এই কন্ঠের ওপর রাগ করতে পারেনা। এ কন্ঠ শুনলেই যেন সমস্ত ভয় কেটে যায়, সামনে ভেসে ওঠে নির্ভরতায় ভরপুর একখানা শান্ত মুখ। চিরচেনা কন্ঠের উত্তর দিতে গিয়েই দেখল লাইন কেটে গেছে।

মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে আসতে বিকেল হয়ে গেল। শেষ বিকেলের রোদ ডায়গনস্টিক সেন্টারের গ্লাসে বিচ্ছুরিত হয়ে অরণ্যার চোখে এসে পড়ছে। রোদের সোনালী আলো অরণ্যার মুখে পড়ে চেহারার ম্লান ভাব আরো ফুটিয়ে তুলছে। অরণ্যার মা জেসমিন এক পাশের সোফায় বসে গম্ভীর দৃষ্টিতে সিসিটিভির দিকে তাকিয়ে আছেন। রিসিপশনে রিপোর্ট নেয়ার জন্য ডাক দিতেই তিনি এগিয়ে গেলেন। পুরো রিপোর্ট দেখার পর সে জায়গাতেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে ওঠলো। অরণ্যা জেসমিনের পেছনে এসে দাঁড়ালো। মৃদু কন্ঠে ডাক দিল, মা।

জেসমিন পেছন ফিরলেন। অরণ্যার দিকে রিপোর্ট এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখলে তো আমি যা আন্দাজ করেছিলাম তাই সত্যি হল।’

অরণ্যা স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপর আর কোন কিছু বলার মুখ রইলনা। বারবার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর জেসমিন বললেন, ‘আমরা তোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি তোমার নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছ। কিন্ত এখন দেখছি আমাদের ধারণা পুরোপুরি ভূল। আমাদের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তুমি যা করেছ তাতে সমাজে মান-সম্মান বলে আর কিছু রইলনা। আমি তোমার বাবাকে কি জবাব দেব!’ কথাগুলো শেষ করে জেসমিন চশমা খুললেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল আড়াল করতে চাইলেন।

কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‘এখন তোমার সামনে একটা পথই খোলা আছে।’

অরণ্যা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁকায়। তিনি বলেন, ‘তোমার এ ব্যাপারটা তুমি আর আমি ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কেউ জানেনা। তোমার গর্ভের সন্তানকে গর্ভেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে বাইরের কাক-পক্ষীও টের পাবেনা; আর সমাজে আমাদের সম্মানটাও বজায় থাকবে। আমি কথা দিচ্ছি তোমার বাবাও ঘুণাক্ষরে কিছু জানতে পারবেনা।’

গর্ভের সন্তান গর্ভেই নষ্ট করে দেওয়া কথাটা অরণ্যার কানে প্রবল আঘাত হানল। তার মনে প্রবল পাপবোধের সৃষ্টি হল। স্বপ্নীলের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে সে পাপ করেছে সত্যি কিন্ত ভ্রুণহত্যার মতো নির্মম ও ঘৃণ্য পাপ সে কখনও করতে পারবেনা। ভ্রুণহত্যা যে জগতের সকল পাপ, সকল অন্যায়কে ছাড়িয়ে যায়। এক জোড়া নারী-পুরুষের মূহুর্ত্বের ভূলের জন্য একটি পবিত্র জীবনকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দেওয়াকে অরণ্যা মন থেকে মানতে পারলনা। কিন্ত সে এতোটাই হতাশ ও বিধ্বস্ত যে মায়ের এ কথার কোন উত্তর দিতে পারলনা। সে কান্নাভেজা কন্ঠে, ‘আমাকে ভাববার সময় দাও মা।’ বলেই ছুটে বেরিয়ে গেল।

ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণে অরণ্যা ও স্বপ্নীল বসে আছে। অরণ্যা মাথা নিচু করে মৌন হয়ে রয়েছে। স্বপ্নীল অরণ্যাকে গালে আলতো ঠোকা দিয়ে সেই যাদুময় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে মাই ডিয়ার প্রিন্সেস? এতো জরুরী তলব দিয়ে আনালেন আর এখন আপনি চুপ করে আছেন! এ অধম বান্দা কি কোন গুরুতর কসুর করে ফেলেছে?’

স্বপ্নীলের এ ধরণের তামাশা অরণ্যার ভালো লাগছেনা। সে টেবিল থেকে মাথা তুলে বলল, ‘তোমার সাথে কিছু সিরিয়াস কথা আছে।’

স্বপ্নীল আগের মতোই হেয়ালী করে বলল, ‘কি ব্যাপার, বাসায় বিয়ের আলাপ চলছে নাকি?’

অরণ্যা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলনা। দুচোখ কান্নায় ভরে ওঠল। স্বপ্নীল অবাক হল। সে কিছু বলার আগেই অরণ্যা বলল, ‘আমি মা হতে চলেছি।’

স্বপ্নীলের কানে যেন বোমা পড়ল। সে চেহারায় বিষ্ময় ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী?

