রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর বালিশে হেলান দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে ব্ল্যাক কফির মগে
চুমুক দিতে দিতে নেট ইউজ করাটা রক্তিমের একটা বিশেষ শখ। অফিস চলাকালীন
সময়ে ইন্টারনেট ইউজ করলেও ফেসবুকে সময় দেয়া যায়না। তাই রাতের এই সময়টায় সে
মূলত ফেসবুকেই সময় দেয় বেশী। ফেসবুকের হোমপেজ ব্রাউজ করতে করতে হঠাৎ
রাহাতের স্ট্যাটাসে তার চোখ আটকে যায়। রাহাত এবং তার কয়েকজন বন্ধু মিলে ওই
স্ট্যাটাসে জমজমাট আড্ডা দিচ্ছে। মাত্র ত্রিশ মিনিটে কমেন্টের সংখ্যা সত্তর
ছাড়িয়ে গেছে! রক্তিম সবগুলো কমেন্ট মন দিয়ে পড়লো। যুথি নামের একটি মেয়ে
আড্ডা বেশ জমিয়ে তুলেছে। কমেন্টগুলো দেখে রক্তিমের বেশ মজা লাগছিলো। সেও
একটা কমেন্ট ছুড়ে দিলো, কি রে তোরা কি করছিস?
রাহাত রাগের ইমো দিয়ে বলে, গরুর ঘাস কাটছি! আজকাল চোখেও কম দেখছিস নাকি?
রক্তিম উত্তর দেয়ার আগেই যুথি নামের মেয়েটা রক্তিমকে উদ্দেশ্য করে লিখে,
রাহাত ভাই তোমার বন্ধুর চোখের লেন্স চেঞ্জ করতে হবে। তারপর শুরু হলো
কমেন্টের মাধ্যমে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া। যুথির কথার তোড়ে রক্তিম প্রায়ই খেই
হারিয়ে ফেলছিলো। একসময় যুথি বলে, বন্ধুরা যাচ্ছি। অনেক ঘুম পেয়েছে। কারো
উত্তরের অপেক্ষা না করেই যুথি অফলাইন হলো। রক্তিম চাইছিলো যুথি আরো
কিছুক্ষণ থাকুক। ওর সাথে কথা বলতে বেশ মজা লাগছিলো।
রক্তিম তারপরও বেশ খানিকক্ষণ কমেন্টগুলোয় চোখ বুলালো। যুথির কমেন্টগুলো
বেশ ঝরঝরে, প্রানোচ্ছ্বল। সে অবচেতন মনে যুথির নামে ক্লিক করলো। যুথির
প্রোফাইলে অনেক সুন্দর একটি প্রজাপতির ছবি দেয়া। ইনফোতে বিশেষ কিছু লেখা
নেই। তবে ছবিটি দেখেই যে কারো ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে ইচ্ছে করবে।
রিকুয়েস্ট পাঠাবে কি পাঠাবে না, ভাবতে ভাবতে রক্তিম শেষ পর্যন্ত ফ্রেন্ড
রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই দিলো।
আড্ডায় আড্ডায় অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। রক্তিম ঘড়ির দিকে তাঁকাতে দেখলো
রাত দেড়টা বাজে। সচরাচর সে সাড়ে বারোটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। তা নাহলে সকালে
ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরী হয়ে যায়। আর দেরীতে ঘুম থেকে ওঠা মানে অফিসে যেতে
দেরী হওয়া।
রক্তিম ল্যাপটপ বন্ধ করে পাশে তাকাতে দেখলো নীলা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।
ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় নীলাকে অনিন্দ্য সুন্দর দেখাচ্ছে। ছাব্বিশ বছর
বয়সের নীলার বয়স যেন বছর পাঁচেক কমে গেছে। ঘুমের ঘোরে নীলার গোলাপী রঙের
শাড়িটা হাটু পর্যন্ত উঠে গেছে। নীলচে আলোর স্নিগ্ধ প্রতিপ্রভা বিচ্ছুরিত
হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ওর সমস্ত মুখাবয়বে। আলো-ছায়ার খেলা, নীলার দুধে-আলতা মাখানো
ফর্সা মুখমন্ডলে সৌন্দর্য্যের প্রলেপ আরেকটু এঁকে দিচ্ছে। নীলার ঠোটের
