আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে

Latest News:

রবিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪

ছিটমহল - ইতিহাসের এক অযাচিত বিষফোঁড়া

 
'নিজভূমে পরবাসীএই কথাটির সাথে আমরা কমবেশী পরিচিতআর এই কথাগুলোর বাস্তব প্রমাণ বাংলাদেশ-ভারতের মোট ১৬২টি ছিটমহলের মানুষতাদের নিজস্ব ভূমি আছেনামমাত্রে তারা একটি দেশের অংশ, কিন্তু তাদের নূন্যতম মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যাপারে সরকারের কোন মাথাব্যাথা নেই

বাংলাদেশ ও ভারত সরকার কয়েকবার পদক্ষেপ নিয়েও উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নিসর্বশেষ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে স্থল সীমান্ত চুক্তি অর্থাৎ ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া আটকে ছিলসম্প্রতি পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়  তার অবস্থান পালটেছেনঅনেকদিন থেকে ঝুলে থাকা ছিটমহল বিনিময় ইস্যুতে তার সমর্থন জানানোর ঘোষনাকে সাধুবাদ জানাই

আমাদের অনেকের কাছেই ছিটমহল ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার নয়একটি দেশের ভূমি আরেক দেশের ভেতরে গেল কীভাবে! কিছুদিন আগেও এ ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক বোধগম্য ছিলনা! ছিটমহল কী! তাই নিয়ে লিখতে বসেছি আজ

সহজভাবে বলতে গেলে ছিটমহল হচ্ছে কোন দেশের মূল ভৌগলিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য একটি দেশের মূল ভৌগলিক সীমানার অভ্যন্তরে বিরাজমান ভূখণ্ড বা জনপদছিটমহল দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ওখানে যেতে হলে অন্য দেশটির জমির উপর দিয়ে যেতে হয়

বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে মোট ১৬২টি ছিটমহল রয়েছেএর মধ্যে ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আর বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ১১১টি ছিটমহল রয়েছেবাংলাদেশ ও ভারতের মোট ছিটমহলের আয়তন ২৪ হাজার ২৬৮ একরবাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মোট ক্ষেত্র ৭ হাজার ১১০ একরঅন্যদিকে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের মোট ক্ষেত্র ১৭ হাজার ১৫৮ একর

বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো প্রশাসনিক দিক থেকে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম এবং কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারী থানার অন্তর্গতএদের মধ্যে লালমনিরহাটের আওতায় ৩৩টি ও কুড়িগ্রামের আওতায় রয়েছে ১৮টি ছিটমহলভৌগলিক দিক থেকে এদের ৪৭টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের কুচবিহার জেলার অভ্যন্তরে এবং ৪টি জলপাইগুড়ি জেলার অভ্যন্তরে অবস্থিত

বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ছিটমহলগুলোর মধ্যে পঞ্চগড় জেলার সদর, বোদা ও দেবীগঞ্জ থানায় মোট ৩৬টি, নীলফামারী জেলার ডিমলা থানায় ৪টি, লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা ও পাটগ্রাম থানায় মোট ৫৯টি এবং কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারী থানায় মোট ১২টি ছিটমহল অবস্থিতপ্রশাসনিক দিক থেকে এগুলি সবই ভারতের কুচবিহার জেলার অন্তর্গত

ছিটমহলের ইতিহাসঃ
ছিটমহল সৃষ্টির পেছনে মূলত দায়ী রেডক্লীফের বিতর্কিত মানচিত্র তবে এই মানচিত্র নিয়ে আলোচনার আগে আরো কিছু বিষয় জানতে হবে

ছিটমহলের ইতিহাসের শুরু রংপুর অঞ্চলে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার পরআকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ ষোল শতকে (১৫৭৫ সালে) রংপুর অঞ্চলের কিছু অংশ জয় করেসতের শতকে (১৬৮৬ সালে) এই পুরো অঞ্চলটি মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ঘোড়াঘাট সরকারের অধীনে ন্যস্ত হয়অর্থাৎ তখন রংপুর অঞ্চল মোগলদের অধীন এবং তার উত্তরে স্বাধীন কোচ রাজার রাজ্য কোচবিহার ব্রিটিশ আমলেও একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল

কোচ বিহার প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে তথাকথিত স্বাধীনভাবে ইংরেজ আমলটিও পার করেতে পেরেছিলকোচ রাজাগণ এবং রংপুরের মহারাজাগণ মূলত ছিল সামন্ততাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, ছিল ঋণ পরিশোধের উদ্দেশ্যে মহলের বিনিময়বলা হয়ে থাকে, সেই মোগল আমলে প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা ও মহারাজারা মিলিত হতো তিস্তার পাড়ে দাবা ও তাস খেলার উদ্দেশ্যেখেলায় বাজি ধরা হতো বিভিন্ন মহলকে যা কাগজের টুকরা দিয়ে চিহ্নিত করা হতোখেলায় হারজিতের মধ্য দিয়ে এই কাগজের টুকরা বা ছিট বিনিময় হতোসাথে সাথে বদলাতো সংশ্লিষ্ট মহলের মালিকানাএভাবেই নাকি সেই আমলে তৈরি হয়েছিল একের রাজ্যের ভেতরে অন্যের ছিট মহল

আজকের ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সমস্ত ভূমি ব্রিটিশ রাজের অন্তর্গত ছিল নাপ্রায় ৪০ শতাংশ ছিল বিভিন্ন তথাকথিতস্বাধীন রাজ্যযেগুলিকে বলা হতোনেটিভ স্টেটবাপ্রিন্সলি স্টেটএ রাজ্যগুলি কার্যত ছিল ব্রিটিশদের অধীন তবে অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে রাজাদের কর্তৃত্ব বজায় ছিলহায়দ্রাবাদের নিজামের মত কোচ রাজাও ব্রিটিশদের নেটিভ স্টেট-এর রাজা হিসেবে থেকে যানভারত ভাগের সময় এরূপ রাজ্যগুলিকে স্বাধীনতা দেয়া বা ভাগ করার এখতিয়ার ব্রিটিশ রাজের ছিল না

১৯৪৭ সালে ১৫ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স এক্ট-১৯৪৭পাশ করেএ আইন অনুসরণ করে সেই বছরেই ১৫ই আগস্ট ব্রিটিশ রাজ বিলুপ্ত হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠিত হয়প্রণীত আইনে বলা হয়, উপমহাদেশেরস্বাধীনঅঞ্চলগুলোর নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেয়া সুযোগ থাকবে অথবা তারা স্বাধীন সত্তা নিয়েও ইচ্ছে করলে থাকতে পারবেরাঙামাটির রামগড় ও বান্দরবান পূর্ব পাকিস্তানের সাথে এবং পূর্ব সীমান্তের পার্বত্য ত্রিপুরা ও উত্তরের কোচ বিহার ভারতের সাথে যুক্ত হয়

অন্য কোন রাজ্যে জমি নিয়ে সমস্যা না ঘটলেও সমস্যা বাঁধে কুচবিহারেতখনকার কোচ রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের কিছু জমিদারি স্বত্ব ছিল বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার মধ্যেএকইভাবে রংপুর ও দিনাজপুরের জমিদারের কিছু তালুক ছিল কুচবিহার সীমানার ভেতরএ নিয়ে জমিদারদ্বয় কোন সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হন

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের উদ্দেশ্যে সীমানা নির্ধারণকল্পে সিরিল রেডক্লিফকে সভাপতি করে কমিশন গঠন করা হয়তিনি ছিলেন একজন আইনবেত্তা মাত্র, দেশের সীমানা নির্ধারণের মত কাজে তার কোন জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা ছিল নাকমিশনের অন্য সদস্যদেরও একই হাল ছিলকিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত ব্রিটিশ সরকারের না ছিল উদ্যম, না ছিল তার হাতে সময়

১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই ভারতে ভারতে আসেন এবং মাত্র ছয় সপ্তাহের কাজ করে ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেনকমিশন সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা আর জমিদার, নবাব ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের দ্বারা দেশের সীমারেখা নির্ধারণ প্রভাবিত হয়েছেকমিশন কোচ বিহার ও রংপুর এলাকার ছিটমহলগুলো নিয়ে কোন সমাধানে আসতে পারেনি এবং ছিটমহলগুলো বজায় রাখেএভাবে রেডক্লিফের অংকিত ম্যাপ অনুসারেই শেষ পর্যন্ত ভারত ভাগ হয় ও ছিট মহলগুলো থেকে যায়
তথ্যসূত্রঃ এই পোস্টটি তৈরি করতে উইকিপিডিয়া ও কয়েকটি বাংলা ব্লগের সাহায্য নেওয়া হয়েছে


২টি মন্তব্য:

  1. ধন্যবাদ গুরুত্বপূর্ন লেখাটি শেয়ার করার জন্য।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনাকেও ধন্যবাদ সময় করে আমার ব্লগে ঘুরে যাওয়ার জন্য।
      ভালো থাকুন অবিরাম।
      শুভকামনা সতত

      মুছুন

আপনার গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা আমার লেখনীকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। দয়া করে অশালীন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।

Copyright © 2014 রিপন ঘোষের খেরোখাতা All Right Reserved
^
Blogger দ্বারা পরিচালিত.