অরণ্যা মাথা নিচু করেই বলল, ‘আই এম জাস্ট প্রেগনেন্ট।’

স্বপ্নীল চোখ বিস্ফোরিত হল। ‘ইটস ইম্পসিবল। আই কুড নট বিলিভ মাই ইয়ারস!’

অরণ্যা এবার সরাসরি স্বপ্নীলের দিকে তাকাল। স্বপ্নীলের চোখগুলো বিস্ফোরিত। চেহারায় উতকন্ঠার ছাপ। অরণ্যা নিজেকে সামলে বলল, ‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে কেন!’

স্বপ্নীল বলল, ‘এটা কীভাবে সম্ভব?’

অরণ্যা তাচ্ছ্বিল্যভরে বলল, ‘সেদিন বিকেলের কথা কি ভুলে গেছ?’

স্বপ্নীলকে এবার সত্যি বিধ্বস্ত দেখায়। সে দু-হাতে মাথার চুল টানতে থাকে। অনেকক্ষণ পরে বলে, ‘দেখ অরণ্যা, আমি কিছু চিন্তা করতে পারছিনা। আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তুমি আমাকে কি করতে বলো?’

অরণ্যা সাথে সাথেই জবাব দিলো, ‘এর একটাই সমাধান, আর সেটা বিয়ে।’

স্বপ্নীল ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, ‘বিয়ে! অসম্ভব।’

অরণ্যার ঠোটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটে ওঠল। ‘বাহ! দারুন! বিয়ের কথা বলতেই মাথায় যেন বাজ পড়ল!’

‘আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো অরণ্যা।’

‘আর বুঝাবুঝির কি আছে। অন্যায় আমরা দু-জনে করেছি, তাহলে কলংকের ভাগীদার আমি একা হবো কেন?’

‘আমি স্বীকার করছি দোষটা আমারই বেশী। কিন্ত এ মূহুর্ত্বে বিয়ে করার মতো কোন মানসিকতা আমার নেই।’

‘মানসিকতা নেই কেন?’

‘তুমি বুঝতে চেষ্টা কর। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লীট হতে এখনও বছর দেড় বাকি। এখন তোমাকে বিয়ে করে আমি খাওয়াব কি?’

‘আমরা দু-জন মিলে যেকোন ভাবে সব চালিয়ে নেব। তুমি না বললে গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া আমার কোন উপায় থাকবেনা।’ কথাগুলো শেষ করেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে অরণ্যা।

‘বি প্র্যাকটিক্যাল অরণ্যা। আমি কোনভাবেই এখন বিয়ে করতে পারবনা। ক্যারিয়ার বিল্ড-আপ হওয়ার আগেই বিয়ের মতো গুরু দায়িত্ব নেয়ার জন্য আমি কোনভাবেই প্রস্তুত নই।’

‘বাহ! তাহলে তোমার রোপনকৃত পাপের বীজ কি আমাকে একাই বয়ে বেড়াতে বল?’

‘আমি সে কথা বলছিনা। বিয়ে না করেও আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারি। তুমি এখনও প্রাইমারী স্টেইজে আছো। এখনই এবরশন করিয়ে নিলে কোন ঝুঁকি থাকবেনা। তারপর পড়াশোনা শেষ হলে আমরা বিয়ের পিড়িতে বসতে পারি। আমি আশা করছি তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো।’

অরণ্যা বজ্রাহতের ন্যায় ক্ষণকাল চুপ করে রইল। চিরচেনা এ মধুময় ভরাট কন্ঠকে মনে হলো পৃথিবীর সবচাইতে কর্কশ কন্ঠস্বর। তারপর বলল, ‘আমি কোন অবস্থাতেই এবরশন করাবোনা। ভ্রুনহত্যার মতো অন্যায় আমি করতে পারবোনা।’

‘আজকাল সবাই এমনটি করছে। তাহলে তোমার সমস্যা কোথায়?’

‘কে করছে, আর কে করছে না, তা আমি জানতে চাইনা। আমি শুধু বলতে চাই, আমার গর্ভে আশ্রিত দেবশিশুকে আমি কোনভাবেই হত্যা করতে পারবোনা।’

‘তাহলে আমার আর বিশেষ কিছু করার নেই। এই পাপকে তুমি কি করবে তুমি সিদ্ধান্ত নাও।’

অরণ্যা প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘পাপ! কাকে তুমি পাপ বলছো? আমার গর্ভে এই পাপের বীজ বপন করেছে কে? নারী বলে কি পুরুষের সকল অন্যায়, সকল পাপ জোর করে নারীর গায়ে চাপিয়ে দেবে?’