পাতা খানিকটা ফাঁক হয়ে রয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে নাক দিয়ে নিঃশ্বাস না ছেড়ে ও
ওষ্ঠদ্বয়ের ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। নীলার এমন মায়াবী রূপ দেখে রক্তিমের
বেশ ভালো লাগছিলো, ইচ্ছে করছিলো নীলার কোমল ওষ্টে আলতো করে একটা চুমু এঁকে
দেয়। কিন্তু এই মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে নীলা ভীষণ রাগ করবে। রক্তিম
চায়না তার সোনা বৌ কোনভাবেই তার ওপর রাগ করুক। সে নিজেকে সংযত করে পাশ ফিরে
শোয়।
পরদিন বেশ দেরীতে নীলার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে রক্তিমের। তাড়াহুড়ো করে নাস্তা
সেরে অফিসে রওয়ানা দেয়। যাওয়ার আগে দরজার কপাট আড়াল করে নীলার স্নিগ্ধ ঠোটে
একটা চুমু এঁকে দেয়। রক্তিম চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত নীলা সদর দরজায়
দাঁড়িয়ে থাকে।
অফিসের প্রবেশ পথে করিডোরে এম.ডি সাহেবের সাথে রক্তিমের দেখা। করমর্দনের
জন্য রক্তিমের দিকে ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে তিনি সহাস্যে বললেন, কি ব্যাপার
রক্তিম, আজ এতো দেরী যে?
রক্তিম লজ্জ্বাবনত মুখে বলে, না স্যার, ঘুম থেকে সময়মতো উঠতে পারিনি তাই একটু লেট হয়ে গেছে।
এম.ডি ফারুক সাহেব মৃদু হাসি দিয়ে বলেন, ইটস ওকে, প্রতিদিনই তো সময়মতো
আসো, একদিন দেরী হলে বিব্রতবোধ করার কোন কারণ নেই। তোমার টেবিলে গিয়ে মুবিন
ব্রাদার্সের ফাইলটা আমার রুমে পাঠিয়ে দিও। বলেই করিডোরের দক্ষিণ কোণে
নিজের রুমে প্রবেশ করলেন এমডি।
রক্তিম কিছুটা চাপমুক্ত হয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে। মুবিন ব্রাদার্সের
ফাইলটা আরেকবার চেক করে বেয়ারাকে দিয়ে এম.ডির রুমে পাঠিয়ে দিলো। আর
বেয়ারাকে বলে দিলো, আসার সময় যেন এক কাপ কড়া লীকার চা নিয়ে আসে। অফিসে আজ
আর বিশেষ কোন কাজ নেই। জমে থাকা কাজগুলো গতকালই মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে।
রক্তিম ল্যাপটপ খুলে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলো।
ওয়েবসাইটের প্রথম পাতায় চোখ বুলাতেই ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অধিকাংশ
শেয়ারের সূচক আজ উঠতির দিকে। তার কেনা বেশ কিছু শেয়ারের দাম অনেকদিন থেকেই
পড়তির দিকে ছিলো। আজ সে শেয়ারগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু
করেছে। দুপুরের মধ্যেই শেয়ারগুলোর দাম একটা ভালো পর্যায়ে পৌছবে আশা করা
যায়।
সে খুশী মনে আরেকটা ট্যাবে ফেসবুক ওপেন করে। পেজ ওপেন হতেই দেখলো সাতটা
নোটিফিকেশন। এর মধ্যে একটা নোটিফিকেশন, যুথি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এঙ্প্টে
করেছে। পেজের বামদিকে নিচে তাকাতেই দেখলো তের জন বন্ধু এখন অনলাইনে রয়েছে।
সে মনে মনে ভাবে, এইগুলার কি কোন কাজ নেই! সারাদিন ফেসবুকে বসে থাকে!
বামদিকের চ্যাট অপশনে ভালো করে খেয়াল করতেই যুথির প্রোফাইলের প্রজাপতির
ছবি তার চোখে পড়লো, তার মানে যুথিও অনলাইনে। সে যুথির নামের উপর ক্লিক
করতেই চ্যাটের ছোট পেজটা খু্েলল গেল।
সে লিখলো, হাই যুথি!!!
অনেকক্ষণ চলে যাওয়ার পরেও যুথি কোন রিপ্লাই দিলোনা। রক্তিম আবার লিখলো, কি অবস্থা, বেশী বিজি নাকি?
এবার প্রায় সাথে সাথেই রিপ্লে আসলো, না ভাইয়া, আসলে আমি গুগলে ইলেক্ট্রো
ডায়নামিকসের একটা থিওরি সার্চ করছিলাম, তাই এদিকে খেয়াল করিনি।
রক্তিম রিপ্লাই দেয়,– হুম তাই বলো, তারপর কেমন আছো তুমি?
– আমি ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?
-হ্যাঁ আমিও ভালো আছি। আচ্ছা আমি তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করায় রাগ করোনি তো?
-না ভাইয়া রাগ করার কি আছে
-যাক নিশ্চিন্ত হলাম। তারপর তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?
-আপনাদের দোয়ায় ভালোই চলছে।
-ভালো হলেই ভালো তা তুমি কিসে পড়াশোনা করছো?
-আমি কম্পিউটার সায়েন্সে ২য় বর্ষে পড়ছি।
-ওয়াও গ্রেট! আমিও সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিলাম। গণিতে অনার্স কমপ্লিট করার পর এমবিএ করে এখন কর্পোরেট চাকরে পরিণত হয়েছি।
-ভাইয়া আপনার এডুকেশনাল এন্ড জব ব্যাকগ্রাঊন্ড দারুন!
-থ্যাংকস , তারপর তুমি কোন ভার্সিটিতে পড়ছো?
-আমি SUST এ পড়ছি।
– গ্রেট! একে তো SUST, তার ওপর জাফর ইকবাল স্যারের ডিপার্টমেন্টে পড়ছো! দারুন!
-ঠিক বলেছেন জাফর স্যারের ডিপার্টমেন্টে পড়ে আমি নিজেও গর্বিত।
-এই একজন মানুষ যার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলেই নিজের আত্নবিশ্বাস অনেকখানি
বেড়ে যায়। তিনি নিশ্চয় কোন যাদু জানেন নাহলে কেন উনার ছবি মনের মধ্যে ভেসে
উঠলে সব ভয়-ডর দূরে চলে যাবে! একবার স্যারের দেখা পেলেই ধন্য হয়ে যাই, আর
তুমি সরাসরি উনার ছাত্রী! স্যার কি নিয়মিত ক্লাস নেন?
-হ্যাঁ, উনি উনার প্রায় প্রতিটা ক্লাসেই আসেন। ঝড়-বাদলার দিনে কারেন্ট চলে গেলেও স্যার মোমবাতি দিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা নেন।
-হুম জাফর ইকবাল স্যার সত্যিই এক অন্যরকম ব্যক্তিত্ত্ব। উনাকে দেখলেই অনুপ্রাণিত বোধ করি।
-হুম, ভাইয়া আপনি কি স্যারকে কখনো সরাসরি দেখেছেন?