স্বপ্নীল চেয়ার থেকে ওঠে অরণ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘শান্ত হও। আমি যা বলছি তাই করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

অরণ্যা কোন কথা বললনা। এক ঝটকায় স্বপ্নীলের হাত সরিয়ে দ্রুত পায়ে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে এলো।

সময়ের হিসেবে চব্বিশ ঘন্টা কিছুই নয়। অথচ এই স্বল্প সময়েই অরণ্যার জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। গ্লাসের স্বচ্ছ পানিতে এক কণা কাদা মিশালে নিমেষেই যেমন ঘোলা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি মুহূর্ত্বের একটা ছোট্ট ভুল অরণ্যার জীবনকেও ঘোলাটে করে দিয়েছে। স্বপ্নীল এ সন্তানকে কোনভাবেই পৃথিবীর আলো দেখাতে চায়না। সে স্পষ্ট বলে দিয়েছে বিয়ে করতে পারবেনা। মাও পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, গর্ভের সন্তান নষ্ট না করলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। অরণ্যা স্থির করতে পারছেনা সে কী করবে! সে কিছুই চিন্তা করতে পারছেনা। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ভ্রুণহত্যাকে অরণ্যা কোনভাবে মেনে নিতে পারছেনা।
আজ অরণ্যার চারপাশ প্রতিকূল। এই প্রতিকূল পরিবেশে সে কি করবে! অরণ্যা আলতো করে নিজের পেটে স্পর্শ করল। এমনভাবে হাত ছোঁয়ালো যেন সে শিশুটিকে আদর করছে। এখনও শিশুটির অস্তিত্ব বুঝা না গেলেও আর কদিন পরেই যখন উদর স্ফিত হবে তখন সবাই অস্তিত্ব টের পাবে। তখন সবাই ছি ছি রব তুলবে! অরণ্যার মনে হলো এ পৃথিবীতে সে বড্ড একা। তার অতি কাছের মানুষগুলো হঠাত করেই দূরে সরে গেছে। পরম নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে ভরসা করে যার তরে নিজের সমস্ত সত্ত্বা সঁপে দিয়েছিল তারই কারণে আজ সে কলংকিনি।

অরণ্যা মুহূর্ত্বেই সিদ্ধান্ত নিল ভ্রুন যদি হত্যা করতেই হয় তবে সবার আগে সে নিজেকেই শেষ করে দেবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সে ঘুমের ঔষধগুলো হাতের মুঠোয় ভরে নিল। একটা একটা করে গুনে দেখল মোট তেরটা ট্যাবলেট। এ ট্যাবলেটগুলো সে বাবার কাছ থেকে এনে রেখেছিল কিন্তু কখনো দরকার পড়েনি। আজ যে এমনভাবে কাজে লেগে যাবে তা সে ভাবতেই পারেনি। ঔষধগুলো মুখে পুরার আগে আরেকবার নিজের পেটে হাত বুলিয়ে নিল। হঠাত করে তার দুচোখ জলে ভরে ওঠল। কাঁপা হাতে ঔষধগুলো মুখের কাছে নিয়ে এলো। কিন্তু না সে পারলনা, নিজের জীবনের প্রতি কোন মায়া লাগছেনা, বারবার সেই অনাগত শিশুটির অবয়ব মনে ভেসে ওঠছে। মুখে দেয়ার ঠিক আগ মূহুর্ত্বে সব ঔষধ মেঝেতে ছুড়ে মারল। নিজের জীবনটাকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে এ শিশুর জীবনের কাছে। একেই কী বলে মায়ের ভালোবাসা! অরণ্যা তখনই একটা ব্যাগে নিজের কিছু কাপড় আর এটিএম কার্ড গুছিয়ে নিল। এ শিশুকে বাঁচাতে হলে একটা পথই খোলা আর তা হলো পরিচিত পরিবেশ থেকে আড়াল হয়ে যাওয়া।

তারপর কেটে গেছে পুরো নয়টি মাস। পরিচিত পরিবেশ থেকে এতোটা দূরে সরে থেকেও অরণ্যা জীবনটা অনেক আনন্দময়। ঢাকার আকাশের নিচে অচেনা পরিবেশে তাকে খুব বেশী কাঠ-খড় পোহাতে হয়নি। ট্রেনে আসার সময় এক মহিলার সাথে পরিচয়। কথায় কথায় যখন জানতে পারল ইনি একটি নারী বিষয়ক সংস্থায় কাজ করেন তখন সে তার নিজের সব কথা খুলে বলেছিল। পড়াশোনা পুরো শেষ করতে না পারলেও এই অসমাপ্ত শিক্ষাই তাকে পথের ধুলোয় মিশে যেতে দেয়নি। অসমাপ্ত শিক্ষার জোরেই সেই সংস্থায় অফিস সহকারীর চাকরী পেয়ে গেল। জীবনের এ মূহুর্ত্বে সব জায়গায় পরিবেশ প্রতিকূল হলেও এই একটা ক্ষেত্রে স্রস্টা তার সহায় ছিলেন।