-কত্তোবার দেখেছি। প্রথমবার দেখেছিলাম একুশে বইমেলায়। সাদা-কালো ধুসর চুলের এই মানুষটাকে দেখলেই আমার মাথা শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যায়।
তারপর অনেকক্ষণ ধরে চললো তাদের চ্যাট। হঠাৎ করেই যুথি ডিসকানেক্ট হয়ে গেলো। রক্তিমও ফেসবুক থেকে লগআউট করলো
দুপুর ২টার দিকে ডিএসই’র ওয়েবসাইটে ঢুকেই রক্তিমের চোখ ছানাবড়া হয়ে
গেলো। তার কেনা শেয়ারগুলোর দর স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চসীমায় উঠেছে। এখনি
বিক্রি করে দিতে পারলে পুরো পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা প্রফিট। সে ব্রোকার হাউজ
এ ফোন লাগালো, কিন্তু ফোন এনগেজ মারছে। রক্তিম বেশ বিরক্ত হলো। কয়েকবার
চেষ্টার পর লাইন পেতে বলে দিলো তার লটগুলো যেন চলতি দরে বিক্রি করে দেয়া
হয়।
রক্তিমের বুক থেকে যেন একটা বড় পাথর নেমে গেছে। এ শেয়ারগুলো নিয়ে
অনেকদিন থেকেই সে চিন্তিত ছিলো। অনেকদিন থেকে লসে ছিলো, কিছুতেই দাম
বাড়ছিলোনা। আজ যখন বাড়লো, এক লাফে এতো লাভ! সে তার ভাগ্যকে ধন্যবাদ না দিয়ে
পারলোনা।
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে সোফাতে গা এলিয়ে দিতেই
নীলা চা আর চিকেন স্যান্ডউইচ নিয়ে পাশে এসে বসলো। রক্তিম দুপুরে অফিসের
কেন্টিনে খেয়ে নেয় তাই বাসায় ফিরে ভাত খায়না। স্যান্ডউইচ খেতে খেতে রক্তিম
আড়চোখে নীলাকে দেখে। সাধারণ সাজে নীলাকে অসাধারণ দেখাচ্ছে। সে নীলার একটা
হাত ধরে বলে, আজ তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। নীলা লাজুক হাসি দিয়ে হাত
সরিয়ে নিতে চায়। রক্তিম নীলাকে আরো ঘনিষ্ট করে কাছে টেনে আনে। নীলা মৃদু
প্রতিবাদ জানিয়ে রক্তিমের বাহুর বাঁধন আলগা করতে চায় কিন্তু পারেনা।
রক্তিম নীলাকে বলে, আজ আমার অনেক খুশির দিন। অনেকদিনের চাপানো পাথর আজ বুক থেকে নেমে গেছে।
নীলা আদুরে সুরে বলে, কেন, এতো খুশি কেনো?
রক্তিম নীলাকে বাঁধন থেকে কিছুটা আলগা করে দিয়ে বলে, আমার আটকে থাকা
শেয়ারগুলো আজ ভালো দামে বিক্রি করে দিয়েছি। মোটা অংকের প্রফিট এসেছে।
আগামীকালকেই ব্যাংকে টাকা জমা পড়বে।
নীলা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, যাক তাহলে একটা সুরাহা হলো শেয়ারগুলোর। আমিও ভীষন চিন্তিত ছিলাম ওগুলো নিয়ে।
রক্তিম চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলে, এই আনন্দে আমি তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। কি চাও বলো?
নীলা বলে, টাকা নষ্ট করার কোন দরকার নেই। আমার শ্রেষ্ট উপহার তুমি। তুমি
সবসময় পাশে থাকলে আমার আর কিছু চাইনা। বলেই নীলার দুচোখ জলে ভিজে ওঠে।
নীলার ভালোবাসার এমন বহিঃপ্রকাশে রক্তিম আশ্চর্য্য হয়। এমন লক্ষী স্ত্রী
কয়জনের ভাগ্যে জুটে! রক্তিম নীলাকে আরো কাছে টেনে নেয়। ভালোবাসার আবেশে এ
সন্ধ্যারাতে উভয়ে একে-অপরের সাথে মিশে যায় মধুর আলিঙ্গনে। আর মেঘমুক্ত
আকাশে বৈশাখী পূর্ণিমার বাঁধভাঙ্গা আলো জানালার ফাঁক গলে আচড়ে পড়ে অন্ধকার
ড্রয়িংরুমে।
২
৩ মাস পর…
রক্তিম ও নীলার দাম্পত্য জীবন পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও, ওদের কোল জুড়ে এখনও
কোন সন্তান আসেনি। আসলে রক্তিম সবসময় চেয়েছে নীলা উচ্চশিক্ষাটা কমপ্লিট
করুক। পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে সন্তান নিলে নীলার পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে
রক্তিম সন্তান নিতে চায়নি। নীলার এম.এস.সি সম্পন্ন হওয়ার পরও রক্তিম
সন্তান নিতে আগ্রহী নয়। সন্তানের কথা তুললেই কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা
করে। কিন্তু নীলার মাতৃহৃদয় একটি সন্তানের জন্য আকুল হয়ে আছে।
নীলা ইদানীং লক্ষ্য করেছে রক্তিমের আচরণ আগের তুলনায় অনেক পরিবর্তিত।
আগে কখনোই রক্তিম নীলার সাথে কড়া ভাষায় কথা বলেনি, অথচ ইদানীং সুযোগ পেলেই
নীলাকে অপমান করতে ছাড়েনা। তাদের পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে এমন রক্তিমকে সে
কখনোই দেখেনি। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একজন মানুষ কতোটা পরিবর্তিত হতে পারে
তার জ্বলন্ত উদাহরণ রক্তিম। গত কিছুদিন যাবত সে রাতে ঘুমায়ও বেশ দেরীতে।
সে জন্য প্রায়দিনই অফিস যেতে দেরী হয়। রাত জেগে নেটে কি করে জানতে চাইলে
বলে, অফিসের কাজ করছে। নীলা ঠিক বুঝতে পারেনা রাত জেগে কি এতো কাজ!
রক্তিম আর যুথির ভার্চুয়াল সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্টতা লাভ করেছে। তাদের
সম্পর্ক ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর হয়ে প্রেম-ভালোবাসার পর্যায়ে চলে গেছে বলা
যায়। রক্তিম যুথির কাছে নীলার কথা গোপন রেখেছে। যুথি জানে রক্তিম অবিবাহিত।
রক্তিম বেশ কয়েকবার সিলেট গিয়ে যুথির সাথে দেখাও করেছে। যুথি দেখতে বেশ
সুন্দর ও স্মার্ট, নীলার চেয়ে সামান্য একটু ফর্সা। কিন্তু তারপরও নীলার
ব্যক্তিত্ত্ব আর সৌন্দর্য্যের কাছে যুথির সৌন্দর্য্য যেন ম্লান হয়ে যায়।
ঘরে সুন্দরী, শিক্ষিত স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও রক্তিম যুথির চটপটে
কথাবার্তার মধুময়তা ও চঞ্চলতায় নিজেকে সঁপে দেয়। প্রিয়তমা স্ত্রীর
ভালোবাসাও তুচ্ছ মনে হয় যুথির প্রাণচাঞ্চল্যে। দিনে অন্তত একটিবার যুথির
সাথে কথা না বললে মনে হয় যেন যুগ-যুগান্তর পেরিয়ে যাচ্ছে জাগ্রত চৌরঙ্গীর
নির্বাক ভাস্কর্য্যের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে। সময় পেলেই ফেসবুক আর সেলফোনের
বিচ্ছুরিত তরঙ্গকণায় হারিয়ে যায় কথার ভুবনে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে কি
দুজনকেই ঠকাচ্ছেনা! কিন্তু তা নিমিষেই মিলিয়ে যায় হৃদয়ের কোলাহলে। এ
সবকিছুই চলে নীলার দৃষ্টির অগোচরে।
অফিসের গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। ড্রাইভার হর্ণ দিচ্ছে
একটু পরপর। রক্তিম তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে গিয়ে উঠে। আগে অফিসে যাওয়ার আগে
রক্তিম নীলার কোমল অধরে আলতো করে চুমুর পরশ বুলিয়ে দিতো। অথচ এ ক’দিনে
সবকিছু বদলে গেছে। নীলার ভীষণ কান্না আসে। রক্তিম দৃষ্টি সীমা ছাড়িয়ে
পর্যন্ত নীলা সজল চোখে দরজা আকড়ে থাকে।
ড্রয়িংরুম দিয়ে যাওয়ার সময় নীলার চোখে পড়ে টি-টেবিলের মধ্যে ল্যাপটপ পড়ে
রয়েছে। রক্তিম তাড়াহুড়োয় নিতে ভুলে গেছে। নীলা অনেক খুশী হলো ল্যাপটপ দেখে।
আজ তাহলে প্রাণখুলে কানাডায় বড় আপুর সাথে কথা বলা যাবে। নীলা ডান হাতে চোখ
মুছতে মুছতে ল্যাপটপের পাওয়ার বাটনে অন করে। কিন্তু চারপাশ কোথাও মডেমের
অস্তিত্ত্ব খুঁজে পেলনা। তো কি আর করা, বিফল মনোরথ হয়ে হার্ডডিস্কের এক
ড্রাইভ থেকে আরেক ড্রাইভে ঘুরতে লাগলো। ডি ড্রাইভে বেশ কিছু ছবি রয়েছে। সে
মাউসে ক্লিক করে ডি ড্রাইভ ওপেন করতেই সাতটি ফোল্ডার দেখা গেলো। সব
ফোল্ডারেই রাখা বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবি। প্রথম ফোল্ডারে রাখা থাইল্যান্ড
ট্যুরের বেশ কিছু ছবি। সে ছবিগুলো দেখতে দেখতে জঔ১৪৩ নামে একটি ফোল্ডার
দেখতে পেলো।
সে ফোল্ডারে থাম্বনেইলস দিতেই নীলার শিরদাড়া বেয়েএকটি শীতল তরঙ্গ