এই সময়ে একটু একটু করে তার গর্ভে বেড়ে ওঠেছে দেবশিশু। একটু একটু করে উদর স্ফিত হয়েছে। গর্ভাবস্থায় মেয়েদের পেট বিশ্রী রকমের বড় হয়ে যায়। তাই প্রেগনেন্ট মহিলাদের স্ফিত পেটকে অরণ্যা সবসময় ঘৃণা করতো, কেমন জানি ভয় ভয়ও লাগত। মনে পড়ে, ও তখন বেশ ছোট। মায়ের পেটটা অস্বাভাবিক বড় হয়ে গিয়েছিল। তা দেখে অরণ্যার সে কী কান্না! কাঁদতে কাঁদতে একদিন দাদীকে জিজ্ঞেস করল, ‘দাদী মায়ের পেট এমন বিশ্রী হয়ে গেছে কেন?’

দাদী মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘তোমার মায়ের পেটে তোমার একটা ছোট ভাই আছে। আর যেহেতু সে এখন এখন একটু একটু করে বড় হচ্ছে তাই এমনটি দেখাচ্ছে।’

অরণ্যা এ কথা শুনে খুশী হতে পারলনা। সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘তাহলে ভাইটি বড় পচা!’ অরণ্যার শিশু মন এ অবস্থা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। সে মাকে সবসময় এড়িয়ে চলত আর ভাইটিকে বকা দিত।

তারপর একদিন যখন ভাইটি হল, তখন অরণ্যা কাছে গিয়ে দেখল, ভাইটি কাঁদেনা, নড়াছড়া করেনা। বাবা, মা, দাদী, নানী সবাই কাঁদছে। অরণ্যা মনে মনে খুশী হল। ভাইটি উচিত শিক্ষা পেয়েছে! বড় হয়ে যখন বুঝল তখন ওর খুব খারাপ লাগত। অরণ্যার মনে হতো ওর কারনেই ভাইটি মারা গেছে।
আজকাল পেটের মধ্যে দেবশিশুর অস্তিত্ব ভালোভাবেই অনুভব করা যায়। রাগ করে মাঝে মাঝে এমন লাথি দেয় মনে হয়, পেটের মধ্যে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার উত্তেজনাকর ফুটবল ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে। এই নতুন পরিবেশে কেউ তার সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেনা। অনেকেই সন্তানের বাবা কোথায় জানতে চেয়েছে। সে যে কুমারী মা একথা বলার সাহস তার হয়নি পাছে আবার কলংকের বোঝা চেপে বসে। সে বুকে পাথর চাপা দিয়ে সবাইকে বলেছে এই সন্তানের বাবা মারা গেছে। এই সময়ে সে একটিবারও বাসার কোন খোঁজ নেয়নি। বাবা-মার কথা মনে হতে অনেকবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করেছে কিন্তু ফিরে যেতে পারেনি। বাবা-মা যখন দেখবে সে স্বপ্নীলের সাথে পালিয়ে যায়নি তখন নিশ্চয় ভাববে সে আত্মহত্যা করেছে। স্বপ্নীলও তাই ভাববে। এইটেই ভাল।

চারতলা দালানের এই মেসবাড়ি শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য। এখানে ছেলেদের প্রবেশাধীকার নিষিদ্ধ। মেয়েদের জন্য এটি বেশ নিরাপদ আবাস। ছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মহিলা এখানে থাকছে। দুতলায় সিড়ির সাথে লাগোয়া একটি রুমে অরণ্যা থাকে। আজ সকাল থেকেই তার রুমে ভিড় জমেছে। প্রত্যেক তলার মেয়েরা তার রুমে এসে জমা হয়েছে। সে সবাইকে দেখছে কিন্ত কাউকে বসার কথা বলতে পারছেনা। সে বিছানাতে প্রসব বেদনায় কাতর। মাথার কাছে মেসের হোস্টেস বসে আছেন। তিনি মাথায় হাত বুলাচ্ছেন আর বলছেন, ‘চিন্তা করোনা মা। আমরা সবাই আছি।’

বিছানার পাশে বসে আছেন মেসের আরেকজন সদস্যা, যিনি একটি প্রাইভেট মেডিকেলের ডাক্তার। তিনি স্নেহের সুরে অরণ্যাকে বললেন, ‘একটু সহ্য করো।’ বলেই দু-জন ছাড়া আর সবাইকে রুম থেকে বের করে দিলেন।