বিদ্যুৎবেগে নেমে গেলো। প্রায় প্রত্যেকটি ছবিতেই রক্তিম আরেকটি মেয়ের সাথে
দাঁড়িয়ে আছে। উভয়েই একে অপরের সাথে বেশ ঘনিষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে। নীলা তার
চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে কান্না বেরিয়ে
আসতে গিয়েও পারছেনা, গলা পর্যন্ত এসে আটকে যাচ্ছে।
হঠাৎ সে ভীষন একাকীত্ব অনুভব করছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব অন্ধকার একত্রে
জমা হয়েছে ওর হৃদয়ের অন্দরমহলে। সে যতোটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে ছবিগুলো
দেখলো। অল্পবয়েসী একটি মেয়ে যার দুচোখ কাজলে আঁকা, মাঝারী গড়ন, ফর্সা বর্ণ,
কালো চুলের মধ্যে হালকা লালচে শেড, ভরাট যৌবন। প্রত্যেকটি ছবিই সে খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে দেখলো।
গলায় আটকে থাকা কান্না হঠাৎ করে বমির আদলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নীলা
দ্রুত বেসিনের কছে যায়। গড়গড় কওে অনেকখানি তরল পদার্থ উদগীরণ করে। একটু
ধাতস্থ হয়ে দুহাত ভরে চোখ মুখে পানি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই নীলার বুকের
আঁচল খসে পড়ে পায়ের পাতা অবধি। বেসিনের আয়নায় নিজের উদ্ধত যৌবনের দৃশ্যমান
চোখ রাঙ্গানিতে নীলা ভীষণ লজ্জ্বিতবোধ করে। দুহাতে উর্ধ্বভাগ ঢাকতে গিয়েও
ঢাকেনা। তার অবয়ব গঠনে স্রষ্টা কোন কৃপণতা করেননি। নারী সৌন্দর্য্যের
ষোলকলায় সে পরিপূর্ণ। তারপরও তার স্বামী কেন অন্য নারীতে আকৃষ্ট! কি আছে
সেই মেয়েটির মধ্যে! নীলা রাগ মাখা ঈর্ষায় আবিষ্ট হয়।
সন্ধ্যায় বেশ দেরীতে বাসায় ফিরলো রক্তিম। নীলার মধ্যে কোন ভাবাবেগ নেই।
এক্ষুনি রক্তিমকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবেনা। রক্তিম ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকতে,
নীলা চুপিচুপি রক্তিমের মোবাইল ফোনের লাস্ট ডায়াল কল থেকে আন্দাজে যুথির
নাম্বার নিয়ে নিজের মোবাইলে সেভ করলো।
সন্ধ্যার নাস্তা সেরে রক্তিম বাইরে বেরুলো। রক্তিম বেরুতেই নীলা দরজা
বন্ধ করে দিলো। ওর বুক টিপটিপ করছে। নিজেকে অস্তিত্ত্বহীন জড় পদার্থের মত
মনে হচ্ছে। যেন কোন অনুভুতি নেই ওর দেহপিন্ডে। ওপাশে কে ফোন ধরবে? তার সাথে
রক্তিমের কি সম্পর্ক ভাবতেই নীলার পুরো শরীর ভুমিকম্পের মত প্রবল বেগে
কাঁপতে শুরু করে। সে কাঁপা হাতে যুথির নাম্বারে ডায়াল করলো।
অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পরও অপরপ্রান্তে কেউ কল রিসিভ করলোনা। দ্বিতীয়বার বেশ
কিছুটা সময় রিং হওয়ার পর অপরপ্রান্ত হতে ভেসে এলো, হ্যালো, স্লামালিকুম।
নীলা কাঁপা গলায় বললো, হ্যালো।
যুথি বলে, জ্বী, কে বলছেন?
নীলা তার কন্ঠে যতোটাসম্ভব দৃঢ়তা এনে বলে, আমি নীলা। ঢাকা থেকে বলছি। আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।
আমার সাথে কথা! আপনি কে? যুথি জিজ্ঞেস করে।
আমি কে আগেই বলেছি। এখন আমি আপনাকে যা যা জিজ্ঞেস করবো তার সঠিক জবাব দিয়ে আমাকে সাহায্য করবেন প্লীজ। কথাগুলো বলে নীলা থামে।
-আমার সাথে আপনার এমন কি কথা আমি বুঝতে পারছিনা! তারপরও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কি বলবেন বলুন।
-আপনি নিশ্চয় রক্তিমকে চিনেন?
-চিনব না কেন! অবশ্যই চিনি। কি হয়েছে রক্তিমের! ওর কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
-না ওর কিছু হয়নি। আচ্ছা আপনি কতোদিন থেকে ওকে চিনেন?
-অনেকদিন থেকেই চিনি তবে ঠিক কতোদিন বলতে পারবোনা।
-হুম, তা আপনি ওর সম্পর্কে কতোটুকু জানেন?
-একজন মানুষকে যতোটা জানা গেলে ভালোবাসা যায় তার চেয়ে অনেক বেশী জানি।
-আপনি জানেন কি আপনি একটা বড় ভুল করতে চলেছেন?
-ভুল! ভুল কোথায় করছি! আমি তো ভুলের কিছু দেখছিনা। আমি ওকে ভালোবাসি, সেও আমাকে ভালোবাসে।
একটা ছোট দম নিয়ে আসল বোমা ফাটালো নীলা। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, রক্তিম যে বিবাহিত সে কথা কি জানেন?
অপরপ্রান্ত থেকে সাথে সাথে হুংকার দিয়ে যুথি বললো, অসম্ভব! এটা কখনোই
হতে পারেনা। আপনি বানিয়ে বলছেন। আপনি নিশ্চয় আমাদের সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরানোর
জন্য এসব বলছেন।
নীলা বলে, আমি এক বিন্দুও বানিয়ে বলছিনা। রক্তিম বিবাহিত এবং আমি তার
বিবাহিতা স্ত্রী। আমরা আজ থেকে পাঁচ বছর আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি।
যুথির গলা মিইয়ে আসে। সে ভাঙ্গাগলায় বলে, আপনি সত্য বলছেন তার প্রমাণ কি?
নীলা দৃঢ়কন্ঠে বলে, আমিই সবচেয়ে বড় প্রমাণ, সবচেয়ে বড় সত্য। পৃথিবীতে এর চেয়ে ধ্রুব সত্য আর কিছু হতে পারেনা।
যুথি বলে, আপনার মুখের কথাতেই প্রমাণ হয়না আপনি রক্তিমের বিবাহিতা স্ত্রী।
আপনি কি প্রমাণ দিতে পারবেন? আপনি যতোক্ষণ না উপযুক্ত কোন প্রমাণ দিতে
পারছেন ততোক্ষণ আমিও বিশ্বাস করতে পারছিনা।
নীলা শান্তস্বরে উত্তর দেয়, আমার কাছে যথেষ্ট পরিমাণ প্রমাণ আছে। আমি
উপযুক্ত প্রমাণ নিয়েই আপনার সাথে কথা বলছি। আপনি চাইলে আমাদের কাবিননামার
কপি আপনাকে পাঠাতে পারি।
এবার যুথির খানিক বিশ্বাস হয়। একজন মেয়ে আরেকজন মেয়ের সাথে এতোটা মিথ্যে
কখনো বলবেনা। যুথির ভীষণ কান্না পায়। প্রেম-ভালোবাসা নামক জিনিসটার ওপর
ভীষন রাগ হয়। নীলা রিসিভারে কান রেখেই বুঝতে পারছিলো, ওপাশে যুথি কাঁদছে।
যুথি কান্নাতাড়িত কন্ঠে বলে, আপনার কথাগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমার
কিছু বলার নেই। কিন্তু ভাবতে কষ্ট হচ্ছে রক্তিম কীভাবে আমার সাথে এ ছলনা