সমস্ত পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে এসেছে। চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসছে। অসহ্য ব্যথায় অরণ্যা কাতরাচ্ছে। মাতৃত্বের এই অসহ্য যন্ত্রণা যে কতোটা ভয়ানক তা মা মাত্রই জানে। একজন মা কতোটা যুদ্ধ করে তার সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন অথচ সন্তান বড় হয়ে সে মার মনে কষ্ট দিতে একটুও দ্বিধা করেনা। অনেকদিন পরে মায়ের কথা মনে হল অরণ্যার। সে নিজেও তো মায়ের মনে কষ্ট দিয়েছে। মাকে দেখার ভীষন ইচ্ছে হল। অরণ্যার মনে হচ্ছে, এই শিশুকে জন্ম দিতে গিয়েই সে মারা যাবে। এ অবস্থাতেই সে স্রস্টার কাছে আকুতি জানাল, হে স্রস্টা, আমি মারা যাওয়ার আগে অন্তত একবার আমার সন্তানকে দেখতে দিও।

যুদ্ধ বুঝি একেই বলে। ভরা ময়দানে অজস্র সৈন্যের মাঝখানে একটি শিশু দাঁড়িয়ে আছে। তাকে উদ্ধার করতে পারে একমাত্র শিশুটির মা। তাকে একাকী ঐ যুদ্ধে অবর্তীণ হতে হবে। নিজের প্রাণ গেলেও সেই দূর্ভেদ্য ব্যুহ ভেদ করে শিশুটিকে নিয়ে আসতেই হবে। এই কঠিন যুদ্ধে অরণ্যা জয়ী। মাত্রই সে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ফিরে এসেছে। পৃথিবীর বুকে নিয়ে এল তার অন্তরাত্মাকে। অরণ্যা পাশ ফিরে দেবশিশুর পানে তাঁকাল। মা ও শিশু দুজনের চোখেই যুদ্ধ জয়ের হাসি। যুদ্ধ জয়ের এই স্নিগ্ধ, পবিত্র হাসি বুঝি সম্রাট আলেকজান্ডার সারা পৃথিবী জয় করেও হাসতে পারেননি।

শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪

কৃষ্ণচূড়ায় সিক্ত




বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের শাখা-প্রশাখার ফাঁকফোকর দিয়ে বাড়িটির অবয়ব যতটুকু দেখা যায় তাতেই যে কেউ বিমোহিত হবেকোন এক অদৃশ্য ভালোলাগা আর ভালোবাসার আবেশে মনটা ছুঁয়ে যায়আশপাশের পুরনো সব বাড়িই আধুনিকতার দুঃসহ চাপে বিলীন হয়ে গেছেঅথচ সব বাধাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে দু-তলা দালানের বাড়ি এখনো আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছেআধুনিকতার সব উপাদানকে তাচ্ছ্বিল্য করে আপন গাম্ভির্য্য আভিজাত্যে বাড়িটি আজও মোহনীয়সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত নকশা আঁকা প্রধান ফটক দেখলেই এর সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা পাওয়া যায়

প্রায় তিন যুগ ধরে বাড়ির প্রধান কর্তা ত্রৈলোক্য চৌধুরীদুই সন্তানের জনক চৌধুরীর স্ত্রী গত হয়েছেন বছর পাঁচেক আগেআত্নীয়-স্বজনদের অধিকাংশই পচাত্তর পরবর্তী সময়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেনশেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর সাথে সাথে তারা নিজেদের জীবনকেও বিপন্নবোধ করেছিলেন, এদেশে থাকতে ভরসা পাননিশেখ সাহেব যাওয়ার সময় তাদের সব ভরসা যেন সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ত্রৈলোক্যেরর ছোট ভাই দুটোও মাকে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমালোকিন্তু ত্রৈলোক্য বাপ-দাদার ভিটে মাটির মায়া ছাড়তে পারলেন নাতিনি এবং তার স্ত্রী রয়ে গেলেন পূর্ব পুরুষদের জমিদারীর শেষ চিহ্ন আগলে রাখতে

ইস্পাত কঠিন মনোবলের অধিকারী ত্রৈলোক্য বাবুর শৈশব, কৈশোর, যৌবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে বাড়ির আঙ্গিনায়আজ পঁয়ষট্টি বছর বয়সে এসেও সেই মায়া কাটাতে পারেননিবরং সেই মায়া আরো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছেআত্নীয়-স্বজনদের অনেকেই ভারতে চলে যাওয়ার তাগিদ দেন কিন্তু তিনি তার অনড় সিদ্ধান্ত থেকে একটুও নড়েননা