করলো! জীবনে এই প্রথম আমি কাউকে ভালোবেসেছিলাম আর সে ভালোবাসাতেই এমন প্রতারিত হলাম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, আপনি কোন
চিন্তা করবেন না আমি চাইনা আমার কারনে কারও জীবন তছনছ হয়ে যাক। সে আমার
কাছে আর কোন প্রশ্রয় পাবেনা। সে এটাও জানবেনা আপনি আমায় ফোন করেছেন।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে যুথি মোবাইল রাখতে গিয়েও রাখেনা। নীলা বুঝতে
পারে অপরপ্রান্তে যুথি অঝোরে কেঁদে চলেছে। ঢুকরে ঢুকরে কান্নার শব্দে
তারহীন ফোনের সমস্ত তরঙ্গ বিষাদময় হয়ে উঠে। অনেকক্ষণ পর নীলা ফোন কেটে দেয়।
মেয়েটা প্রাণভরে কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে হালকা করুক নিজের মনটাকে। নীলা নিজেও
মেয়ে তাই সে বুঝতে পারে, একটা মেয়ে কতোটা আবেগ, কতোটা মন দিয়ে একজন
মানুষকে ভালোবাসে। তার চোখের কোনও অশ্রুজলে ভিজে ওঠে।
সকালের তেজোদীপ্ত সূর্য্যকীরণ উজ্জ্বল জ্যেতি ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো শোবার
ঘরে। আড়মোড়া ভেঙ্গে পাশ ফিরতেই রক্তিমের চোখে পড়ে, সদ্য গোসল সেরে
ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় নীলা হালকা প্রসাধনী করছে। সাদা তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল
বেঁধে রাখা। কানের লতি বেয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জলকণা। তারুন্যের উজ্জ্বল
আভায় রাঙ্গানো মুখমন্ডল যেন নন্দনকাননে প্রস্ফুটিত পুষ্পের একটি কোমল
পাঁপড়ি। এমন সুন্দরী স্ত্রী ঘরে থাকা সত্ত্বেও সে কেন অন্য মেয়ের প্রতি
আকৃষ্ট হয়েছে ভাবতেই নিজে লজ্জ্বিতবোধ করছে, অপরাধবোধে আচ্ছ্বন্ন হচ্ছে। সে
মনে মনে যুথিকে ধন্যবাদ জানায়। যুথি যদি গতরাতের অপ্রিয় সত্য বজ্রকঠিন
কথাগুলো না বলতো তবে হয়তো তার জীবনে একটা ঝড় বয়ে যেত। সে মনে মনে যুথির
কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ছাদের কার্নিশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বিড়বিড় করে বলে,
যুথি তুমি অনেক ভালো থেকো আর এই পিশাচকে ক্ষমা করে দিও নিজগুণে। যদিও জানি
এই অপরাধের কোন ক্ষমা হয়না তবুও তোমার কাছে এতোটুকু করুণা ভিক্ষা করছি।
রক্তিমের বিড়বিড় শব্দে নীলা পেছন ফিরে চাইলো। চোখের ঈশারায় জিজ্ঞেস
করলো, কি ব্যাপার? রক্তিম কোন কথা না বলে নীলার ডানহাতে আচমকা টান দিয়ে
বিছানায় নিজের বুকে নিয়ে এলো। নীলা মৃদু রাগ দেখিয়ে উঠে যেতে চাইলো। ঘন
নিঃশ্বাস নিতে নিতে নীলা বললো, এই সাত-সকালে এসব কি হচ্ছে! শেষ পর্যন্ত
রক্তিমের দৃঢ় বাঁধুনীতে পিষ্ট হয়ে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হলো। নীলার কোমল
ওষ্ঠে রক্তিম নিজের ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিলো বেশ জোর করে। ভালোবাসার মধুর অবগাহনে
দুটি ভিন্ন সত্ত্বা অভিন্ন সত্ত্বায় পরিণত হয়ে সাঁতরে বেড়াতে লাগলো
ভালোবাসার গহীন সমুদ্রে। যে ভালোবাসা কখনোই হারিয়ে যাবার নয়।