ত্রৈলোক্য বাবু শারিরীক সমস্যাজনিত কারণে রিটায়ার্ড পিরিয়ডের অনেক আগেই চাকরি থেকে অবসর নেনএল.জি.ডি. ডিপার্টমেন্টের মত সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও সারাজীবন সৎভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেনপ্রভিডেন্ট ফান্ড আর পৈত্রিক দোকানগুলো থেকে প্রাপ্ত টাকায় বর্তমানে দিনকাল ভালোই চলে যাচ্ছেছেলে অভিজিত কানাডায় একটি আইটি কোম্পানীতে চাকরী করে। মেয়ে দিপান্বিতা অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে গিয়ে সেখানে নিজের পছন্দে সাদা চামড়ার এক অস্ট্রেলীয়কে বিয়ে করে ঘরকন্যা করছে। ছেলে-মেয়ে দুজনই প্রতিদিন নিয়ম করে ত্রৈলোক্যে বাবুকে ফোন করে। দিপান্বিতা প্রতিদিন সকাল আর রাতে ফোন করে ত্রৈলোক্যকে ওষুধ খাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দিপান্বিতা ফোন করলেই ত্রৈলোক্যকে অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসার তাগিদ দেয়। ত্রৈলোক্য কৌশলে সেটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দিপান্বিতা রাগ করে। ওর মেয়ে জিনিয়া প্রায়ই ত্রৈলোক্যের সাথে কথা বলে। অস্ট্রেলীয় একসেন্টে উচ্চারিত ইংরেজীর সব তিনি ঠিকঠাক বুঝতেও পারেন না। অভিজিত আর দিপান্বিতা দুজনেই তাদের মায়ের মৃত্যুর পর পাঁচ বছর আগে দেশে এসেছিল। এরপর ওরাও আসেনি, ত্রৈলোক্যও কোন তাগাদা দেননি।

ত্রৈলোক্য বাবুর দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটে উত্তরদিকের ঝুল-বারান্দায় ইজি চেয়ারে শুয়ে বসে সময়টাতে তার একমাত্র সঙ্গী দৈনিক ইত্তেফাক আর দৈনিক প্রথম আলো যৌবনে ইত্তেফাকের প্রতি তার যে ভালোবাসা জন্মেছিল সেই ভালোবাসা এখনও রয়ে গেছেপত্রিকা ছাড়াও আছে কয়েকটি বিশাল আলমিরা ভর্তি বইপড়া বইগুলো ঘুরেফিরে পড়তে ভালোই লাগে তারপ্রতিদিন সন্ধ্যায় অভিজিতের ছেলে প্রান্তের সাথে টেলিফোনে অনেকক্ষণ কথা বলেননাতির আধো মুখের বুলি শুনতে তার বেশ ভাল লাগে পুরো কথা জুড়েই থাকে বাবা-মায়ের প্রতি প্রান্তের অভিযোগত্রৈলোক্য শুনেন আর হাসেন

পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের প্রায় সকলেই এই পাড়া থেকে উঠে গেছেযে দু-একজন এখনও রয়ে গেছে তারাও জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে অবিরাম দুলছেপাড়ায় নতুন যারা এসেছে তাদের সাথে তার খুব একটা খাতির নেইবাড়িতে তার দেখাশোনার জন্য একমাত্র রয়েছে রমেশবাজার-হাট সব রমেশই করেতিনি শুধু মাসের প্রথমে কাজীর হাটের ভাড়া দেয়া দোকানগুলো হতে ভাড়া তুলে আনেন।

কাজীর হাটে যাওয়ার পথে পাড়ার ঠিক উলটো দিকে বড় রাস্তা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা বয়েজ স্কুলের দিকে চোখ পড়লেই মনটা কেমন জানি করে ওঠে ত্রৈলোক্যেরএই স্কুলে তার কত মজার স্মৃতি রয়েছেসহপাঠিরা তাকে ত্রৈলোক্যের বদলে তেরলক্ষ বলে ভীষন খেপাতপ্রায়ই তিনি রেগে যেতেন আর সহপাঠিদের পিঠে দু-তিন ঘা বসিয়ে দিতেনএকবার তো জমসেদকে এমন ঘুসি দিয়েছিলেন যে বেচারার নাক দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়েছিলতারপর হেডস্যার এসে যা পিটুনি দিয়েছিলেন তা ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে ত্রৈলোক্যেরআজ এত বছর পর সেইসব কথা মনে পড়লে মনটা শূন্যতার অদৃশ্য প্রলেপে ঢাকা পড়ে

এই বিশাল বাড়িতে দুটো জিনিসকে ত্রৈলোক্যের খুব বেশী আপন মনে হয় একটি সামনের উঠোনের সুউচ্চ কৃষ্ণচূড়া গাছ আর আরেকটি পেছনের বিরাটকার পুকুর দুটোর প্রতি তার মনের মধ্যে অন্যরকম ভালোবাসা, অন্যরকম টানসবাই তাকে ছেড়ে দূরে সরে গেছে কিন্তু দুটো এখনও তার সঙ্গী হয়ে রয়েছেকৃষ্ণচূড়া আর পুকুরের দিকে চোখ পড়লেই তার শৈশব স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে শৈশবের সেই দিনগুলোতে কত সাঁতরেছেন পুকুরেকতবার যে কৃষ্ণচূড়ার গাছের শীর্ষতে আরোহন করেছেন তার ইয়ত্তা নেই
একবার তো পুকুরে সাঁতরাতে গিয়ে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেনএকগলা পানি খেয়ে যখন একটু একটু করে নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছেন ঠিক তখনই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিনুদিত্রৈলোক্যকে পাঁজাকোলা করে তুলে আনেন ঘাটেবিনুদির জলপাই রঙের শাড়িটা কাদা-জলে ভিজে তার শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়েছিলপানি থেকে তুলে আনার সময় বিনুদির কোমল স্পর্শে ত্রৈলোক্য ভীষন রোমাঞ্চিত বোধ করছিলেন বিনুদির অলক্ষ্যে বিনুদির ভেজা নরম বুকে মুখ গুটিয়ে ত্রৈলোক্য উম নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। ওই সময় ত্রৈলোক্যের মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সব উষ্ণতা, সব ভালোবাসা, সব নির্ভরতা এই সিক্ত মানবীর কোমল বুকে লুকিয়ে রয়েছে। পাড়ে উঠিয়ে বিনুদি ত্রৈলোক্যকে ভীষন বকা দিয়েছিলেনসেই বকুনী ত্রৈলোক্যের কানে অমীয় সুধার মত বাজছিল বিনুদি সে দিন তার মমতা আর স্নিগ্ধতা দিয়ে চৌদ্দ বছর বয়সের এক বালকের হৃদয়ে এক অনন্য স্থান অর্জন করেছিলেন

ত্রৈলোক্যের চেয়ে সাড়ে তিন বছরের বড় বিনুদি ছিলেন সাদামাটা অথচ অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারীতার মুখাবয়ব বিশেষ করে চোখের মধ্যে এমন এক মাধুর্য্য ছিল যা সহজেই যে কাউকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখেতার স্নেহময়ী আচরণের কাছে ত্রৈলোক্য সম্পূর্ণ ধরাশায়ী হয়েছিলেনবয়সের ফারাক থাকা সত্ত্বেও ত্রৈলোক্য বিনুদির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেনতখন বিনুদি পড়তেন উচ্চমাধ্যমিকে আর ত্রৈলোক্য মাত্র ক্লাস এইটেবিনুদি যখন চুলে রঙ্গীন ফিতে বেঁধে বেণী দুলিয়ে কলেজে যেতেন তখন ত্রৈলোক্য এতোটাই মুগ্ধ হয়ে দেখতেন যে তখন তাদের দুজনের মধ্যকার বয়সের পার্থক্য মনেই থাকতোনা

বিনুদির হাসি-খুশী প্রাণচাঞ্চল্য ভরা মুখ দেখতে ত্রৈলোক্যের ভীষন ভালো লাগতো। মাসের তিন-চারদিন বিনুদিকে খানিকটা বিষন্ন আর অবসাদগ্রস্থ দেখাতো। এই কয়েকটা দিন বিনুদি নিজেকে খানিকটা আড়াল করে রাখতেন। অন্যান্য সময় মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করলেও এই টা দিন তিনি সেসব থেকে দূরে থাকতেন। তখন ত্রৈলোক্যেরও ভীষন মন খারাপ হয়ে যেতো। বেশ কয়েকবার তিনি বিনুদিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই দিদি তোর কি হয়েছে? কিন্তু প্রতিবারই বিনুদি লাজুক মুখে তা এড়িয়ে গেছে। এই বয়সে এসে এসব মনে পড়লে ত্রৈলোক্য লজ্জ্বিতবোধ করেন, তিনি শুধু শুধু বিনুদিকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতেন।

পৌষ সংক্রান্তির সময় মেশোমশাই যখন বিনুদিকে বাড়ি নিয়ে যেতেন তখন ভীষন মন খারাপ হত ত্রৈলোক্যের মেশোমশায় এর উপর খুব রাগ হতো। মেশোমশায়ের ওপর তার খুব রাগ হতো। সন্ধ্যায় পড়তে বসে গণিত খাতায় সম্পাদ্য আঁকার বদলে তিনি দস্যু মেসোমশায়ের ছবি এঁকে খাতা ভরিয়ে ফেলতেন।

কিন্তু সেই বিনুদি যখন কমলদার হাত ধরে এক লক্ষীপুজোর সন্ধ্যায় অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন তখন ত্রৈলোক্য ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেনএক আকাশ শ্রাবণধারা অঝোরে নেমেছিল তার দু-চোখ বেয়েতার হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করার কোন সুযোগই দিলেন না বিনুদি এর অনেকদিন পর তিনি খবর পেয়েছিলেন, এক ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে বিনুদি গলায় দড়ি দিয়ে আত্নহত্যা করেছেনবিনুদির মৃত্যুর খবর শুনে ত্রৈলোক্য ভীষন ব্যথিত হয়েছিলেনসেই থেকে এখনও প্রতি ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে বিনুদির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ বাড়ির পেছনের পুকুরে কৃষ্ণচূড়ার পাঁপড়ি ভাসিয়ে দেন

বিনুদি ছাড়াও আরেকজনের প্রেমে পড়েছিলেন ত্রৈলোক্যবাবুমুক্তিযুদ্ধের বছর তিনেক আগে কলকাতা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে পূর্বপাকিস্তানে ফিরে এলেন ত্রৈলোক্যবড় পিসি কিছুতেই আসতে দিচ্ছিলেন নাকিন্তু ত্রৈলোক্য জেদ ধরলেন তিনি দেশে এসেই বাকি পড়াশোনা করবেনশেষ পর্যন্ত বড়পিসি তাকে পূর্ববঙ্গে পাঠাতে বাধ্য হলেনকলকাতা থেকে ফিরে বাড়িতে ঢুকার পথেই দেখতে পেলেন, কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সদ্য কৈশোর পেরুনো এক যুবতী ফুল কুড়োচ্ছেউঠোন ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরতেই মেয়েটির সাথে ত্রৈলোক্যের চোখাচোখি হলোমেয়েটা লাজুক ভঙ্গিতে চোখ সরিয়ে নিলক্রমাগত যৌবনের পথে অগ্রসরমান এই তরুণীর দৃষ্টিবাণে ত্রৈলোক্য বিদ্ধ হলেনএক অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করছিল তার মধ্যেপরে তিনি জানতে পেরেছিলেন এই তরুণী তার ছোট কাকীর বোনের মেয়ে

ত্রৈলোক্য কাজলরেখার মধ্যে ভাব জমতে খুব একটা সময় লাগেনি। তাদের মধ্যে অনেক ভাল বন্ধুত্ব তৈরী হয়ে গিয়েছিলকাজলরেখা যে কয়দিন বাড়িতে ছিল খুব ভাল সময় কেটেছিল ত্রৈলোক্যেরযেদিন কাজলরেখা তার বাবার সাথে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল সেদিন কাজলরেখা খুব কাঁদছিল আর বারবার ত্রৈলোক্যের দিকে তাকাচ্ছিলকাজলরেখার চোখের জল ত্রৈলোক্যের হৃদয়েও দোলা দিলো। বিনুদির পর এই প্রথম কোন মেয়ের প্রতি তিনি নিজের মধ্যে ভাললাগার আবেশ অনুভব করছিলেন

কাজলরেখা চলে যাওয়ার পরও অনেকদিন পর্যন্ত তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল তারা উভয়েই চিঠির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেনপ্রতি বসন্তে ত্রৈলোক্য রঙ্গীন খাম ভরে পাঠাতেন কৃষ্ণচূড়ার শুকনো পাঁপড়িআর ফিরতি চিঠিতে কাজলরেখা হৃদয় নিংড়ানো আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে লিখত মনের ভাললাগা এমনি এক বসন্তে পাঠানো চিঠির কোন জবাব এলোনাএর কিছুদিন পর ত্রৈলোক্য জানতে পারলেন এক মস্তবড় ব্যবসায়ীর সাথে কাজলরেখার বিয়ে হয়ে গেছে ত্রৈলোক্যের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিলতার জীবনের দুটো ভাললাগাই এভাবে দূরে হারিয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে
পঁচাত্তরের এপ্রিলে ত্রৈলোক্যের বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বড় ছেলের বউ দেখে যাবেন বলে শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। বাবার শেষ ইচ্ছা রক্ষা করতে একান্ত অনিচ্ছ্বা সত্ত্বেও ত্রৈলোক্যকে পিড়িতে বসতে হলোতড়িঘড়ি করে মাত্র দুদিনে সব বন্দোবস্ত করা হলো।

বাসর রাতে বাইরে উত্তাল হাওয়া বইছিল। হাওয়ার ভাবগতিকে মনে হচ্ছিলো আজ একটা হ্যাস্তন্যাস্ত করেই সে থামবে। সে রাতে নতুন বউয়ের ঘোমটা সরিয়ে ত্রৈলোক্য প্রথম কথাটি বলেছিলেন, বাড়িতে তোমার একটা সতীন আছে বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে জয়িতা আৎকে উঠেছিলেনআবছা আলোতেও বোঝা যাচ্ছিল নববধুর চোখ দুটি ছলছল করছেত্রৈলোক্য জানালার পর্দা সরিয়ে ঈশারায় দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছটিকে দেখালেনকালবৈশাখীর উম্মাতাল হাওয়ায় তখন কৃষ্ণচূড়া গাছটি ভীষন নাচানাচি করছিল মূহুর্ত্বেই জয়িতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কেটে যায় সব ভয় নববধুর স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে ত্রৈলোক্য হারিয়ে যান গহীন সমুদ্রেবিনুদি আর কাজলরেখাকে ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন একজন জয়িতার প্রাণপুরুষ!

 
Copyright © 2014 রিপন ঘোষের খেরোখাতা All Right Reserved
^
Blogger দ্বারা পরিচালিত.